আমাদের মনোকষ্টের বোঝা

মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব.)
Published : 25 March 2013, 05:46 PM
Updated : 25 March 2013, 05:46 PM

এক.
ওয়াহেদ আলী ভূঁইয়া আমার দাদার ছোট ভাই অর্থাৎ দাদা। আমি গ্রামের ছেলে নই, গ্রামের সাথে কোনো যোগাযোগও নেই। যদিও এ কোনো গর্বের কথা নয়। মূলত পিতার কর্মস্থলে থাকার কারণেই এ হাল। আমার দাদা ছিলেন শিক্ষক। মেজাজে রাগী। ভারত বিভাগের পূর্ব থেকেই মুসলিম লীগ করতেন। মুসলমান রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টিতে তিনি সাধ্যমতো অবদান রাখেন। পাকিস্তানের পক্ষে একাত্তরে কোনো ভূমিকা তিনি রাখেননি। আমার পাঁচ দাদার বাড়ি একসাথে। একই উঠান । তিনি আমার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি। আমার আব্বা-আম্মাকে অসহনীয় অপমান করেছেন। বলেছেন, পাকিস্তানিরা আমার মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার কারণে ঘরে আগুন দিলে সব ঘরই ভষ্মীভূত হবে। ডিসেম্বরের ৯ কী ১০ তারিখ। আমরা সব মুক্তিযোদ্ধারা মুরাদনগর থানা এলাকায় জড়ো হয়েছি। কুমিল্লার পতন হয়েছে। ইব্রাহীম কাকা, আমার আব্বা যার কোলে পিঠে মানুষ আমাদের বাড়ির কামলা। একদিন ইব্রাহিম কাকা এসে হাজির। আমার দাদা ওয়াহেদ আলী ভূঁইয়া পাঠিয়েছেন ক'লাইন লিখে দিতে যে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না।

