পাকিস্তান-মার্কা নয়, চাই একাত্তরের বাংলাদেশ

আবদুল মান্নান
Published : 30 March 2013, 03:17 PM
Updated : 30 March 2013, 03:17 PM

এক অদ্ভুত আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় এবার বাংলাদেশের মানুষ তার নিজ দেশের তেতাল্লিশতম স্বাধীনতা দিবস পালন করল। এমন অভিজ্ঞতা এদেশের মানুষের আগে কখনও হয়নি। এবার ঘটল কারণ বিরোধী দল আর কয়েক মাস পর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে নারাজ। তাদের এখনই যে কোনো উপায়ে ক্ষমতায় যাওয়া চাই। দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে হলেও।

ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিরোধী দল আহুত যুদ্ধের মাঝখানে পড়ে গিয়েছে এবার বাঙালি। যুদ্ধটা ওরা শুরু করেছিল প্রায় তিন বছর আগে। থেমে থেমে তারা এ যুদ্ধ করেছে কিন্তু কখনও স্বাধীনতা দিবসে এ যুদ্ধ চলেনি। এবার এর ব্যতিক্রম দেখা গেল। তার একটা কারণ হতে পারে দল হিসেবে বেশ কিছুদিন ধরে বিএনপি জামায়াতের মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে। সুতরাং এ মুহূর্তে শুধু বিএনপি নয়, দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী, মিডিয়া, রাজনৈতিক দল, ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে খাওয়া গোষ্ঠী বা ব্যক্তি সবাই জামায়াতের অঙ্গুলি হেলনে চলতে বাধ্য। এখন জামায়াতের অঢেল অর্থ। তারা অনেক কিছুই নিয়ন্ত্রণ করছে।

বিয়াল্লিশ বছর ধরে বেশ আনন্দ আর উৎসাহভরে স্বাধীনতা দিবস পালন করছি আমরা। যে সব দেশের স্বাধীনতা দিবস আছে সে সব দেশের জন্য এ দিন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আর অন্যদেশেও সেসব দেশের স্বাধীনতা দিবস বেশ গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে আমার একটি অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে চাই।

১৯৭৬ সালে আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বৃত্তি নিয়ে প্রথম সে দেশে লেখাপড়া করতে যাই। আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি ছাত্ররা আমাকে বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের সভাপতি মনোনীত করল। এল ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। আমার বৃত্তি-প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানকে জানালাম আমরা বেশ ঘটা করে দিনটি পালন করতে চাই। তারা জানতে চাইলেন আমাদের কী কী লাগবে। জানালাম একটি বড় বাংলাদেশি পতাকা এবং আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বাজানোর জন্য একটি ব্রাস ব্যান্ড। খাওয়া-দাওয়া তো আছেই। পরদিন জানাল সবকিছু অনুষ্ঠানের দিন প্রস্তুত থাকবে।

তখন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এম আর সিদ্দিকী। তার কাছে আমি একটা ব্যক্তিগত চিঠি লিখলাম এবং আমাদের অনুষ্ঠান সম্পর্কে অবহিত করলাম। আমন্ত্রণ জানাতে ভুল হল না। কয়েকদিন পর তিনি আমাদের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি বার্তা পাঠালেন আর পাঠালেন ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে প্রকাশিত প্রায় একশত কপি নিউজ লেটার।

সবচেয়ে অবাক করা ঘটনাটি ঘটল ২৬ মার্চ। ইউএস নেভীর দুটি ট্রাকে করে একেবারে ইউনিফরম পরিহিত প্রায় বিশজনের একটি ব্রাস ব্যান্ড দল। জানলাম, এরা সবাই বিশ্ববিখ্যাত সপ্তম নৌবহরের ব্যান্ড দল। আমাদের সে কী আনন্দ! এ সপ্তম নৌবহরের জাহাজ ১৯৭১ সালে বঙ্গোপসাগরে গিয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনিকে সহায়তা করতে। আজ তারা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত বাজাবে!

সকাল আটটায় আমি বাংলাদেশের ইয়া বিশাল আকৃতির পতাকা উড়ালাম। কয়েক সেকেন্ড পর আমাদের সেন্টারের প্রেসিডেন্ট যুক্তরাষ্ট্রের পতাকা উড়ালেন। সঙ্গে প্রথম বাজল 'আমার সোনার বাংলা'। তারপর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সঙ্গীত। শেষে মার্কিন নৌসেনা বাদকরা পতাকা দুটিকে স্যালুট দিল। এ মুহূর্তে সে সময়ের অনুভূতির কথা জানানো সম্ভব নয়। শুধু এটা বলতে পারি যে, তখন আমার চোখ ফেটে পানি এসেছিল। এ পতাকা আর এ দিনটির জন্যই তো আমার প্রজন্মের মানুষ দেশকে শত্রুমুক্ত করতে যুদ্ধে গিয়েছিল।

এতদিন পর ঠিক একই দিনে, যেদিন আমরা হানাদার বাহিনিকে বাংলাদেশ থেকে চিরদিনের জন্য উৎখাত করতে যুদ্ধে গিয়েছিলাম– সে বাহিনির বশংদবদরা বিয়াল্লিশ বছর পর আবার আমাদের এ পবিত্র বাংলাদেশে ফিরে এসেছে, বেশ বীরদর্পে এবং তাদের সহায়তা দিচ্ছে দেশের প্রধান বিরোধী দল। কারণ যে কোনো উপায়ে হোক তাদের ক্ষমতায় যেতে হবে।

