নারীনীতি বাতিলের কথা বলছে ওরা কারা

হামিদা হোসেন
Published : 7 April 2013, 07:52 PM
Updated : 7 April 2013, 07:52 PM

২০১৩ সাল শুরু হওয়ার পর থেকেই সবার মধ্যে একটি ভীতি কাজ করছিল যে রাজনৈতিক কারণে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে। সে আশঙ্কা সত্যি হয়েছে, এবং এরই ধারাবাহিকতায় এখন আমরা ঘন ঘন হরতাল দেখতে পাচ্ছি। নিজেদের হীন স্বার্থে রাজনৈতিক শক্তিগুলোকে ক্রমাগত কথায় ও কর্মসূচিতে যুদ্ধ করতেও দেখছি আমরা।

এমন একটি প্রেক্ষিতেই ৬ এপ্রিল একটি ইসলামী সংগঠনকে লংমার্চ করতে দেখা গেল। হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটি আলোচিত লংমার্চ শেষ করে ঢাকায় বিরাট একটি সমাবেশ করেছে। সংগঠনটির লংমার্চ ও সমাবেশ কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন থাকার কিছু কারণ রয়েছে। প্রথমত, এদের ১৩ দফা দাবি নিয়ে সচেতন মহল ও নারী অধিকার কর্মীরা বিক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের দাবিগুলো আমি পড়ে দেখেছি। সেখানে নারীনীতি বাতিল করার দাবি জানানো হয়েছে। অন্যান্য দাবিগুলোর মধ্যেও এটা সুস্পষ্ট যে, এরা আমাদের দেশের নারীদের সমঅধিকার ও স্বাধীন কর্মকাণ্ডের বিরোধী।

শুধু দাবি করার মধ্যেই এরা সীমাবদ্ধ থাকেনি, এদের কিছু কিছু কর্মী কয়েকজন নারী সাংবাদিককে কর্মরত অবস্থায় প্রহার ও বিব্রত করেছে বলেও পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে। এটি খুব উদ্বেগের বিষয়। আরও দেখেছি যে, সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা অন্যান্য কর্মজীবী নারীদেরও যাত্রাপথে ও কাজেকর্মে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশের সচেতন নারী সমাজ এসব ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছেন।

আমি এ প্রসঙ্গে আলোচনাটা একটু ভিন্ন দিকে নিয়ে যেতে চাই। আজ আমাদের নারীদের অগ্রযাত্রা থামিয়ে দেওয়ার জন্য কোনো একটি বিশেষ গোষ্ঠী বা দল কী বলছে বা কেন বলছে সেটির পেছনে একটি রাজনৈতিক কারণ রয়েছে। আমি মনে করি, প্রথমত, আমাদের দেশে এক বিশেষ ধরনের রাজনৈতিক সংস্কৃতি চলছে যেখানে নির্বাচন কেন্দ্র করে নানা ধরনের রাজনৈতিক সমীকরণ হয়। এরপর ভোটাভুটির মাধ্যমে যারাই ক্ষমতায় যান তারা রাষ্ট্রক্ষমতাকে জমিদারি বলে মনে করেন। ফলে আবার যখন নির্বাচনের সময় আসে তখন ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য রাজনীতিবিদরা পরস্পরের সঙ্গে জটিল নানা খেলায় মেতে ওঠেন।

এর পরিণতি হচ্ছে ভয়াবহ। দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র তো প্রতিষ্ঠিত হয়ই নি, আইনের শাসনও থাকছে না। হেফাজতে ইসলামের মতো কোনো গোষ্ঠীর দ্বারা এরকম মধ্যযুগীয় ১৩ দফা দাবি পেশ করা এসবেরই ধারাবাহিকতা। এটাই যেন বাংলাদেশে একটি সিস্টেমে দাঁড়িয়ে গেছে যে, কেউ কেউ আইন ও সংবিধানের তোয়াক্কা না করে নিজেদের দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থে বিভিন্ন দাবি পেশ করবে। আবার সেসব সরকার মেনে না নিলে দাবি যারা করেছে তারা অরাজকতা তৈরি করবে, দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নষ্ট করার চেষ্টা করবে, হরতাল দেবে ইত্যাদি। যেকোনো দলই ক্ষমতায় বা বিরোধী দলে থাকুন না কেন, একই ধরনের পরিস্থতি তৈরি হচ্ছে।

এখানে যদি একটি সত্যিকারের আইনের শাসন থাকত, সবাই সংবিধান মেনে চলত, তবে এমন কিছু ঘটার বাস্তবতা থাকত না। আজ হেফাজতে ইসলাম যে ১৩ দফা দাবি পেশ করছে তাতে সংবিধানে ও আমাদের আইনি কাঠামোতে বিরাট পরিবর্তনের দাবি আছে। এ যে নারীনীতি পেয়েছি আমরা, এটি তো আমাদের নারীসমাজের দীর্ঘদিনের দাবির ফসল। অনেক বছর ধরে বিভিন্ন সরকারের সঙ্গে নারী অধিকার কর্মী ও নারীদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নীতিমালাটি তৈরি হয়েছে। এটা একদিনে ভুঁইফোড় কারও দাবির প্রেক্ষিতে হয়নি।

আমি প্রশ্ন করব, আমাদের দেশের নারীদের অধিকার সমাজের নানা ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা করার জন্য রাষ্ট্র যে নীতিমালা মেনে চলবে, তা বদলে ফেলার জন্য তারা দাবি করার কে? মতিঝিলের শাপলা চত্বরে জমায়েত করে কিছু দাবিনামা হাজির করলেই কি হবে? কে তাদের এসব দাবি করার অধিকার দিয়েছে? এ সমাবেশ 'শান্তিপূর্ণ' হয়েছে দাবি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওদের ধন্যবাদ পর্যন্ত জানিয়েছেন। আর ওদিকে ওরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গলা কাটতে চেয়েছে! এ হল রাজনীতি।

হেফাজতে ইসলামী নামের দলটি শুধু নারীনীতির বিরোধিতা করছে না, তারা অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার প্রসঙ্গে ব্লাসফেমি আইন চালুর কথাও বলছে। পৃথিবীর কোন সভ্য দেশে ব্লাসফেমি আইন চালু আছে? ওদের সামনে উদাহরণ পাকিস্তান ও সৌদি আরব। তাহলে আমার কি বাদবাকি সভ্য রাষ্ট্রের উদাহরণ বাদ দিয়ে একটি বা দুটি রাষ্ট্রে চালু মধ্যযুগীয় কোনো আইনকে আদর্শ মনে করব? তাহলে তো আমরাও মধ্যযুগে ফিরে যাব, তাই নয় কি?

ইদানিং শুনতে পাচ্ছি, এবং হেফাজতে ইসলামীও বলছে, 'নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি চাই'। কারণ ওদের বক্তব্য এ ব্লগাররা অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে লিখছে, ইত্যাদি। আমার তো মনে হয় না যে, আমি গত দু'মাস আগে ব্লগে লেখালেখির মধ্যমে অন্যের ধর্মনুভূতিতে আঘাত করা বা এ জাতীয় কোনো কথা শুনেছি। আমি জানি না আসলে ব্লগে ছেলেরা কী লিখছে বা কীভাবে তাতে কোনো এক বা একাধিক ধর্মের মানুষের অনুভূতিতে আঘাত করা হচ্ছে। এসব লেখালেখির কারণে কিছু তরুণকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে।

এসবের পেছনেও রয়েছে রাজনীতি। এ জন্যই বলছি যে, তাহলে তো এসব কথা আমরা আগে শুনতাম। তরুণ ব্লগাররা অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করে লিখছে এ নিয়ে হঠাৎ করে এখন এত কথা হচ্ছে, আগে কিছু শুনিনি কেন? হেফাজতে ইসলাম রাজনীতিতে একটি সুযোগ চাচ্ছিল, সেটি তারা পেয়েছে, আর কিছু নয়।

আসল কথা যেটি তা হল, দলগুলো মূলত রাজনীতি করছে। তাই আজ যারা ব্লগারদের শাস্তি দাবি করছে বা নারীনীতি বাতিল করাতে চাচ্ছে তাদের সঙ্গে অন্যদের এক ধরনের রাজনৈতিক খেলা চলছে। যত বিপজ্জনকই হোক, দলগুলো এভাবে খেলতেই খুশি হচ্ছে। এসব খেলার ফলে দলগুলো নিজেরাও সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। তাতে যে দেশের ক্ষতি হচ্ছে এ নিয়ে দলগুলোর মাথাব্যথাও নেই। এরা শুধু নিজেদের দলীয় বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের জন্য খেলছে- তা যত বিপজ্জনকই হোক না কেন।

এতে বিপর্যস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষের জীবন। আমাদের যে গার্মেন্টস শিল্প বৈদেশিক মুদ্রা আনছে, দেশের অর্থনীতি সবল রাখছে- সে শিল্পের কর্মী মেয়েরা হরতালের সময় কাজে যেতে পারছে না। ফলে তাদের বেতন কাটা হচ্ছে। গোটা দেশে অনেক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকছে। এ দেশের মানুষ কি এসব চান?

সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তারা কী চান। তারা চান শান্তি। নির্বিঘ্নে নিরাপদে পথচলা, কাজকর্ম করার সুযোগ চান তারা। দ্বিতীয়ত, তারা চান স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের সুযোগ। তৃতীয়ত, আমাদের সমাজে সবার মানবাধিকার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা, সমাজ থেকে নারী-পুরুষের মধ্যেকার বৈষম্যসহ সব ধরনের বৈষম্য দূর করা- এটাও সাধারণ নাগরিকের আরেকটি চাওয়া। রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব জনগণের এসব চাওয়া পূরণ করা।

এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা বলব। বঙ্গবন্ধু ‍কিন্তু যেকোনো পরিস্থিতিতে বিরোধী পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করতেন। প্রয়োজনে সমঝোতায় যেতেন। আমাদের কোনো দলই এখন সেটা না করে সংঘাতের দিকে চলে যায়। আমরা, সমাজের সিভিল সোসাইটির মানুষেরা এসব বিষয়ে রাজনীতিবিদদের বলছি। কারণ এটা আমাদের দায়িত্ব। আমরা তাদের বলছি এসব বন্ধ করে মানুষের মতো আচরণ করতে। কিন্তু তারা আমাদের কথা একদমই শুনছেন না। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি- এটা আমাদের গোটা দেশের চিত্র- আমাদের স্থানীয় সংসদ সদস্য তো কখনওই কোনো বিষয়ে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে আসেননি। তাহলে নাগরিকের কথা শুনছেন কারা, জনপ্রতিনিধিরাই যেখানে তাদের কাছ থেকে দূরে! অথচ তারা তো জনপ্রতিনিধিত্ব করার ব্যাপারে শপথ নিয়ে আসেন।

তাই যতদিন পর্যন্ত না রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পরষ্পরের সঙ্গে আলোচনা ও সমঝোতায় যাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হবে- ততদিন নির্বাচনের রাজনীতির বিপজ্জনক খেলাটি বন্ধ হবে না। এর শিকার হবেন সাধারণ শিল্পশ্রমিক, কর্মরত নারী সাংবাদিক বা গাঁয়ের সাধারণ কৃষক।

ড. হামিদা হোসেন : মানবাধিকারকর্মী, গবেষক এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।