একাত্তরের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গণহত্যা শুরু করে তখন আমার অবস্থান ছিল বিহারী অধুষিত খূলনার খালিশপুরে পিপলস্ জুট মিলে। শুরু থেকে বেঁচে থাকার যুদ্ধ, বিশেষ করে বিহারীদের নৃশংসতা থেকে। ১৭ এপ্রিল যশোর শহরে দুইবার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে এবং দুইবার বিহারীদের হাতে ধরা পরি। বিহারীদের হাতে নির্যাতিত হইনি, নির্যাতিত হই পাকিস্তানিদের হাতে। যশোর থেকে ঢাকা আসার পথে ২৭ এপ্রিল আটক হই পাকিস্তানিদের হাতে গোয়ালন্দ ঘাটে। যেভাবে আব্বা-আম্বা, ভাই-বোনদের সামনে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে আমাকে নিগৃহীত করা হয় সে কষ্টের কথা মনে হলে আজো চোখ ভিজে যায়। ১৩ মে ত্রিপুরার বক্সনগর সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করি একা। কলমচোরা বিওপিতে আটক হই ভারতীয় বিএসএফ এর হাতে। আমার হাতের দুই কব্জি বাঁধা হলো, দুই বাহু বাঁধা হলে, দুই পায়ের গোড়ালি বাঁধা হলো। এবার দুই বাহু উল্টো করে দুই গোড়ালির সাথে বাঁধা হলো। কী ভয়ংকর এবং বিভৎস অবস্থা। আমি তখন ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ এইচএসসি পরীক্ষা। যিনি ধুতি আর হাতাওয়ালা গেঞ্জি পরা অবস্থায় কাপড়ের ইজি চেয়ারে বসে আমার শরীর বাঁধাবাঁধির তদারকি করছিলেন তিনি এখানকার কর্তাব্যক্তি সন্দেহ রইলো না। ভাঙা ভাঙা এবং অশুদ্ধ ইংরেজী উচ্চারণে কথা বলছিলেন তিনি। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে আমি পাকিস্তানি গুপ্তচর। যখন আমাকে বাঁধা হচ্ছে তখন তাকে আমি অনুরোধ করলাম টেক মি টু এনি অব দ্যা বাংলাদেশী পলিটিশিয়ান অর এনি অব দি বাংলাদেশী আর্মি অফিসার। ইফ দে আইডেন্টিফাই মি এজ এন এনিমি, গিভ মি এনি ডিসপোজাল। বাট ফর গড সেফ, প্লিজ ডোন্ট কিল মি লাইক দিস। জবাব এলো, পাকিস্তানিজ আর কিলিং ইওর প্যারেন্টস, কিলিং ইওর ব্রাদারস, রেপিং ইওর সিস্টারস; দে আর সেয়িং এবাউট আল্লাহ এন্ড ইউ আর অলসো সেয়িং এবাউট আল্লাহ। ফরগেট এবাউট আল্লাহ। ইওর আল্লাহ হেজ বিন প্রুভড টু বি রং। একাত্তরে ৯ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস অবরুদ্ধ করে বিকল্প পথে দাউদকান্দি পৌঁছে। বাস্তবিক অর্থে ৯ ডিসেম্বর কুমিল্লার পতন ঘটে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের অর্থাৎ ২নম্বর সেক্টরের সদর দফতর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের কুমিল্লা সেনানিবাসে প্রবেশ করতে দেয় না। তারা সেনানিবাস সংলগ্ন ইপিআর সেক্টর সদর দপ্তর কোটবাড়িতেও প্রবেশের অনুমতি দেয় না। আমরা আশ্রয় নেই কুমিল্লা শহরের কান্দিরপারে লাগোয়া নিউ হোস্টেলে। এদিকে ভারতীয়রা সেনানিবাস থেকে শত শত সামরিক ট্রাক বোঝাই করে পাকিস্তানিদের অস্ত্র, গোলাবারুদ সরঞ্জাম এবং যা কিছু অর্থকড়ি বিচারে মূল্যবান ও তদানিন্তন ভারতে দুর্লভ সব নিয়ে যাচ্ছে। এ পাচারকার্য করা হতো রাতের আঁধারে। যেহেতু সীমান্ত পথ কুমিল্লা শহরের মধ্য দিয়ে যায়। কুমিল্লা শহরের বহু মানুষ সে দৃশ্যের স্বাক্ষী। এমনি করে সব সেনানিবাস থেকে অস্ত্রও গোলাবারুদ নিয়ে যায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতীয়রা তা স্বীকারও করেছে। ঢাকা সেনানিবাস ও রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাস থেকে মোট পঁচিশ ট্রেন ভর্তি অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে যায়।

একথা গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে স্বীকার না করলে অকৃজ্ঞতা হবে যে ভারতের সর্বাত্মক সহযোগিতা ও সক্রিয় সমর্থন না পেলেও বাংলাদেশ স্বাধীন হতো। তবে যে সময়ে যেভাবে স্বাধীন হয়েছে তা অসম্ভব ছিল। তবে কূটনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে যে অসম্মান পেয়েছি তা বড় কষ্টের, বড় অপমানের। সেসব বিস্তারিতভাবে লিখে যাবার সময় এসেছে।

দুই
পাকিস্তানিদের কথা বলার প্রয়োজন বোধ করছি না। এরা মানুষ না, এগুলি ছিল ইতর। এদের মধ্যে যাদের মাঝে মানবতাবোধ ছিল তাদেরকে ফেরত নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানে। তাদের কাউকে কোর্ট মার্শালের মাধ্যমে বিচার (?) করে অসম্মানজনকভাবে চাকুরীচ্যুত করা হয়। এরা সামরিক বাহিনীর অফিসার হিসেবে যে প্রচন্ড প্রতিকূল অবস্থায় তাদের নৈতিকতা সমুন্নত রেখেছিল তা প্রবাদতুল্য। পাকিস্তানি বর্বর পশুদের এদেশীয় সহযোগীরা ছিল বর্বরতায় আরো এক কোটি সরেস। এই কীট পতজ্ঞগুলিকে নির্দয়ভাবে হত্যা না করে আমরা সেদিন মারাত্মক অন্যায় করেছিলাম।

এই বেজম্মাগুলি শান্তি কমিটি, রাজাকার, আল বদর, আল সামস নামে আবির্ভূত হয়। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কেন যে যিশুর মতো সব সহিষ্ণু হয়েছিলাম। আরেক কিছিম বজ্জাত ছিল একাত্তরে পাকিস্তানিদের সহযোগী বাঙালি চাকুরীজীবিরা।

তিন.
দেশ স্বাধীন হল। যারা গোটা একাত্তর পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রটিকে অখন্ড রাখার জন্য সর্বোপরি সরকারী, আধা-সরকারী, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার আমলা ছিলো তারা পদোন্নতি পেলেন এবং পেতেই থাকলেন। আমরা অস্ত্র জমা দিয়ে আক্ষরিক অর্থেই পথে দাঁড়িয়ে গেলাম। বাড়ি ফিরে যাবার দেড় টাকা বাস ভাড়াও নেই। সেই অধগতি অব্যাহত আজো।

পাকিস্তান মিলিটারী একাতেমী থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন ক্যাডেট ইমদাদ। একাত্তরের ৭ নভেম্বর সিলেটের ধামাই চা বাগান রেইড করেন জণযোদ্ধা এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের মিশ্রিত একটি দল নিয়ে। লান্স নায়েক তারু মিয়া তার পাশে। শত্রুর গুলিবৃষ্টির মধ্য দিয়ে এগুতে থাকেন ইমদাদ। তারু মিয়া বলে, স্যার, আর এগুবেন না, গুলি লাগবে । ইমদাদ জবাব দেন, তারু, আমরা তো আমাদের জন্য যুদ্ধ করছি না। আমরা যুদ্ধ করছি আমাদের সন্তানদের জন্য। ইমদাদের কথা শেষ হতেই এক বাস্ট গুলি লাগে তার বাম বুকে। একটি তার বাম হাতের ঘাড়ির চামড়ার বেল্ট ছিদ্র করে ডায়াল ফুটো করে বের হয়ে যায়।

বেয়াল্লিশ বছর কেটে গেল স্বাধীন বাংলাদেশের। বেওয়ারিশ হয়ে পড়ে আছি আমরা। আহার নেই, ঠিকুজিও নেই। বিনিময় চাই না, সম্মান চাইনা, কিন্তু স্বীকৃতিটুকুও পাই না। জীবদ্দশায় উদাম গতরে বসে আছি, মরার পর জাতীয় পতাকা দ্বারা আচ্ছাদিত হবো সে আশায়। এতো অবহেলা, এতো অবজ্ঞা, এতো অসম্মান।

২৪ মার্চ ২০১৩ মুঠোফোনে বার্তা এসেছে শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের মুখপাত্রের কাছ থেকে। ৪২তম জাতীয় ও স্বাধীনতা দিবস উৎসর্গ করা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে। আমন্ত্রণ করা হয়েছে ২৬ মার্চ বিকেল সাড়ে চারটায় শহবাগ যাবার। ইনশাল্লাহ যাবো। চলৎশক্তি এবং দৃষ্টিশক্তি দুইই শেষ প্রান্তে। ফেরত আসার আগে আমাদের সন্তানদের জিজ্ঞাসা করে আসবো, আমরা তোমাদের পিতৃপুরুষরা বিজাতীয় শত্রু ও দেশীয় কুলাঙ্গারদের বিরুদ্ধে লড়লাম এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। তোমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেলাম। আমাদের স্বরণ করতে তোমাদের বেয়াল্লিশ বছর লাগলো কেন?

আমাদের মনোকষ্টের বোঝাটি কি আমাদের কবরে নিয়ে যেতে হবে?

মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া(অব.): মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক লেখক এবং 'সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ'-এর চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক।