টাকা আছে টাকা নাই

আনু মুহাম্মদ
Published : 18 Nov 2016, 07:05 AM
Updated : 4 April 2013, 08:49 AM

টিভি ক্যামেরা আড়াল করতে চেষ্টা করলেও বিভিন্ন সভাসমাবেশের মধ্যে প্রায়ই মন্ত্রীদের ঘুমাতে দেখা যায়। ঘুমানোর ফাঁকে কথা বলার সময় এলে মন্ত্রীরা বাণী দেন, কিন্তু বেশিরভাগ সময় তার সাথে বিষয়ের কোনো সম্পর্ক থাকে না। কোনো চিন্তাভাবনা করে বা দায়িত্ব নিয়ে যে তারা কথা বলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেজন্য আজকে এককথা কালকে উল্টোকথা প্রায়ই শোনা যায়। তবে সন্দেহ নেই, শেষবিচারে তাদের লক্ষ স্থির থাকে। যা করতে তারা এসেছেন সেটাই তারা করেন।

এব্যাপারে অর্থমন্ত্রী সবার শীর্ষে। সম্প্রতি তাঁর সাথে তুমুল প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। অর্থমন্ত্রীর মুদ্রাদোষ হল 'রাবিশ'। আর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ধ্যানস্ত হবার আগে পরে বলেন, 'মূলোৎপাটন করা হবে', 'দেখামাত্র গুলি করা হবে' কিংবা 'অপরাধীকে অবশ্যই ধরা হবে'। নিরীহ মানুষ খুন হয়, ক্রসফায়ার চলতে থাকে। খুনী সন্ত্রাসীরা মহানন্দে ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমধ্যে ধ্যান বা ঘুম থেকে ওঠে তিনি বরং সন্ত্রাসী ছাড়ানোর বা তাদের আড়াল করবার ব্যবস্থা করেন। কথাবার্তা যতই উল্টোপাল্টা শোনা যাক না কেনো লুটেরাদের পক্ষে যুক্তি সাজাতে অর্থমন্ত্রীর, আর সন্ত্রাসীদের পক্ষে যুক্তি সাজাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভূমিকার কোন ব্যত্যয় ঘটে না।

এগুলো আমরা কৌতুকের বিষয় হিসেবে নিতে পারতাম। কিন্তু তা সম্ভব হয় না। এর কারণ খুব সরল, এগুলো তাঁদের জন্য কৌতুকের বিষয় হতে পারে, কিন্তু তা আমাদের জন্য জীবন মরণ সমস্যা। খুনি লুটেরাদের রক্ষা করবার আরেক অর্থ সাধারণ মানুষের জীবনকে অতীষ্ট, নিরাপত্তাহীন এবং বিপর্যস্ত করা। সেটাই তাঁরা করছেন।

স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোটিপতির সংখ্যার প্রবৃদ্ধি জিডিপি প্রবৃদ্ধির চাইতে বেশি। কোটিপতি বাংলাদেশ মডেলে প্রাথমিক ভূমিকা ছিলো 'ডিলারশীপ' ও 'পারমিট'। দ্বিতীয় পর্যায়ে খেলাফী ঋণ, যা এখনও চলছে। এর মধ্যে ক্ষুধা আরও বেড়েছে। শুরু হয়েছে জনসম্পদ দখল, সম্পদ লোপাট, দেশের সর্বনাশ করে বড় বড় কমিশনের বিনিময়ে চুক্তি। ঋণ খেলাফী নয়, হলমার্ক ব্যাংক লুট করবার রাস্তা নিয়েছে। আর অর্থমন্ত্রী তাদের রক্ষা করতে প্রথম থেকেই নানা কথা বলে যাচ্ছেন, কাজও হচ্ছে সেই মতো।

দেশে হুলস্থুল অবস্থার মধ্যে ব্যাংক লুটকারিদের উদ্ধার তৎপরতা থেমে নেই। আর দেশের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি করে নানা চুক্তিস্বাক্ষরের কাজও ঠিকই চলছে। এগুলোতে 'বিরোধী' প্রধান দলগুলোর মৌনতাও সম্মতি হিসেবে কাজ করছে। সরকার এখন বঙ্গোপসাগরে গভীর ও অগভীর সমুদ্র সীমায় ১২টি ব্লক বিদেশি কোম্পানিকে ইজারা দেবার জন্য 'পিএসসি ২০১২' অনুযায়ী বিডিং করছে। ইতিমধ্যে অগভীর সমুদ্রে ভারতীয় রাষ্ট্রীয় কোম্পানি ওএনজিসি এবং যুক্তরাষ্ট্রের কনোকো ফিলিপস একতরফাভাবে তিনটি ব্লকে কর্তৃত্বে পেয়ে যাচ্ছে। 'বিপুল ব্যয়বহুল' বলে প্রচারিত এই কাজে ভারতীয় কোম্পানি ৮ বছরে ৯ নম্বর ব্লকে তিনটি কূপ খননসহ অনুসন্ধান কাজে বিনিয়োগ করবে ৫০০ কোটি টাকারও কম, কনকো ফিলিপস ৭ নম্বর ব্লকে এরকম সময়ে একই কাজে ব্যয় করবে ৩১০ কোটি টাকা (নিউ এজ, ৩ এপ্রিল ২০১৩)। বিনিময়ে তাদের কাছে যাবে সাগরের বিপুল সম্পদ। গভীর সমুদ্রের জন্য পিএসসি সংশোধন হচ্ছে বিদেশি কোম্পানির চাহিদা অনুযায়ী। যার ফলে বঙ্গোপসাগরের গ্যাস আমদানি করা দামে আমাদেরই কিনে নিতে হবে। আর প্রাপ্তি বেশি হলে তা রফতানি হবে, বাংলাদেশ চিরতরে তার সম্পদ হারাবে, লাভ হবে কোম্পানির।

নিজেদের 'টাকা আর সামর্থ্য নেই' এই যুক্তি তুলে স্থলভাগ ও সমুদ্রের সম্পদ এভাবেই বিদেশি কোম্পানির হাতে বারবার তুলে দেয়া হচ্ছে। যাদের আবার ঋণ করতে ব্যাংক গ্যারান্টি দিচ্ছে সরকার, তাদের কর মওকুফ করা হচ্ছে, তাদের স্বার্থ অনুযায়ী নানা সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্ট মেরামতের জন্য, সমুদ্র বা স্থলভাগে সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নিজেদের দায়িত্ব গ্রহণে সক্ষমতা বৃদ্ধি, গবেষণা, সর্বজন (পাবলিক) শিক্ষা বা চিকিৎসা খাতে ব্যয়–এগুলোতে অর্থবরাদ্দ করতে গেলেই অর্থমন্ত্রী আর টাকা খুঁজে পান না। দেশের অর্থনীতির প্রয়োজনে ২শ', ৪শ', ১হাজার কোটি টাকাও তাঁর কাছে অসম্ভব বেশি, কিন্তু হলমার্কের প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লুটের কথা যখন প্রকাশিত হল তখন তিনি বললেন, 'এই টাকা কিছুই না।' ব্যাংকের অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটে জড়িতদের নিয়ে কথা উঠলে তিনি বলেন, 'পৃথিবীর সব ব্যাংকেই এটা হয়।'

অন্য কিছু হয় না পৃথিবীর অন্যান্য দেশে? পৃথিবীর বহুজায়গায় তো জাতীয় সংস্থার মাধ্যমে নিজেদের সম্পদ নিজেদের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়। ভারতের ওএনজিসি এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে, ভারতের সামান্য একটু অংশ বাদে বাকি অনুসন্ধান ও উত্তোলন তারাই পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের বয়স ৪২ বছর। ওএনজিসি-কে সক্ষম প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে ভারতের এর অর্ধেক সময়ও লাগে নাই। নরওয়ে তার বিশাল তেল সম্পদ অনুসন্ধান ও উত্তোলনকাজ জাতীয় সংস্থা স্টেটওয়েল দিয়েই পরিচালনা করছে। এর ফলে নরওয়ের তেল সম্পদের পুরো সুফল এখন পাচ্ছে সেখানকার মানুষ। এই প্রতিষ্ঠান আর বাংলাদেশের পেট্রোবাংলার বয়স সমান, মালয়েশিয়ার পেট্রোনাসও তাই। কিন্তু তারা দেশের সম্পদ সুরক্ষা করে এখন বিশ্বজয় করছে, আর বাংলাদেশে পেট্রোবাংলাকে বানানো হচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানির স্থানীয় কর্মচারি।

রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট মেরামত ও নবায়নে ৭০০ কোটি টাকার সংস্থান হয় নাই, বিশ্বব্যাংকের কাছে ধর্না দিয়েছে সরকার। জানা কথা যে, বিশ্বব্যাংক তার নীতিগত অবস্থানের কারণে রাষ্ট্রীয় বিদ্যুৎ প্লান্টের ভূমিকা বাড়ানোর চাইতে তা খর্ব করতেই বেশি আগ্রহী থাকবে। সেটাই হয়েছে। বিশ্বব্যাংক অর্থ দেয়নি। আর এই অজুহাত দেখিয়ে বিদ্যুৎ প্লান্টগুলোও ঠিক হয়নি। ৭০০ কোটি টাকার সংস্থান হয়নি কিন্তু রেন্টাল কুইক রেন্টালের জন্য বাড়তি তেল আমদানি ও বিদ্যুতের বাড়তি দাম মিলিয়ে ২০ হাজার কোটি টাকারও বেশি বাড়তি বোঝা নিতে সরকার বা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কোনো দ্বিধা হয়নি। কারণ তাতে লাভ হচ্ছে কিছু ব্যক্তি/গোষ্ঠীর। বোঝা তো জনগণের ওপর চাপানোই যাচ্ছে। ঋণগ্রস্ততা বেড়েছে, বিদ্যুতের দাম বেড়েছে, ভর্তুকি বেড়েছে।

ঋণ নিতে অর্থমন্ত্রীর বিশেষ আগ্রহ। পদ্মা সেতু নিয়ে দীর্ঘ জটিলতার সৃষ্টি হল, সমাধান এখনও হয়নি। পদ্মা সেতুর জন্য সার্বভৌম বন্ডের উদ্যোগ নেবার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। অনেক ঝুঁকি তৈরি হবে তাতে। অন্যদিকে ভারতের ঋণের আগের বোঝা টানতে বহু মন্ত্রণালয় অস্থির, কিন্তু ঠিকই পদ্মা সেতুর জন্য আবার ২০ মিলিয়ন ডলার ঋণ, যা প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়, তাই নিয়ে পুরো প্রকল্পকে নানা শৃঙ্খলে জড়ানো হয়েছে। এর আগে ভারতের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারের চাইতে বেশি দামে রেলওয়ে কোচসহ বিভিন্ন কেনাকাটা হচ্ছে। শুধু ৭০টি রেলওয়ে কোচ কেনার জন্য ৩০০ কোটি টাকা বাড়তি খরচ হযেছে। আর চীনের সাথেও চলছে নানা অঘটন, তাদের কাছ থেকে নেয়া ঋণের টাকায় আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ দামে কেনার কারণে বাড়তি খরচ হচ্ছে ৬৭০ কোটি টাকা। আইএমএফ এর কাছ থেকে তিন বছরে কয়েক কিস্তিতে ১০০ কোটি ডলার ঋণ নেয়া হয়েছে। তার জন্য কয়েক দফা তেল ও বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। আরও বাড়ানোর জন্য পথ খোঁজা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হুমকি ধামকি শুনছি আমরা প্রতিনিয়তই। কিন্তু তার এই হুমকি ধামকির মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে বড় সহিংসতা, অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা চলছে। অনেক ধর্মঘট, হরতালের ইতিহাস বাংলাদেশে আছে। কিন্তু এভাবে রেলওয়ে স্টেশনে বগি, ইঞ্জিনে আগুন দেয়া, বিভিন্ন লাইনে প্লেট তুলে ফেলে রেল জমিতে ফেলে দেয়ার ঘটনা একের পর ঘটে যাওয়ার কোন পূর্ব দৃষ্টান্ত নেই। এই মাত্রায় বিদ্যুৎ কেন্দ্রে হামলাও আগে কখনো হতে পারেনি। দিনের পর দিন সাম্প্রদায়িক হামলা চলছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা কই? গোয়েন্দা সংস্থার কার্যক্রম কোথায়? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তো সারাক্ষণ দৌড়ানোর কথা এখন। কিন্তু আঙ্গুল চুষতে অস্বীকৃতি জানালেও এছাড়া তিনি আর কী করছেন সেটা বোঝা যাচ্ছে না।

গল্প বলে, কৃষক গণিমিয়া ঋণ করে সর্বশান্ত হয়েছিলেন, ঘি খাওয়ার পরিণতিতে তাঁকে অনাহারে দিন কাটাতে হয়েছিল। তবে নিজের ঋণের দায় তিনি নিজেই নিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী একদিকে অনাবশ্যক ও বাজে শর্তে ঋণের জালে জড়াচ্ছেন দেশকে, অন্যদিকে শেয়ারবাজার হলমার্কসহ দুর্নীতি, লুন্ঠনের সবগুলো ক্ষেত্রে উদার পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছেন। এর পরিণতি তো তাঁকে বহন করতে হচ্ছে না, তাঁর 'ঘি খাওয়ায়' কখনোই টান পড়বে না। এসবের শিকার হচ্ছে এদেশের মানুষ, এইদেশের অর্থনীতি। শুধু বর্তমানেরই নয়, ভবিষ্যত প্রজন্মকেও এসব অপকর্মের বোঝা টানতে হবে।

কিন্তু তাঁদের কথা বলেই কী হবে? এসব কাজ করবার জন্যই যদি তারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে থাকেন তাহলে তারা তো নিয়োগদাতা/দের দৃষ্টিতে যথেষ্টই দায়িত্বশীল!

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।