ইরান-পাকিস্তান গ্যাসলাইনের রাজনীতি ও অর্থনীতি

নাদিরা মজুমদার
Published : 23 March 2013, 03:12 PM
Updated : 23 March 2013, 03:12 PM

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আহমাদিনেজাদ ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলি জারদারির হাসিমাখা করমর্দনের ছবিটি গোটা বিশ্বের খবরের জগতে তোলপাড় তুলেছে। আর এ থেকেই গুরুত্বের ঘনত্বটা সহজে অনুমান করা যায়। ২০১৩ সালের ১১ মার্চ দু'দেশের দুই প্রধান পাকিস্তান অংশে গ্যাসের পাইপলাইন বসানোর কাজটির উদ্বোধন করেন। তখনই তোলা হয়েছে ছবিটা।

ইরান থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে গ্যাস পাইপলাইনের দৈর্ঘ্য ১৬০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ইরান তার ভাগের ৮২০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন নির্মাণ শেষ করে বেলুচিস্তানের সীমান্তে চলে এসেছে; পাকিস্তানকে তার ভাগের ৭৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ লাইন বসানোর কাজ শুরু করতে হচ্ছে। পাইপলাইন বসানো সম্পূর্ণ হলে ইরানের গ্যাস করাচিতে তো বটেই, উত্তরে সুদূর ইসলামাবাদেও পাওয়া যাবে। দু'দেশের জন্য এ লাইনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ছাড়াও বাড়তি ভূ-রাজনীতির মাত্রাও রয়েছে।

প্রথমে গ্যাস পাইপলাইন প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রাথমিকভাবে পাইপলাইন বসিয়ে ইরানের গ্যাস ভারতে সরবরাহের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয় গত শতকের নব্বইয়ের দশকে। পাইপলাইন পাকিস্তানের উপর দিয়ে ভারতে যাচ্ছে; তাই ক্রেতার তালিকায় পাকিস্তানও চলে আসে। ১৯৯৪ সালে আলোচনাটি পাকাপোক্ত হয়ে যায়। প্রজেক্টের নাম হয় শান্তি-পাইপলাইন। কিন্তু প্রজেক্টের প্রধান শরীক ভারত ২০০৯ সালে শক্তি-পাইপলাইন থেকে সরে দাঁড়ায়।

অবশ্য এটি আত্মাহুতির সিদ্ধান্ত ছিল না। ভারত পারমাণবিক বিস্তার নিয়ন্ত্রণ চুক্তির সদস্য নয়; তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র আগ্রহ দেখালে তাই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পারমাণবিক বিষয়ক চুক্তি সইয়ের প্রস্তাবটি প্রতিহত করার মতো ক্ষমতা তার ছিল না। চুক্তি সইয়ের বছর খানেক বাদে ভারত প্রজেক্ট থেকে সরে আসে। তবে ইরানের তেল কেনা ভারত অব্যাহত রেখেছে, ভবিষ্যতেও রাখবে বলে আশা করা যায়।

ভারত সরে যাওয়াতে এবং শান্তি-পাইপলাইন বসানোর কথা আগেও কমপক্ষে দশ কী পনেরোবার শোনা গেলেও, সবাই যখন প্রায় ধরেই নিয়েছে যে প্রজেক্টটি মৃত, ১১ই র্মাচ বলছে যে না, মৃত নয়। ইরান ও পাকিস্তানের মধ্যে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধনের ইতিহাস দীর্ঘ হলেও, বিশ্বরাজনীতির মাঠে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের পুরানো বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর অন্যতম। তবে রাজনৈতিক স্বার্থ-মিটারের ওঠানামার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সহৃদয়তার ওঠানামাও দেখা যায়। বলা হয়, পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। অবশ্য আর্থিক সাহায্যের সামান্য অংশেরই ব্যয়-ব্যবস্থা হয়ে আসে জনকল্যাণ কাজে।

এ পাইপলাইন স্থাপনের সঙ্গে আপাতদৃষ্টে রাজনৈতিক স্বার্থ-মিটারের অনুগামিতার কিছুটা যোগসূত্র থাকলেও, জ্বালানি-ক্ষুধার্ত পাকিস্তানে এখন যে দুটি সমস্যা সবচেয়ে প্রবল, তার প্রথমটিতেই রয়েছে জ্বালানির দুষ্প্রাপ্যতা; এবং এ কারণে ক্ষিপ্ত জনতার মারপিটও হয়ে গেছে। দুই, ব্যাপক র্কমহীনতা। মূলত, এ দুটি কারণে জনসাধারণ ভীষণ ক্ষেপে রয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী ব্ল্যাকআউট কেউ আর মেনে নিতে রাজি নয়।

জ্বালানি-সঙ্কটের এ ক্রনিক অবস্থার নিরাময়ে পাকিস্তানের জন্য পাইপলাইন-প্রজেক্টটি অনেক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। ৭৮০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনটি দেড়-দুই বছরের মধ্যে বসাতে পারলে পাকিস্তানের জ্বালানি-সঙ্কটের সুরাহা হবে। তবে পাইপলাইন বসাতে খরচ পড়বে দেড় বিলিয়ন ডলার। পাকিস্তানের কাছে এত টাকা নেই। ইরান তাই ৫০০ মিলিয়ন ডলার দিতে রাজি হয়েছে। আয়োজন দেখে মনে হচ্ছে যে পাইপলাইন হয়তো শেষ পর্যন্ত বসানো হবে। কিন্তু বিষয়টি তাদের পুরনো বন্ধু যুক্তরাষ্ট্রের মোটেই পছন্দ হচ্ছে না।

কারণ, ইরানের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউয়িনের আরোপিত নিষেধাজ্ঞার প্রসঙ্গটি চলে আসছে বারবার। পাইপলাইন বসানো হলে ইরান আরও বেশি পরিমাণে গ্যাস বিক্রি করতে পারবে; ফলে, চাপসৃষ্টি করে পারমাণবিক কর্মকাণ্ড থেকে তেহরানকে বিরত রাখা যাবে না। আন্তর্জাতিক শক্তি এজেন্সির মূল্যায়ন অনুযায়ী, নিষেধাজ্ঞার দরুণ ২০১২ সালে তেল বিক্রি করতে না পারায় ইরানের ক্ষতির পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলার, এবং ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে তেল-উৎপাদন গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন মাত্রায় চলে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রকে অগ্রাহ্য করে পাইপলাইন বসানো পাকিস্তানের জন্য ঠিক কাজ হবে কিনা সে প্রশ্নটিও সামনে চলে এসেছে। এ খবরে যুক্তরাষ্ট্র যে কতটা অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে, বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ভিক্টোরিয়া নাল্যান্ডের বক্তব্যে তা আরও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে, "প্রস্তাবিত ইরান-পাকিস্তান পাইপলাইন যদি বাস্তবিকই চূড়ান্ত হয়ে থাকে, তবে তা ইরান স্যাঙ্কশনস আইনের উপর গুরুত্বপূর্ণ পরিণাম ডেকে আনবে।''

পাকিস্তানের প্রতি কড়া হুঁশিয়ারি এটি। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, জ্বালানি-সঙ্কট উপশমের আরও অনেক উপায় পাকিস্তানের রয়েছে। যেমন, মধ্য এশিয়ার দেশ তুর্কমেনিস্তানের গ্যাস কেনার পরিকল্পনা যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র সে লক্ষ্যে আলোচনাও চালিয়ে যাচ্ছে। আলোচনা সফল হলে, বিকল্প সমাধান হিসেবে পাকিস্তান তুর্কমেনিস্তান-আফগানিস্তান-পাকিস্তান-ভারত (সংক্ষেপে টিএপিআই বা টাপি) পাইপলাইনের সুযোগ নিতে পারবে।

