সাংবাদিক নির্যাতন প্রসঙ্গে

শওকত মাহমুদ
Published : 8 April 2013, 07:50 PM
Updated : 8 April 2013, 07:50 PM

৬ এপ্রিল ঢাকায় পেশাগত কর্তব্যে নিয়োজিত নারী সাংবাদিকদের ওপর হেফাজতে ইসলামের সমর্থকদের হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে লেখাটি শুরু করছি। এ হামলা সম্পূর্ণ অনাকাঙ্ক্ষিত এবং সাংবাদিকদের তথ্য-অধিকারের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার পরিমণ্ডলে রিপোর্টিংয়ে নারীরা এগিয়ে আসছেন। বিশেষ করে বৈদ্যুতিন (ইলেকট্রনিক) গণমাধ্যমে। আমাদের সমাজ এগোচ্ছে, সঙ্গে সাংবাদিকতাও। মুক্তচিন্তার যে কোনো মানুষ সাংবাদিকদের ওপর এ ধরনের হামলার নিন্দা করবে। হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে এ জন্যে দুঃখ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, সরকারের এজেন্টরা এসব হামলা ঘটিয়েছে। কিন্তু এ বক্তব্য সর্বাংশে সত্য কিনা, সংশয় আছে। কারণ নির্যাতিত সাংবাদিকরাই হামলাকারীদের চিহ্নিত করেছেন।

ইতোপূর্বে আমরা টিভির ফুটেজের মাধ্যমে সংশয়াতীতভাবে দেখেছি, আরটিভি'র রিপোর্টার, বর্তমানে একাত্তরে কাজ করেন, অপর্ণা সিংহের ওপর শাসকদলীয় এমপি কামাল মজুমদার স্বয়ং হামলা করেছিলেন। তাকে দৌড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। অপর্ণার অপরাধ, তিনি ওই এমপি'র স্কুলের চাঁদাবাজি সম্পর্কে তথ্যসংগ্রহে গিয়েছিলেন। এ ছাড়া পুলিশের হাতে টেলিভিশনের নারী সাংবাদিকদের অপদস্ত হওয়ার ঘটনাও হালে ঘটেছে। কিন্তু এসবের প্রতিবাদ হচ্ছে খণ্ডিতভাবে, রাজনৈতিক মতাদর্শের লাইন ধরে এবং নির্যাতনের প্রতিবাদটাও নির্ভর করছে শাসকদলের মর্জির ওপর। সমস্যা সেখানেই। অথচ সাংবাদিক পীড়ন ও হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিরোধটা গড়ে তুলতে হবে রাজনৈতিক পক্ষপাতের ঊর্ধ্বে উঠে, সম্পূর্ণ পেশাগত অধিকারের জায়গা থেকে।

নারী সাংবাদিকদের ওপর হামলার প্রতিবাদে নারী সাংবাদিক কেন্দ্র সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশকে সঙ্গে নিয়ে আকস্মিক এক প্রতিবাদ সমাবেশ করল। সাংবাদিকদেরা খবর পেলে আরও বেশি সংখ্যায় সেখানে যেতে পারতেন। আর উদ্যোক্তারা জানালে অপর সাংবাদিক ইউনিয়নও যোগ দিতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন এবং প্রকৃত খুনীদের গ্রেফতারের দাবিতে ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক সমাজের মঞ্চ থেকে আরটিভি'র নারী সাংবাদিকের ওপর হামলার প্রতিবাদ করেছিলাম আমরা। কিন্তু শাসক দল সমর্থিত ইউনিয়নের নেতারা এ নিয়ে বলতেন না।

সাগর-রুনি ইস্যুতে সাংবাদিকদের যে ঐক্য গড়ে উঠেছে তাকে স্থবির করে দেওয়া হয়েছে। গত ১১ মার্চ পূর্বঘোষিত প্রতিবাদ সমাবেশে এক অংশ যোগ দেয়নি। তারা পরে পৃথক সমাবেশে ঘোষণা করে, ''শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ না করলে ঐক্য হবে না।'' 'আমার দেশ' এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে সেখান থেকে কুলাঙ্গার বলে গালি দেওয়া হল। সাধারণ সাংবাদিকদের প্রশ্ন, শাহবাগ কবে ঐক্যের নির্ণায়ক হল? মাহমুদুর রহমানই বা ঐক্যের বাধা কীভাবে?

ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়নের অফিসে কখনও রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান অথবা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর ছবি টানানো হয়নি। কিন্তু এবার একাংশের অফিসে হয়েছে। ঐক্যের আলোচনা বৈঠকে এ-ও বলা হয়েছে যে, ওই ছবি মেনে ঐক্য করতে হবে। সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে 'জাতির জনকের প্রতিকৃতি' বসানোর দাবি করছে তারা। জাতির জনক প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সদস্যদের মতামতে ভিন্নতা রয়েছে। এ প্রসঙ্গে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সদস্যদের, এমনকি ওই গ্রুপেরও সবার মতামত নেওয়া হচ্ছে না। কোনো কোনো সাংবাদিক নেতা ব্যক্তিগত কৃতিত্ব দেখাতে এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর এর ফলে ঐক্যপ্রক্রিয়া আরও পিছিয়ে যাচ্ছে।

প্রেস ক্লাবে সবচেয়ে বেশি অবদান শহীদ জিয়া ও বেগম জিয়ার। তাঁদের ছবি টানানোর দাবি তো ওঠেনি কখনও। ছবি টানানোর পর, খুলে ফেলার অসম্মান তো ছবি যার, তারই।

সাংবাদিক নির্যাতনের প্রতিবাদে ফিরে আসি। বর্তমান সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক সাংবাদিক খুন হয়েছেন। এ সংখ্যা ১৭ জন। নির্যাতিত সাংবাদিকের সংখ্যা দু'হাজার ছাড়িয়ে গেছে। 'আমার দেশ' বন্ধ করে দেওয়ার পর এখন চলছে সুপ্রীম কোর্টের রায়ে। তা-ও সম্প্রতি একে বন্ধ করার ফন্দি-ফিকির চলছে। এর সম্পাদক মাহমুদুর রহমান লম্বা সময় জেল খেটেছেন; তাকে নতুন করে রাষ্ট্রদোহ মামলায় জড়ানো হয়েছে। 'সংগ্রাম' সম্পাদক আবুল আসাদ কারা-নির্যাতিত। একই পত্রিকার সিনিয়র ফটোজার্নালিস্ট আবদুর রাজ্জাক পুত্রসহ এখন জেলে। 'চ্যানেল ওয়ান', 'যমুনা টিভি', 'শীর্ষ নিউজ'সহ অসংখ্য গণ ও সামাজিক মাধ্যম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং টক-শোতে সরকারের সমালোচনার স্বাধীনতার অবস্থা সামরিক শাসনের চেয়েও খারাপ।

এসবের প্রতিবাদ হচ্ছে, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নির্যাতনের মাত্রা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পুলিশ সরাসরি সাংবাদিকদের দিকে বন্দুক তাক করে গুলি করেছে এমন ঘটনা ঘটেনি। সম্প্রতি বায়তুল মোকাররম থেকে মুসল্লিরা বের হওয়ার সময় কোনো কারণ ছাড়াই ঘটনাস্থল থেকে দূরে 'আমার দেশ' এর ফটো সাংবাদিক মীর আহমেদ মীরু, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচিত কর্মকর্তা সাংবাদিক আমিনুল হক ভূঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের এক এমপি'র মালিকানাধীন এক দৈনিকের ফটো সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হন। কিন্তু প্রতিবাদ হয় খণ্ডিত। শুধু প্রচার হয় পুলিশের ওপর তাণ্ডবের খবর।