জামায়াত-বিএনপি মার্চের ২৭ আর ২৮ তারিখ হরতাল ডেকেছিল। বিএনপি দাবি করে তাদের প্রতিষ্ঠাতা জিয়া ২৭ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল। হাস্যকর ব্যাপার হচ্ছে যে, যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ, সুতরাং জিয়াকে ২৬ মার্চই স্বাধীনতা ঘোষণা করতে হবে। বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তারা বইপুস্তকে ২৭ তারিখের পরিবর্তে জিয়াকে দিয়ে ২৬ তারিখ স্বাধীনতা ঘোষণা করালেন। এমন একটি বালখিল্য দাবি জিয়া তার জীবদ্দশায় কখনও করেননি। যেহেতু আমি সে সময় চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলাম এবং সব ঘটনার সাক্ষী ছিলাম- সেহেতু এটি বলতে পারি যে, জিয়া ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠকারী অষ্টম ব্যক্তি এবং তিনি তা পাঠ করেছিলেন বঙ্গবন্ধুর নামে।

ভেবেছিলাম বিএনপি অন্তত ২৭ তারিখ হরতাল ডাকবে না। না, তারা কোনো কিছুই মানতে নারাজ। জিয়া এখন তাদের কাছে এমন কোনো মুখ্য চরিত্র নন। তাদের কাছে তাদের নেত্রী বেগম জিয়া এবং তাঁর পুত্র তারেক জিয়াই প্রধান গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। সুতরাং তাদের ইচ্ছায় কর্ম। ঘোষিত হল ২৭ তারিখে হরতাল। সাধারণত হরতালের আগের দিন সন্ধ্যা থেকে জামায়াত-বিএনপি জোট গাড়ি আর মানুষ পোড়ানো শুরু করে। এবার স্বাধীনতা দিবসের উপহার হিসেবে তারা এ কর্মটি শুরু করল বেলা সাড়ে এগারটায় সায়েন্স ল্যাবরেটরির মোড়ে একটি যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে। বিকেল পর্যন্ত আটটি গাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে এবং ঝটিকা মিছিল করেছে।

এমন একটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক ঘটনা দেশের মানুষ এর আগে কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। আমার বাসার কাছে দুর্বৃত্তরা একটা বাসে আগুন দিল। বাংলা একাডেমিতে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আমার একক বক্তৃতা ছিল। নিজের গাড়ি নিতে সাহস পেলাম না। তিন চাকার যানই ভরসা। যেতে যেতে নিজেকে প্রশ্ন করি- এ জন্যই কি আমরা দেশ স্বাধীন করেছিলাম?

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগস্ট। ১৯৭১ সালে আমাদের নৌ কমান্ডোরা ঠিক করেছিল ঠিক ওইদিন তারা চট্টগ্রাম বন্দরে আঘাত করবে। পরিকল্পনা করা হল অপারেশন জ্যাকপট। কর্ণফুলীর অপর পার থেকে নৌ কমান্ডোরা খরস্রোতা নদী সাঁতরে রাতের অন্ধকার ভেদ করে এ পারে এসে জাহাজে মাইন লাগিয়ে ফিরে যাবে। বুকে কয়েক কেজি ওজনের মাইন গামছা দিয়ে বেঁধে নদী সাঁতরে এ পারে এসে কাজটা করে ওপারে ফিরে গিয়েছিল। কিছু সময় পর প্রচণ্ড বিষ্ফোরণে ছয়টি জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হল। পাকিস্তানিদের তাদের স্বাধীনতা দিবস পালন মাটি করে দিয়েছিল আমাদের নৌ কমান্ডোরা।

তাই কি অনেকটা প্রতিশোধমূলক কাজ করেছে এ বছর পাকিস্তানের এদেশীয় দোসররা? কারণ তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস স্বীকার করে না যেভাবে কাশ্মীরের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী ভারতের স্বাধীনতা দিবস স্বীকার করে না। তারা প্রতি বছর ভারতের স্বাধীনতা দিবসে কাশ্মীরে বোমা ফাটায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনির সঙ্গে যুদ্ধ করে, অনেক হতাহত হয় । এটি এখন ওপেন সিক্রেট যে, তাদের এ সব কাজে প্রত্যক্ষভাবে ইন্ধন যোগায় পাকিস্তানের আইএসআই।

বাংলাদেশেও বহুদিন ধরে বিরোধী দলীয় ঐক্যজোটের কোনো কোনো শরিক দলকে আইএসআই ইন্ধন যোগায় বলে অনেকের বিশ্বাস। সুতরাং এবারের স্বাধীনতা দিবসটি যে নির্বিঘ্নে উদযাপন করা গেল না, জাতির জন্য এটা বিশাল এক ট্র্যাজেডি।

দ্বিতীয় আরও একটি কারণে তেতাল্লিশতম স্বাধীনতা দিবসটি যেমন হওয়া উচিত ছিল তেমন হয়নি। এ বছর দেশের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের সব মানুষ জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা ৫ ফেব্রুয়ারি এ দাবিতে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চে আন্দোলন করছে। তাদের প্রত্যাশা ছিল, এ সময়ের মধ্যে সরকার জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করবে। কিন্তু এ ব্যাপারে সরকারের নির্লিপ্ততা সবাইকে হতাশ করেছে। গণজাগরণ মঞ্চের তরুণরা তাদের ক্ষোভের কথা দেশের মানুষকে জানিয়েছে। এমনটি হওয়ার কথা ছিল না। অবস্থা এমন চলতে থাকলে সামনের বার হয়তো আমাদের মহান বিজয় দিবসটিও ছিনতাই হযে যাবে!

তাই দেশের মানুষ এবং সরকারকেই ঠিক করতে হবে আমরা একাত্তরের বাংলাদেশ চাই, না পাকিস্তান-মার্কা বাংলাদেশ চাই।