তবে টাপি ২০১৮ সালের আগে আদৌ কার্যকর হবে কিনা বলা কঠিন। কিন্তু পাকিস্তানের এখনই গ্যাস প্রয়োজন। তাছাড়া ওদের যা প্রয়োজন, টাপি সে পরিমাণ গ্যাস দিতে পারবে না। অপরদিকে শান্তি-পাইপলাইন ২০১৫ সালের মাঝামাঝি সময় থেকেই প্রতিদিন ২১.৫ কিউবিক মিটার গ্যাস সরবরাহ করতে সক্ষম হবে। এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশজুড়ে ব্ল্যাক-আউটের জন্য বেলুচিস্তানের পাওয়ার-হাউসের যান্ত্রিক ত্রুটিকে দায়ী করা হলেও, এক নম্বর জাতীয় সমস্যা হিসেবে জ্বালানি থেকে 'সঙ্কট' শব্দটি ঘুচে যায়নি, রয়েই গেছে।

পাকিস্তানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রিচার্ড ওলসেন অভিজ্ঞ কূটনীতিক; ইসলামাবাদকে টলানোর জন্য সাধ্যাতীত সবই করেছেন তিনি; সাংবাদিকদের ডেকে বলেছেন যে পাকিস্তানের জলবিদ্যুত কেন্দ্রগুলোকে সংস্কারের কাজে যুক্তরাষ্ট্র কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছে বা করবে। এগুলো থেকে পাকিস্তান বছরের শেষ নাগাদ বাড়তি ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাবে।

তবে তাতে জ্বালানি-সঙ্কটের মাত্র ২০ শতাংশের সুরাহা হবে। জ্বালানির বিকল্প প্রস্তাব ছাড়াও, নিরাপত্তাহীনতার বিপুল ঝুঁকির প্রসঙ্গ গুরুত্ব পাচ্ছে। কারণ, শান্তি-পাইপলাইনের রুট বেলুচিস্তানের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এবং সেখানে স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিতে বিচ্ছিন্নবাদীরা নিয়ত যুদ্ধরত রয়েছে। কাজেই পাইপলাইন হলে, সেটিও তাদের সহজ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে। তবে পাইপলাইনের সার্থক প্রতিযোগী যদি টাপি না-ও হয় বা, নিরাপত্তাহীনতার বিষয়টি তার ক্ষেত্রেও কম জটিল নয়, হয়তোবা একটু বেশিই হবে। টাপির পাইপলাইন একাধিক নিরাপত্তাবিহীন দেশের মধ্য দিয়ে যাবে, এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত জটিলতার মীমাংসা না হওয়া পর্যন্ত টাপি-প্রজেক্ট ড্রইং বোর্ডেই আটকে থাকবে।

পাশ্চাত্য জগতের নিষেধাজ্ঞার চাপে কোণঠাসা ইরানের জন্য যেমন, তেমনি জ্বালানি সঙ্কটে জর্জরিত ইসলামাবাদের জন্যও পাইপলাইন-প্রজেক্ট, দু'দেশের পুষ্টিহীন অর্থনৈতিক ন্যূনতায় পুষ্টি প্রবৃদ্ধির শক্তি এনে দেবে, সন্দেহ নেই। কারও কারও মতে, ওয়াশিংটন ও ওবামা প্রশাসন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বকে যখন-তখন যেভাবে লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, পাকিস্তানের ভেতরে ড্রোনের অনুমতিহীন চুপিসার প্রবেশ ও বোমাবর্ষণে নিরীহ মানুষের আহত ও নিহত হওয়া জনগণের বিরাট অংশকে মার্কিন-বিরোধী সুরে বেঁধে দিয়েছে, পাকিস্তানের প্রতি সে ব্যবহার প্রতিহতের অস্পষ্ট বাহনও পাইপলাইন-প্রজেক্ট। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গ্রহণযোগ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে জারদারিকে বর্তমানে অতি সূক্ষ্ম সূতোর ওপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে।