শাহবাগীরা 'আমার দেশ', 'নয়া দিগন্ত', 'সংগ্রাম', 'দিনকাল', 'দিগন্ত টিভি'র বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সহিংস হুমকি দিয়েছে, স্পীকারের কাছে দেওয়া স্মারকলিপিতে সেসব মিডিয়া বন্ধের আবদার করেছে, পত্রিকাগুলোর কপি পোড়ানো হয়েছে। তারপর 'নয়া দিগন্ত' অফিসে আগুন দেওয়া হয়। এসবের প্রতিবাদ শুধু ভিন্নমতের সাংবাদিকেরা করেছেন, শাসক দলীয়রা করেন নি। একই সঙ্গে 'প্রথম আলো'র সম্পাদক যখন কাওরান বাজারে জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষে আহত হলেন, আমরা তারও প্রতিবাদ করেছি। কিন্তু ওরা করেন নি।

হেফাজতে ইসলাম ৬ এপ্রিল ঢাকায় স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম সমাবেশ করেছে। ইসলামবিদ্বেষী ব্লগারদের শাস্তি এবং সংবিধানে 'আল্লাহ'র প্রতি অবিচল আস্থা' বাক্যটি পুনঃসংযোজন তাদের মূল দাবি। আরও দাবি আছে, যে সব নিয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। সাংবাদিক প্রহারে তাদের কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না। কিন্তু মুসল্লিদের কতিপয়ের দ্বারা নারী সাংবাদিকেরা আক্রান্ত হয়েছেন, সেটাই সংবেদনশীলতার প্রশ্ন। সরকার-সমর্থকরা করলেও প্রতিবাদটা যৌক্তিক। কিন্তু এ জন্যে হেফাজতের খবর প্রচার করা হবে না- এ ধরনের হুমকি অতি-প্রতিক্রিয়ার ফল হিসাবেই মানুষ দেখবে।

কারণ, যেসব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারবার আশ্বাস দিয়েও সাগর-রুনি হত্যারহস্য উন্মোচনে পর্বতপ্রমাণ ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন, রুনির চরিত্র নিয়ে কটাক্ষ করছেন, তাদের খবর প্রচার না করার দাবি তো শুনিনি। রাজনৈতিক দল বা অরাজনৈতিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে আমাদের প্রথম অনুরোধ, কোনো ক্ষেত্রেই সংবাদকর্মীদের ওপর হামলা করবেন না। কোনো সংবাদ প্রতিষ্ঠানের গাড়ি ভাঙচুর বা পোড়াবেন না। কোনো গণমাধ্যমের সাংবাদিকের জন্য খবর সংগ্রহ নিষিদ্ধ করবেন না।

আওয়ামী লীগ ও শাহবাগীরা তাদের নিউজ কভারেজের ক্ষেত্রে ৬টি মিডিয়াকে কালো তালিকাভুক্ত করে রেখেছে। প্রতিবাদের জায়গা কোথায়? মিডিয়ার খবর সবসময় সত্য না-ও হতে পারে; তাতে ক্ষোভ সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু সে জন্যে ওই মিডিয়ার সাংবাদিকের ওপর হামলা চালিয়ে রাগ ঝাড়া অনুচিত। বরং আপত্তি জানান মালিকের কাছে অথবা বার্তাপ্রধানের কাছে। আর যুক্তিসঙ্গত ক্ষোভের ক্ষেত্রে আইনের আশ্রয় নেওয়ারও সুযোগ রয়েছে।

মিডিয়ার বার্তা-নিয়ন্ত্রকের কাছে আমরা বলতেই পারি, নারী সাংবাদিকদের ঝূঁকিপূর্ণ অ্যাসাইনমেন্টে না পাঠানোর দাবি একসময় উঠেছিল। ৬ এপ্রিল নিয়ে টানটান উত্তেজনার আশঙ্কা সবাই যখন অকপটে ব্যক্ত করেছে- তখন নারী সাংবাদিকদের সেখানে দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। এক টিভি চ্যানেলের রিপোর্টার, হিন্দু সম্প্রদায়ের, তাকে লাইভ করতে দেখলাম সেদিন বায়তুল মোকাররমে। কোন অ্যাসাইনমেন্টে করা যাবে এ নিয়ে প্রশ্ন তোলার কিছু নেই। কিন্তু ধর্মীয়ভাবে সংবেদনশীল এবং মেজাজে চড়া এমন অ্যাসাইনমেন্টে নারী ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাংবাদিকদের না পাঠালে কি হয় না? দুর্গা পুজার রিপোর্ট করতে কি টুপি পরিহিত মুসলিম সাংবাদিককে পাঠানো উচিত? অবশ্য ঘটনার পার্শ্ব-খবর তৈরি করতে চাইলে কে কী বলবে!

সর্বশেষ মিডিয়ার কভারেজ নিয়ে দেশের জন-বয়ান সম্পর্কে গণমাধ্যমের পরিচালকদের অধিকতর সচেতনতা প্রত্যাশা করি। সরকারকে নগ্ন সমর্থন করতে গিয়ে বিরোধী দল বা মতের কভারেজ বিকৃত করব, টক শোতে বিরোধী মতাদর্শের লোকদের বিব্রত করব- এমন ধারা চললে ক্ষোভ বাড়বেই।

একজন সম্পাদককে এ ক্ষেত্রে উদ্ধৃত করছি। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত 'উৎস মানুষ' পত্রিকার সম্পাদক অশোক বন্দোপাধ্যায় 'তথ্য যেখানে অন্ধ, সীমাবদ্ধ' শীর্ষক নিবন্ধে বলছেন, "ভুবনজোড়া আন্তর্জালে (সম্ভবত ইন্টারনেটকে বুঝিয়েছেন) তথ্যপ্রযুক্তির দৌলতে এখন তথ্যের দুরন্ত বিস্তার। পলকে পলকে বিশ্বব্যাপৃত তথ্যের এত জোগান যে তথ্যের চাপে হারিয়ে যায় ঘটনার মুখ। হারিয়ে যায় দৈনন্দিন বাস্তবতার হতাশা-যন্ত্রণা-নির্মমতা আর সত্যতা। ঘটনা খবরে আসে তথ্যপুষ্ট হয়ে, সচকিত করে আমাদের। আবার পলকেই নতুন তথ্যের ধাক্কায় সরে যেতে হয় তাকে। বিস্তৃতির অন্তরালে বিশ্লেষণের সুযোগ পাওয়ার আগেই। জানাবোঝা হয় না, অনুভব করা হয় না বাস্তবের প্রকৃত চরিত্র। এমন কি পাল্টা তথ্য সাজিয়ে বিকৃত করা হয় সত্য, ভ্রষ্ট করা হয় ঘটনার নির্যাস। কখনও বা কিছু তথ্য বিশ্লেষণের পর সমাজের ব্যাপক বঞ্চনা আর অসাম্যের চিত্র স্পষ্ট হতে থাকে- একদিকে মুষ্টিমেয় উচ্চশ্রেণি, অন্যদিকে বিরাট বঞ্চিত নিম্নশ্রেণি, অদ্ভুত অসম অবস্থান। 'তথ্য' এই বৈষম্য সংকটের সমাধান দেয় না। আমরা বিভ্রান্ত হই। আফসোস, আক্ষেপ, আক্রোশ পুঞ্জিভূত হয় বৃহত্তর জনাংশে- মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীনদের মধ্যে।''

এই ক্রমাগত পুঞ্জিভূত অভিমানের পরিণতি কী? অন্য কোনো বিস্ফোরণ? যেখানে তথ্যের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।……… হয়তো-বা!

শওকত মাহমুদ : সাংবাদিক এবং বিএনপি'র চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা।