বিবেক জাগ্রত করুন

নুজহাত চৌধুরী
Published : 26 March 2013, 02:36 PM
Updated : 26 March 2013, 02:36 PM

বিয়াল্লিশটি বছর ধরে শহীদ পরিবারগুলো আপনজনদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ঘুরছেন পথে পথে। এ আশা শুধু ক্ষীণ ছিল এতকাল, এ কথা বললে কম বলা হবে। যাদের পঁচাত্তর-পরবর্তী কালো দিনগুলোর কথা মনে নেই তাদের কাছে শুধু আমার পরিচয় দিয়ে আমার বাবার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বলি। এরপর নিজের বিবেক দিয়ে আপনারা নিজেই বিচার করে নেবেন পঁচাত্তর-পরবর্তী সামরিক শাসন অথবা গণতন্ত্রের চাদরে ঢাকা সামরিক শাসনকাল কেমন ছিল।

আমার বাবা শহীদ ডা. আবদুল আলীম চৌধুরী ছিলেন একজন শীর্ষস্থানীয় চক্ষু চিকিৎসক। একই সঙ্গে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তাঁর ছিল সচ্ছন্দ বিচরণ। তিনি ভাষাসৈনিকও ছিলেন। তিনি ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়নের সহ-সভাপতি ছিলেন। ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের ভূমিকা ছিল নেতৃস্থানীয়। তিনি তখন ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।

ছাত্রাবস্থাতেই তিনি 'যাত্রিক' ও 'খাপছাড়া' নামে দুটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। প্রগতিশীল বাম রাজনৈতিক দীক্ষা নেন জীবনের শুরুতেই। জমিদারপুত্র হয়েও শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের জন্য তিনি সারাজীবন সংগ্রাম করে গেছেন।

বাবাকে চেনার আমার সুযোগ হয়নি। খন্দকার ইলিয়াসের বইয়ের সূত্রে জেনেছি যে, ষাটের দশকে বিলেত থেকে ফেরত আসার পর বাবার চেম্বারটি হয়ে ওঠে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী রাজনীতিবিদদের গোপন মিটিংএর জায়গা। খন্দকার ইলিয়াস বাবাকে বলেছেন, 'নেপথ্যের মানুষ'। ১৯৭১এ অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন, তখন বাবাকে বলা হয়েছিল চলে যেতে। তিনি রাজি হননি। বলেছিলেন, 'দেশের ভিতর অনেক কাজ, সবাই দেশ ছেড়ে চলে গেলে এই কাজগুলো কে করবে?'

মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার, ওষুধ সংগ্রহ বিতরণের মতো চিকিৎসা-সংক্রান্ত কাজ ছাড়াও মুক্তিযুদ্ধের অনেক গোপন কাজের সঙ্গে তিনি সংযুক্ত ছিলেন বলেও আমরা জেনেছি।

একটি ঘটনা বিধৃত করলে বোঝা যাবে আমার বাবা কেমন মানুষ ছিলেন। তখন ১৯৭২ সাল। আমার ছোট মামা বাসা থেকে বের হয়ে দেখেন এক রিক্সাওয়ালা তার রিক্সা নিয়ে বাসার গেটে বসে আছেন। মামা তাকে চলে যেতে বললেন; বললেন, এখন রিক্সা লাগবে না। মামা দেখলেন, রিক্সাওয়ালা অঝোর ধারায় কাঁদছেন। তিনি বললেন, "আমি তো ভাড়ার জন্য আসি নাই। আমি এসেছি স্যারের বাড়িটা দেখতে। রাজাকাররা আমার মতো ১০০টা লোক মেরে স্যারের মতো ১টা লোককে বাঁচিয়ে রাখত!"

এমন মানুষ ছিলেন আমার বাবা! আমি গর্বিত তাঁর মেয়ে বলে।

বাবার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল কুখ্যাত রাজাকার, তথাকথিত 'মওলানা' মান্নান। সে আমার বাবার আশ্রিত ছিল। আশ্রয়দাতার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে তার বিবেকে বাধেনি। ১৮ ডিসেম্বর যখন সে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়, তখন সে নিজ মুখে স্বীকার করেছিল যে, তার আলবদর ছাত্ররা ডা. আলীম চৌধুরীকে ধরে নিয়ে গেছে।

এই খুনি পরবর্তীতে 'ইনকিলাব' পত্রিকার মালিক হয়। পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর খুনি মান্নান জিয়ার শাসনামলে প্রতিমন্ত্রী ও এরশাদের সময় পূর্ণমন্ত্রী হয়। আমার বাবার রক্তে ভেজা ঐ পতাকা পতপত করে ওড়ে ঐ খুনির গাড়িতে। বলুন আমাকে, এ লজ্জা কার? আপনাদের বিবেকের কাছে জিজ্ঞেস করুন, এই কি প্রাপ্য ছিল এক শহীদের, শহীদসন্তানের অথবা ঐ পবিত্র পতাকার? জাতীয় পতাকার এহেন অপমান করার অধিকার কোনো শাসকের আছে কি?

শুধু সামরিক শাসক জিয়া-এরশাদ নয়, পরবর্তীতে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেত্রী খালেদা জিয়াও তুলে দিয়েছিলেন রাজাকার নিজামী, রাজাকার মুজাহিদ, রাজাকার সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর গাড়িতে এদেশের পতাকা। গাড়িতে বসে সে হায়েনারা যে অট্টহাসি হেসেছে তা কি আপনারা শুনতে পান? রাজনৈতিক স্বার্থে কানে তালা দেওয়া নেতারা হয়তো পান না, কিন্তু যারা তাদের সমর্থক-কর্মী তাদের জিজ্ঞেস করি, ব্যক্তি বা দলের উর্ধ্বে নিশ্চয়ই আপনার কাছে দেশ প্রিয়, তাহলে আপনাদের হৃদয়ে এ আঘাত কেন বাজে না? পতাকার অবমাননায় আপনাদের অপমান হয় না?

এ কথাগুলো বললেই প্রধান বিরোধী দলের সমর্থকরা বলবেন, সরকারি দলেও রাজাকার আছে, ঘরেও রাজাকার আছে। তাদের বলি, আওয়ামী লীগ-বিএনপি কারও অধিকার নেই শহীদের রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার। এক দল করছে বলে অন্য দলও করবে তার কোনো যুক্তি নেই। আওয়ামী লীগে যে রাজাকাররা আছে বলছেন, তারা কি নিজামীর মতো শীর্ষস্থানীয় আলবদরের সংগঠক? মুজাহিদ বা সাকা চৌধুরীর মতো নিজ হাতে খুন করার অপরাধে অপরাধী? মানবতাবিরোধী অপরাধের সংজ্ঞার মধ্যে হত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগ ও জানমালের ক্ষতির কথা বলা হয়েছে– তারা কি তা করেছে? সে ৫টি অপরাধ অনুযায়ী তারা কি মানবতাবিরোধী অপরাধে অপরাধী?

যদি হয় তবে আপনাদের আহ্বান জানাই আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করুন, অপরাধ প্রমাণ হোক, অবশ্যই তাদেরও শাস্তি হতে হবে। আর যদি তা না হয়, শুধু শুধু জল ঘোলা করবেন না। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে 'কিন্তু' 'তবে' যথেষ্ট করেছেন। আর নয়।

মনে রাখবেন, আওয়ামী লীগকে ঘায়েল করতে গিয়ে লাথি মারছেন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়ায়। লাথি মারছেন শহীদ পরিবারগুলোর বুকে। দুই দলের এই ফুটবল খেলায় বল যেন আমাদের এই পিতৃহত্যার বিচার চাওয়ার ইস্যুটা। একে অন্যকে ঘায়েল করতে লাথি মারছেন আমাদের। মাঝখানে দর্শকের সারিতে বসে তালি দিচ্ছে জামাতসহ সকল মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তি।

যারা আওয়ামী লীগের ঘরে রাজাকার রয়েছে, এই যুক্তিতে বিচার-প্রক্রিয়া বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই, এই সেদিন মাত্র আখাউড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোবারকের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করা হয়েছে। উল্লেখ্য যে, মোবারক ১৯৭১এ জামাতের রোকন থাকাকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে বলে অভিযুক্ত। সুতরাং কোনো যুদ্ধাপরাধী রং বদলে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিশে গেলেও যে সে তার একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের সম্মুখীন হওয়া থেকে রেহাই পেয়ে যাবে, এই যুক্তি ধোপে টিকে না।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে যে প্রসঙ্গটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন তোলা হয় তা হল, যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকারের বিষয়টি, বিশেষত আমাদের বিদেশি বন্ধুদের প্রায়শই এ প্রসঙ্গে বিচলিত থাকতে দেখা যায়। যারা এই প্রশ্নটি করেন, তাদের আমি পাল্টা প্রশ্ন করতে চাই।

আপনাদের অন্তরে যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকার নিয়ে এত যে মায়া, তার কিছুটা অংশ কেন আমাদের জন্য নেই? একাত্তরের যে সকল ঘটনার জন্য এ বিচার, সেই বিচারের বাদী কে আর বিবাদী কে? কার মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার ছিল কে?

আমরা সকল শহীদ পরিবার, বীরাঙ্গনা ও ক্ষতিগ্রস্ত সকল পরিবার ছিলাম এই রাজাকার আলবদরদের মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার। বিচার পাওয়া আমাদের মানবাধিকার। মনে রাখবেন Justice Delayed is Justice Denied– আমরা শুধু যে বিচার পাইনি তা নয়, বিচার-প্রক্রিয়া বিলম্বিত হল বিয়াল্লিশ বছর, তা-ও একটি অবিচার।

যুদ্ধাপরাধীদের মানবাধিকারের বিষয়টি নিশ্চিত করার জন্যই এই ট্রাইব্যুনালে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা দেওয়া হচ্ছে বলে আইনজ্ঞরা মনে করেন। বিদেশি বন্ধুদের বলছি, খেয়াল করে দেখুন, একটি 'ফেয়ার ট্রায়াল'এর প্রশ্ন তুলে আপনারা শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি 'আন-ফেয়ার' হচ্ছেন কি না। দেশে যারা বলছেন বিচার মানবেন যদি বিচার-প্রক্রিয়া 'স্বচ্ছ' হয়, তাদের স্পষ্ট করে বলতে অনুরোধ জানাই, স্বচ্ছ বলতে আপনারা কী বোঝাচ্ছেন, বিচার-প্রক্রিয়ায় কী কী পরিবর্তন আনলে একে আপনাদের কাছে স্বচ্ছ মনে হবে?

একটি কথা স্পষ্ট করে বলতে চাই, এই ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের অপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া কারও কারও কাছে রাজনৈতিক ইস্যু, কারও কারও কাছে একটি বিচারিক প্রক্রিয়া, কারও কাছে শুধুই খবর। কিন্তু লক্ষ লক্ষ শহীদ পরিবারের কাছে এই বিচার তাদের অন্তর থেকে উৎসারিত প্রাণের দাবি। মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি, দয়া করে এ ভাব কেউ দেখাবেন না।

স্বজন-হত্যার বিচার সুষ্ঠু হোক এবং কখনও যেন কেউ এ বিচারকার্য প্রশ্নবিদ্ধ করতে না পারে, তা একজন শহীদ পরিবারের সদস্যের চেয়ে আন্তরিকভাবে আর কেউ চাইছেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। আপনাদের নিশ্চিত করতে চাই, শহীদ পরিবারগুলো সতর্ক সজাগ দৃষ্টি নিয়ে এ বিচারকার্য পর্যবেক্ষণ করছে। সেই সঙ্গে আপনাদেরকেও আহ্বান জানাচ্ছি, আমাদের সহযোগিতা করুন। ভুল-ক্রটি আছে মনে করলে তা সংশোধনে সহযোগিতা করুন। কিন্তু শুধু বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা করবেন না। এতে আমার আপনার কারও লাভ নেই, লাভ শুধুই অপরাধীর।

আমরা সাধারণ মানুষ বিএনপির অধঃপতন দেখতে চাই না। কারণ, তাহলে জামাত বা অতি ডানপন্থী দল উঠে আসবে প্রধান বিরোধী দলের স্থানে। বিরোধী দলের সমর্থকদের বলি, শুধু আওয়ামী লীগের দিকে সন্দেহের দৃষ্টি দিয়ে না দেখে, নিজের ঘরের দিকে তাকান যত্ন নিয়ে। জামাত সুকৌশলে বিএনপির মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক দলের ইমেজটি ধ্বংস করে দিচ্ছে না তো? খেয়াল করুন বিএনপির মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানসিকতার নেতাকর্মীরা দূরে সরে যাচ্ছে না তো?

নিন্দুকেরা বলে, বিএনপি এখন জামাতের 'বি' টিম হয়ে যাচ্ছে। মাঠ গরম করছে শিবিরকর্মী, ছাত্রদলের নেতা-কর্মী খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা এটা চাই না। এটা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য মঙ্গলজনক হতে পারে না।

আমরা এমন বাংলাদেশ চাই যেখানে সরকারি দল, বিরোধী দল, জনতা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হবে। তাদের রাজনৈতিক মত ও পথ ভিন্ন হতেই পারে, হওয়াই সুস্থ রাজনীতির লক্ষণ, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ব্যাপারে সকল দল থাকবে একমত। সকল দল চাইবে একটি মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে গড়া বাংলাদেশ– যার স্বপ্ন নিয়েই আমাদের স্বজনরা দিয়েছিলেন আত্মাহুতি এবং যে বাংলাদেশের স্বপ্নই শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমাদের মতো শহীদ-স্বজনদের জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার অনুপ্রেরণা যোগায়।