ইরান-পাকিস্তান পাইপলাইন-প্রজেক্টের একাধিক মাত্রার আরেকটি ইতিবাচক মাত্রা হল যে শিয়া-মুসলিম অধ্যুষিত ইরান ও সুন্নী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ পাকিস্তান শত্রুতার বদলে বন্ধুত্ব বেছে নিয়েছে। পাইপলাইন, দুই ভিন্ন ধর্মভিত্তিক উপদল সম্প্রদায়ের মধ্যে সেতুর কাজ করছে। কারণ জ্বালানি সম্পদে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়াসহ সর্বত্র বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক উপদলীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যকে কৌশল বা স্ট্র্যাটিজি হিসেবে দেশের অভ্যন্তরেই ব্যবহার করা হচ্ছে, গত প্রায় একশো বছর ধরে।

এর ফল কী হচ্ছে সেটি নোবেল শান্তি পুরষ্কার জয়ী ডেসমন্ড টুটুর ভাষায় প্রকাশ পায়। শান্তি পুরষ্কারপ্রাপ্তির পর নিউ ইয়র্কের এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ''সাদা ইউরোপীয়রা এদেশে (দক্ষিণ আফ্রিকায়) এলেন, হাতে তাদের বাইবেল। আমাদের বললেন, বাইবেল পড়। আমরা পড়তে লাগলাম, চোখ বন্ধ করে। যখন চোখ খুললাম, তখন দেখি ওদের বাইবেল আমাদের হাতে, আমাদের জমি ওদের হাতে।''

জ্বালানি সম্পদের ক্ষেত্রে, অবস্থাটি সামান্য অন্যরকম, ফাইনাল রেজাল্ট একই; স্থানীয় পর্যায়ে বিভিন্ন উপদলীয় পার্থক্যভিত্তিক হানাহানিতে আর সহিংসতায় সব জাতি যখন ক্ষতবিক্ষত, তখন জ্বালানি সম্পদ– তা সে ব্রিটিশ, ফরাসি, ইতালীয়, ডাচ এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছে। ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের কৌশলবিদ ও পরিচালক ইমরান আহমেদ খানের মতে, পাকিস্তানে অনেকেরই বিশ্বাস যে সম্প্রতি শিয়া সম্প্রদায়ের ওপর যে বড় ধরনের আক্রমণ পরিচালিত হয়, বিশেষ করে বেলুচিস্তানের কোয়েটা শহরে, সেটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল ভিনদেশি, এবং লক্ষ্য ছিল শিয়াপ্রধান ইরান যাতে পাইপলাইন প্রজেক্ট থেকে লাভবান না হয়, তা বানচাল করে দেওয়া।

পাইপলাইন-প্রজেক্টের আরেকটি ইতিবাচক দিক প্রসঙ্গে বলতে গেলে চীনের কথা বারবার চলে আসছে। দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির জন্য চীনের জ্বালানির প্রয়োজন অপরিসীম। যদি শান্তি পাইপলাইন প্রজেক্ট ইসলামাবাদ পর্যন্ত যায়, তবে সীমান্ত অতিক্রম করে চীন পর্যন্ত প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কারণ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকা থেকে চীন যে জ্বালানি আমদানি করছে, সবটাই হচ্ছে জলপথে। পাইপলাইন চীনকে স্থলপথে আরব সাগর ও হরমুজ প্রণালীর সঙ্গে সংযোগ করে জ্বালানি ও বাণিজ্য করিডরের পথ করে দিচ্ছে।

পাকিস্তান তার গোয়াডর বন্দরকে আঞ্চলিক পর্যায়ে হাইড্রোকার্বনের (তথা গ্যাস, কয়লা, তেল ইত্যাদি) ট্রানজিট কেন্দ্রে পরিণত করতে ইচ্ছুক। ফেব্রুয়ারি মাসে চীনকে গোয়াডর বন্দরের ইজারা দেওয়ার কথা ঘোষণা করার সময় প্রেসিডেন্ট জারদারি বলেন যে, বন্দরটি "পাকিস্তান-চীন সম্পর্কে নতুন গতিশক্তি জোগাবে।" গ্যাস পাইপলাইন ও তেল শোধনাগার এ ভূমিকা নেবে।

আবার একই সময়ে একদিকে যেমন ইরান জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনকে সজিব করতে ব্যস্ত, অন্যদিকে পাকিস্তান রুশ ও চীনের নেতৃত্বাধীন সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্যপদের জন্য আগ্রহী। এমন পরিস্থিতিতে, পাইপলাইন বাড়তি ফ্যাক্টর হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জোট ও সংস্থার শক্তি ও প্রভাববৃদ্ধিতে সহায়তা করছে, এবং সে সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য, এশিয়া, দক্ষিণ এশিয়াসহ অন্যত্রও বিশ্ব শক্তি-সম্পর্কের রূপান্তরকর্মে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছে।

আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র পর্যায়ক্রমে জ্বালানি-সঙ্কট সমাধানের যে ব্লু-প্রিন্ট পাকিস্তানকে দিয়েছে, তা পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক সঙ্কট সমাধানে সক্ষম নয় বলে পাকিস্তানের তাতে আগ্রহ নেই। এমনকি নিষেধাজ্ঞার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে পাকিস্তানকে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ-সাহায্য ছাড়া পাকিস্তানের পক্ষে চলা প্রায় অসম্ভব, কিন্তু পাকিস্তান সে অর্থ-সাহায্য প্রায় কখনওই সময়মতো এবং প্রতিশ্রুত পরিমাণে পায় না।

ইরানকে নিয়ে পাইপলাইন বসানোর পাঁয়তারায় যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের উপর মহাখাপ্পা হলেও, আঞ্চলিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এ মুহুর্তে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব নয় বা চটানোও ঠিক হবে না। কারণ, আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর সামরিক সরবরাহের প্রধান রুট পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে গেছে। তাছাড়া, ২০১৪ সালের ডিসেম্বর মাসের আগেই যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোভুক্ত অন্যান্য দেশগুলোর সামরিক সরঞ্জামগুলোর নিরাপদ নির্গমনও হতে হবে পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে।

পাকিস্তান ছাড়া সম্ভব নয়, বা পাকিস্তানকেও পাইপলাইন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্র কি ভারতের মতো পাকিস্তানের সঙ্গেও পারমাণবিক চুক্তি করবে? আপাতদৃষ্টে মনে হয় না। তাতে ভারত মোটেই সায় দেবে না। তাছাড়াও, পাকিস্তানের পারমাণবিক বিজ্ঞানী আবদুল কাদির খান ১৯৯০-য়ের দশকে লিবিয়াকে পারমাণবিক প্রযুক্তি ও পদার্থ হস্তান্তর করেছিলেন বলে যুক্তরাষ্ট্র তাকে ধরার জন্য হন্যে হয়ে রয়েছে; ড. খান ইরানকেও সাহায্য করেছিলেন বলে ঘোর সন্দেহ করা হচ্ছে। তাকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি পাকিস্তান প্রত্যখ্যান করেছে অনেক আগেই।

জাপানসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে দশটি দেশকে যুক্তরাষ্ট্র ইরানি নিষেধাজ্ঞা আওতার বাইরে থাকার অনুমতি মঞ্জুর করেছিল, সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সে দেশ ক'টির মঞ্জুরি নবায়ন করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য অ-পেট্রোলিয়াম খাতে ইরানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন অব্যাহত রেখেছে। পুনঃমঞ্জুরি তালিকায় ভারতেরও অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। এ সুবাদে পাকিস্তানও কোনো মঞ্জুরি পাবে কিনা, কে জানে? হয়তো বলা যায় যে অভাবনীয় দুর্দৈব কিছু না ঘটলে, পাইপলাইন বসবে, দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে পাকিস্তানের তাৎক্ষণিক জ্বালানি-সঙ্কটের সমাধান হবে; ফলে, দেশটিতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাও আসতে বাধ্য।

নাদিরা মজুমদার : বিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক।