জিম্মি হুমায়ূন আহমেদের ছবি, আক্রান্ত তাঁর প্রিয়জন

মেহের আফরোজ শাওন
Published : 8 April 2013, 10:05 AM
Updated : 8 April 2013, 10:05 AM

নিউইয়র্কে চিকিৎসার সময়টাতে জ্যামাইকার বাড়ির অ্যাটিকে সময় কাটানোর জন্য পুত্র নিষাদকে নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করেন হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর ভাষায় সেটা ছিল আঁকাআঁকি খেলা। নিজের আঁকা ছবির সবচেয়ে বড় ভক্ত ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ, আর তাঁর ভাষায় সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিল তাঁর পুত্র নিষাদ। ছোট্ট নিষাদ বিজ্ঞের মতো 'ছবি ভালো হয় নি' বললে পুত্রকে খুশি করার জন্য সেই ছবি ছিঁড়ে ফেলে আবার আঁকতেন হুমায়ূন। বেশ কিছু ছবি আঁকা হলে প্রদর্শনী করার কথা ভাবেন তিনি। আর তাই দুটি ছবি ফ্রেমবন্দি করে দেখার ইচ্ছার কথা জানান।

তখন নিউইয়র্কের পুস্তক ব্যবসায়ী বিশ্বজিত সাহার স্ত্রী রুমা সাহা ছবি দুটি ফ্রেম করিয়ে আনলে হুমায়ূন আহমেদ খুব খুশি হন। কিন্তু ফ্রেম করার জন্য রুমা সাহার কাছে বিশাল খরচের হিসাব শুনে কিছুটা দমে যান তিনি। পরে একদিন নিউইয়র্কের 'মাইকেলস' নামক একটি দোকানে ছবি আঁকার সরঞ্জাম কিনতে গিয়ে দোকানের ফ্রেম ডিপার্টমেন্ট দেখে অবাক হন হুমায়ূন আহমেদ। সেখান থেকে নিজেই পছন্দ করে ফ্রেম কিনতে শুরু করেন যা প্রথম দুটি ছবির ফ্রেমের খরচের প্রায় দশ ভাগের এক ভাগ। এরপর বিভিন্ন সময়ে নিজের ছবির জন্য প্রায় ২৫-৩০টি ফ্রেম কেনেন তিনি।

অথচ বিশ্বজিত সাহা তার সম্প্রতি প্রকাশিত `হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলি' বইতে হুমায়ূন আহমেদের পছন্দ করে কেনা ফ্রেমের কথা একবারও উল্লেখ করেন নি। বই পড়ে যে কারও মনে হবে হুমায়ূন আহমেদের আঁকা সবগুলো ছবির ফ্রেম করেছেন পুস্তক ব্যবসায়ীর স্ত্রী।

চিকিৎসা-বিরতিতে ঢাকায় আসার আগে ২৫টি ছবি আমি ও হুমায়ূন আহমেদ বিশ্বজিত ও তার স্ত্রীর হাতে হস্তান্তর করি একটি প্রদর্শনীর জন্য। শুরু থেকেই ছবি বিক্রি করার চিন্তায় ব্যস্ত পুস্তক ব্যবসায়ীর স্ত্রী বলে এসেছিলেন ছবি বিক্রির অর্থ শিল্পী আর এজেন্টের মধ্যে কীভাবে ভাগ হবে। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন নিশ্চুপ। দেশে ফিরে হুমায়ূন আহমেদ আমাকে বলেন, ছবি তিনি এঁকেছেন নিজের ও পুত্র নিষাদের আনন্দের জন্য, বিক্রি করে অর্থ ভাগাভাগি করার জন্য নয়। তাই তিনি ছবি বিক্রির সিদ্ধান্ত বাদ দেন। আরও বলেন ছবি যদি বিক্রি করতেই হয় তাহলে সুস্থ হয়ে ক্যানসার হাসপাতালের ফান্ড তোলার সময় হয়তো বিক্রি করবেন।

পুরো পরিস্থিতি পাল্টে গিয়েছিল ৩ জুন ২০১২। চিকিৎসা-বিরতি শেষে হুমায়ূন আহমেদসহ আমরা যখন নিউইয়র্কে পৌঁছলাম, ঢাকায় ছাপা ও সঙ্গে নিয়ে আসা প্রদর্শনীর ক্যাটালগ বিশ্বজিতের হাতে তুলে দেওয়া হলো। ক্যাটালগে হুমায়ূন আহমেদ লিখলেন 'ছবিগুলো বিক্রির জন্য নয়'। বিশ্বজিত ও তার স্ত্রীর পরিকল্পনা ছিল চড়া দামে ছবিগুলো বিক্রি করে ৪০ শতাংশ কমিশন নিবেন। ক্যাটালগ হাতে পাওয়ার পরও বিশ্বজিত ও তার স্ত্রী বহুবার আমাকে বলেছেন হুমায়ূন আহমেদকে বুঝিয়ে ছবি বিক্রিতে রাজি করানোর জন্য। কিন্তু আমার উত্তর ছিল একটাই- ছবিগুলো হুমায়ূনের সৃষ্টিকর্ম, তাঁর সন্তানের মতো। এ বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত।

সিদ্ধান্তের কোনো পরিবর্তন না হওয়ায় তারা যেন আমাদের চেনা কেউ থাকলেন না, দ্রুতই নিজেদের বদলে ফেলতে লাগলেন, দূরে সরে যেতে থাকলেন হুমায়ূন আহমেদের কাছ থেকে। জুন-জুলাইয়ের ওই দিনগুলোতে যাঁরা হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছি ছিলেন তাঁরা সবাই তাদের এই দূরে সরে যাওয়াটা লক্ষ্য করেছেন, মর্মাহত হয়েছেন। দুঃখ পেয়েছেন হুমায়ূন আহমেদ নিজেও।

এ সব কিছুই বেমালুম চেপে গেছেন পুস্তক ব্যবসায়ী তার বইতে। ছবিগুলো আটকে রেখেছেন এখনও। গত আট মাসে বহুবার চেয়েও ফিরে পেলাম না বাবার সঙ্গে কাটানো ছোট্ট নিষাদের আনন্দময় স্বর্গীয় মুহূর্তগুলোর স্মৃতিচিহ্ন এই ছবি। হুমায়ূন আহমেদের জীবনসায়াহ্নের এই স্মৃতিগুলো কি তবে জিম্মি হলো কোনো জীঘাংসার কাছে? পুস্তক ব্যবসায়ী তার লেখায় ছবির সংখ্যাও পাল্টে দিয়েছেন ইতোমধ্যে। ২৫টি ছবি হয়ে গেল ২১টি ছবি।

নির্জলা মিথ্যাচার, নিজেকে গ্ল্যামারাইজ করার নানা অপকৌশল আর হুমায়ূন আহমেদের চিকিৎসা বিষয়ে বহু গল্প ফাঁদার ব্যর্থ চেষ্টা আছে 'হুমায়ূন আহমেদের শেষ দিনগুলি' বইতে। তাঁর চিকিৎসাতে পরিবারের কথিত অবহেলা আবিষ্কার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা বইটির পুরোটা জুড়ে। এ যেন 'মার চেয়ে মাসির দরদ বেশি' বাংলা প্রবচনকেও হার মানায়।

চেয়ার থেকে পড়ে যাওয়া বিষয়ক কল্পিত ঘটনাকে সত্য প্রমাণের চেষ্টায় লিখেছেন বহু লাইন। প্রকৃত ঘটনার সময় সেই ঘরে ছিলাম শুধু আমরা দুজন- হুমায়ূন আর আমি। ২০ জুন বিকেলে প্লাস্টিকের একটি চেয়ারে বিশ্রাম করছিলেন হুমায়ূন, আর অন্যসব দিনের মতো তাঁর অবশ বোধ হওয়া হাতগুলো টিপে দিচ্ছিলাম আমি। ওই দিন সকাল থেকেই তাঁর অস্বস্তি বোধ ও ব্যথা হচ্ছিল। সামান্য জ্বরও ছিল। হাসপাতালে নিয়ে যেতে চেয়েছিলাম একাধিকবার। তিনি রাজি হন নি। বলেছেন এত বড় অপারেশনে ব্যথা হবেই। ডা: মিলারের সহকারী জ্যোতির সঙ্গে কথা বললে সে বলেছিল ব্যথা অনেক বেশি হলে হাসপাতালে নিয়ে যেতে।

হঠাৎ লক্ষ্য করলাম চেয়ারটির সামনের পা দু'টি ছড়িয়ে যাচ্ছে এবং চেয়ারটি আস্তে আস্তে দেবে যাচ্ছে মেঝের দিকে। আমি চিৎকার করে উঠলে বাড়িতে উপস্থিত অন্যেরা দ্রুত সেই ঘরে আসেন এবং তাদের সহযোগিতায় চেয়ার থেকে বিছানায় নেওয়া হয় হুমায়ূনকে কোনোরকম সমস্যা ছাড়াই। ২৯ জুন ডিলিরিয়াম হওয়ার আগ পর্যন্ত দেখা করতে যাওয়া বহু শুভাকাঙক্ষীর সঙ্গে অনেক বিষয়ে গল্প করেছেন হুমায়ূন। সেখানে চেয়ার থেকে পড়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটলে হুমায়ূন আহমেদ হয়তো স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বেশ মজা করেই সেই ঘটনার কথা বলতেন সবাইকে। অথচ পুস্তক ব্যবসায়ী লেখক কিনা বাড়ির কাজের মেয়ের কথা উল্লেখ করলেন।

পুস্তক ব্যবসায়ী তার বইয়ের ৮৪ পৃষ্ঠায় লিখেছেন:

১৬ জুলাই ২০১২

ওইদিন সকাল ১০টায় আমি আর রুমা যাই স্যারকে দেখতে বেলভ্যু হাসপাতালে। গত কয়েকদিন ধরেই আমার আর ভালো লাগছিল না। সবকিছু কেমন হয়ে গেল। গেটে পাশ নিতে গিয়ে জানতে পারলাম ১০ জন ব্যক্তির নাম দেওয়া ছিল, তাতে রুমার নাম নেই। আমি ভেতরে ইতঃস্তত বোধ করলাম। রনি বড়ুয়াকে ফোন করলাম। দুজন একসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গেলাম। হুমায়ূন আহমেদের পাশে সেদিন আর কাউকে দেখি নি।

আগের পৃষ্ঠাগুলোর বর্ণনা থেকে মনে হয় বিশ্বজিত প্রায়ই হাসপাতালে আসেন হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে। যদি পাঠক তা সত্য ধরে নেন, তাহলে হোঁচট খাবেন এই তথ্যে, ষোল জুলাই বিশ্বজিত জানলেন যে দশ ব্যক্তির জন্য পাশ ইস্যু করা হয় তাতে তার স্ত্রীর নাম নেই। আরেকটি কথা, তিনি লিখেছেন 'হুমায়ূন আহমেদের পাশে সেদিন আর কাউকে দেখি নি।' আমি, হুমায়ূন আহমেদের ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন হক কিংবা পারিবারিক বন্ধু মাজহারুল ইসলাম- কাউকেই বিশ্বজিত দেখলেন না তা কী করে হয়! আদৌ কি বিশ্বজিত বেলভ্যুতে সেদিন গিয়েছিলেন?

বিশ্বজিতের বইটি হাতে পাওয়ার পর বিষয়টি নিশ্চিত হতে আমি কথা বলি রনি বড়ুয়ার সঙ্গে। বই থেকে যখন পড়ে শোনাই, রনি চমকে উঠলেন। এত বড় মিথ্যাচার! আমার সঙ্গে কোনো কথাই হয় নি। দেখা তো দূরের কথা। রনি আরও জানালেন, ২৭ জুন থেকে ১৮ জুলাই পর্যন্ত বিশ্বজিত তার কাছে হুমায়ূন আহমেদের কোনো খোঁজখবরও নেননি।

১৯ জুন হাসপাতালের ১২ তলা থেকে হুইল চেয়ারে নেমে বন্ধু ফানসু মণ্ডলের গাড়িতে করে আমার সঙ্গে বাড়ি ফেরেন হুমায়ূন। (যদিও পুস্তক ব্যবসায়ী লিখেছেন হেঁটে এসে গাড়িতে উঠেছেন।) তাঁর চোখেমুখে তখন শুধু নিষাদ আর নিনিতের কথা। ৮ দিন তাঁকে না দেখে তাঁর ট্যানটা বাবা নিষাদ আর ঘ্যাংগা বাবা নিনিত (দুই ছেলেকে এভাবেই ডাকতেন তিনি) কেমন ছিল? সারাক্ষণ বাবার গায়ে লেপ্টে থাকা নিনিত আজ যদি বাবাকে দেখে ঝাঁপ দিয়ে কোলে উঠতে চায়! এমন অনেক গল্প।

বাসায় ফিরে দুই ছেলেকে নিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে হাসপাতাল থেকে আনা জেলো আর মুরগির স্যুপ খেয়ে বিশ্রাম করেন তিনি। শুভাকাঙক্ষীদের কেউ কেউ বাড়ি এসে খবর নিয়ে গেলেও দোতলায় ওঠেন নি। অথচ বইটিতে ১৯ জুন রাতের একটি মিথ্যা নিমন্ত্রণ প্রমাণের চেষ্টা হলুদ সাংবাদিকতাকে হার মানিয়েছে।

এছাড়াও সার্জারির সংখ্যা, জ্যামাইকা হাসপাতালে আমার বিকেলে যাওয়া, জাতিসংঘে হুমায়ূন আহমেদের সিনিয়র উপদেষ্টা হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা, প্রথম শ্রেণির টিকিটের কারণে দেশে ফিরতে দেরি হওয়াসহ আরও অনেক বিষয়ে মিথ্যাচার করেছেন বইটির পাতায় পাতায়। এমনকি হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে নিউইয়র্কের কিছু পত্রিকায় যেসব হলুদ সাংবাদিকতা হয়েছে তাও সংযুক্ত করা হয়েছে এই বইতে, যা থেকে বোঝা যায় পুস্তক ব্যবসায়ীর অসৎ উদ্দেশ্য।

মৃত হুমায়ূন আহমেদের মুখচ্ছবি ছাপার মতো নিম্নরুচির কাজের পাশাপাশি চমক দেখিয়েছেন তিনি বইটিতে ছবি ছাপার ক্ষেত্রেও। ৭৫ নং পৃষ্ঠায় একটি ছবি ছেপেছেন, যার ক্যাপশন 'চিন্তিত হুমায়ূন আহমেদ, ওজোন পার্কের বাড়ির পেছনে ১২ জুন প্রথম সার্জারির আগে।' এই ছবিটি তিনি কোথা থেকে সংগ্রহ করেছেন জানি না। ছবিটি ২০০৮ সালের ১০ অক্টোবর দুপুর ২টা ১০ মিনিটে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে মাটিকাটা নামক জায়গায় টিভি নাটক 'জোছনা ও জননীর গল্প'এর শুটিং চলাকালে তোলা।

মিথ্যাচার আর বানোয়াট গল্পের কমতি নেই বইটিতে। আদতে ভাববার বিষয়, ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত এমন নির্জলা মিথ্যাচারকে কি আদৌ 'বই' বলা যায়? আসলে এটা প্রয়াত কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের প্রিয়জনদের প্রতি এক জঘন্য আক্রমণ। এই রকম ব্যক্তিগত আক্রমণ করে কিংবা হুমায়ূন আহমেদের ছবিগুলো জিম্মি করে শেষ পর্যন্ত সফল হওয়া যাবে বলে আমি মনে করি না।