আমাদের অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম

এ. এম. হারুন-অর- রশিদ
Published : 18 March 2013, 08:37 AM
Updated : 18 March 2013, 08:37 AM

অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম ( জে. এন. ইসলাম ) – [ জন্ম – ফেব্রুয়ারী ২৪, ১৯৩৯ – -মৃত্যু – মার্চ ১৬, ২০১৩ ] বাংলাদেশর অন্যতম খ্যাতিমান গণিতবিদ, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, বিশ্বসৃষ্টিতাত্ত্বিক এবং অর্থনীতিবিদ। তিনি তাঁর বহুলপ্রচলিত দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স (১৯৮৩) গ্রন্থের জন্য দেশে ও বিদেশে বিপুলসংখ্যক বিজ্ঞানমনস্ক পাঠকের কাছে বিপুলভাবে পরিচিত এবং সমাদৃত। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ম্যাথেমেটিক্যাল আ্যন্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সের সঙ্গে গবেষক হিসেবে সংযুক্ত ছিলেন এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

দেশবরেণ্য অধ্যাপক ইসলাম জন্মগ্রহণ করেন ঝিনাইদহ শহরে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে যেখানে তাঁর পিতা ছিলেন বিচার বিভাগীয় একজন মুন্সেফ। কৈশোরে প্রথমে কোলকাতার মডেল স্কুলে, পরবর্তীতে কোলকাতারই শিশু বিদ্যাপীঠে তিনি চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষালাভ করে পুনরায় মডেল স্কুলে প্রত্যাবর্তন করেন। এর পর পরিবারের সঙ্গে চট্টগ্রামে এসে তিনি চট্টগ্রামের কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন যেখানে তাকে ডাবল প্রমোশন দিয়ে সরাসরি ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি করে নেয়া হয়। নবম শ্রেণী পর্যন্ত এই স্কুলে শিক্ষালাভ করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে গমণ করেন এবং সেখানকার লরেন্স কলেজে ভর্তি হন যেখান থেকে তিনি সিনিয়র কেমব্রিজ ও হায়ার সিনিয়র কেমব্রিজ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন যা বর্তমানে ও-লেভেল এবং এ-লেভেল পরীক্ষার সমতুল্য। লরেন্স কলেজের পাঠ সমাপ্ত করে তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে যোগদান করেন যেখান থেকে তিনি বি.এস.সি. সম্মান পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হন। এই কলেজের শিক্ষক ফাদার সোরে গণিতের জটিল বিষয়গুলি তাঁকে সহজেই বুঝিয়ে দিতেন বলে তিনি আজীবণ তাঁকে মনে রেখেছিলেন এবং তার ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন।

১৯৫৯ সালে জে. এন. ইসলাম কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে দ্বিতীয়বার স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন এবং এখান থেকেই মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন ১৯৬০ সালে।

জে. এন. ইসলাম ১৯৬৪ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায়োগিক গণিত ও তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পি. এইচ. ডি. ডিগ্রী লাভ করেন এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব সায়েন্স ডিগ্রীতে ভূষিত হন।


কর্মজীবনে জে. এন. ইসলাম ১৯৬৩ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত য়ুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ডক্টরাল ফেলো ছিলেন। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি কেমব্রিজের ইনস্টিটিউট অব থিওরেটিক্যাল অ্যাস্ট্রোনোমিতে কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ ও ১৯৭২ সালে তিনি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলোজিতে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালে তিনি লন্ডনের কিংগস কলেজে ফলিত গণিতের প্রভাষক, ১৯৭৫ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে সায়েন্স রিসার্চ ফেলো এবং ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত লন্ডনের সিটি ইউনিভার্সিটিত প্রথমে প্রভাষক ও পরে রিডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

১৯৬৮, ১৯৭৩ এবং ১৯৮৪ সালে তিনি য়ুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটনে ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৮৪ সালে জে. এন. ইসলাম দেশে প্রত্যাবর্তন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন এবং সেখানেই তিনি ইমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বিপুল সুনামের সঙ্গে বাংলাদেশকে সেবা করে গিয়েছেন।

অধ্যাপক জে. এন. ইসলামের প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো:

দ্য আল্টিমেট ফেইট অব দ্য ইউনিভার্স ( ১৯৮৩), কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। ফরাসী, পর্তুগীজ, যুগোস্লাভ ও জাপানি ভাষায় অনুদিত।
ক্লাসিকাল জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪)
রোটেটিং ফিল্ডস ইন জেনারেল রিলেটিভিটি (১৯৮৪) , কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস।
অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল কসমোলজি (১৯৯২) , কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস।
কৃষ্ণ-বিবর ( বাংলায়) – বাংলা একাডেমী হতে প্রকাশিত।
মাতৃভাষা, বিজ্ঞানচর্চা এবং অন্যান্য প্রবন্ধ – রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা।
শিক্ষা, সাহিত্য ও সমাজ – রাহাত-সিরাজ প্রকাশনা।
স্কাই অ্যান্ড টেলিস্কোপ – কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস। স্প্যানিশ ভাষায় অনুদিত।
ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স – এনডেভার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত

পুরস্কার ও সম্মাননা: জে. এন. ইসলাম ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী কর্তৃক স্বর্ণপদকে ভুষিত হন। ১৯৯৪ সালে তিনি জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পদক লাভ করেন। ১৯৯৮ সালে তিনি ইতালীর আব্দুস সালাম সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের থার্ড ওয়ার্ল্ড একাডেমীর লেকচার পদক লাভ করেন।তিনি ২০০০ সালে মাহবুবউল্লাহ অ্যান্ড জেবুন্নেছা পদক পান। বাংলাদেশ সরকার তাকে ২০০১ সালে একুশে পদকে ভুষিত করেন। ২০১০ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজ্জাক-শামসুন আজীবন সম্মাননা পদক লাভ করেন।

অধ্যাপক জে. এন. ইসলাম বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটি, রয়াল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি, কেমব্রিজ ফিলসফিকাল সোসাইটি, আব্দুস সালাম ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমী এবং এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সম্মানিত সদস্য ছিলেন।

অধ্যাপক জে. এন. ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা যায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেন্টার ফর ম্যাথেমেটিক্যাল আ্যন্ড ফিজিক্যাল সায়েন্সেস কেন্দ্রটি। সেখানে তিনি অত্যন্ত উচ্চমানের একটি আধুনিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আগত খ্যাতিমান পদার্থবিজ্ঞানী , আপেক্ষিকতত্ত্ববিদ এবং বিশ্বসৃষ্টিতাত্ত্বিকরা অনেক সময় কাটিয়ে গিয়েছেন এবং কেন্দ্রের ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে জ্ঞানের আদানপ্রদান করে বাংলাদেশের শিক্ষিত সমাজে জ্ঞানের ক্রমবর্ধমান পরিসীমা বৃদ্ধিতে অতি প্রয়োজনীয় অবদান রেখে গিয়েছেন।

অধ্যাপক জে. এন. ইসলামের সাথে আমার প্রথম পরিচয়ের দিনটির কথা আমার এখনও মনে পড়ে। আমি তখন কণাপদার্থবিজ্ঞানে বিখ্যাত মান্ডেলস্টাম প্রতিকায়ন ( Mandelstam Representation ) নিয়ে কাজ করছিলাম। এই প্রতিকায়নকে দৈত্ব বিচ্ছুরণ সম্পর্কও বলে (Double dispersion relation) । কাজটি ছিলো পায়ন-কণার ফটো-প্রোডাকশন প্রক্রিয়া নিয়ে ( দেখুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টাডিজ, ২২(১), পৃ: ১০৫-১১১, ১৯৭৫) । মজার ব্যাপার এই যে, এই কাজ করার সময়ে আমি জামাল নজরুল একটি প্রবন্ধের সঙ্গে পরিচিত হই যেখানে তিনি পায়ন-নিউক্লিয়ন বিচ্ছুরণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বর্ণালী আপেক্ষকের প্রান্তিক বক্ররেখার সীমা নির্ধারণ করেছিলেন। এই সীমানা জানা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কেননা তা বিচ্ছুরণ আপেক্ষকের প্রসারণের অভিসারী অঞ্চল নির্ধারণ করে। এভাবেই আমার জে. এন. ইসলামের সঙ্গে প্রথম পরিচয় যা আমি এখনও ভুলতে পারিনা।


অবশ্য জে. এন. ইসলাম অধিকতর পরিচিত তাঁর সাধারণ আপেক্ষিকতার এবং বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্বের ওপরে অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজের জন্য। রবীন্দ্রনাথের "সৃষ্টির রহস্য" শিরোনামে একটি কবিতা আছে যেখানে কবি বলেছেন:

সৃষ্টির রহস্য আমি তোমাতে করেছি অনুভব,

নিখিলের অস্তিত্ব গৌরব।

তুমি আছ, তুমি এলে,

এ বিস্ময় মোর পানে আপনারে নিত্য আছে মেলে

অলৌকিক পদ্মের মতন।

অন্তহীন কাল অসীম গগণ

নিদ্রাহীন আলো

কী আদি মন্ত্রে তারা অঙ্গে ধরি তোমাতে মিলালো।

সৃষ্টির রহস্য জে. এন. ইসলাম গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে বোঝার চেষ্টা করেছেন আইনস্টাইনের প্রদর্শিত পথ অনুসরণ করে। এই গবেষণায় তিনি উল্লেখযোগ্য সফলতাও অর্জন করেছিলেন যার প্রমাণ তাঁর বেশ কয়েকটি সুলিখিত গ্রন্থ যা আজকাল দেশে বিদেশে অতি পরিচিত ও সমাদৃত।

অস্বীকার করার উপায় নাই যে বন্ধুবর জে. এন. ইসলামের সঙ্গে গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট হয়ে যাওয়ার একটা সুযোগে আমার জীবনেও "বিশ্বসৃষ্টিতত্ত্ব" নিয়ে পড়াশুনা করার উৎসাহ হয়েছে । আমাদের অপূর্ব এই মহাবিশ্ব গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় আমি লিখেছিলাম:
"স্টিফেন হকিং তাঁর এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম(২০০৫) গ্রন্থের শেষ অধ্যায়ে বোধহয় কিছুটা হতাশ হয়েই লিখেছেন:"আমরা এক পাগল-করা বিশ্ব পেয়েছি। আমরা চারিদিকে যা দেখছি তার অর্থোদ্ধার করতে চাই এবং জানতে চাই , এই বিশ্বের প্রকৃতি ঠিক কী? এখানে আমাদের স্থান কোথায় এবং এই বিশ্ব আর এই আমরা কোথা থেকে এলাম? এই বিশ্ব আমরা ঠিক যেভাবে দেখছি সেটাই বা কেন? "

এসব স্টিফেন হকিং-এর যেমন প্রশ্ন , তেমনি তা জে. এন. ইসলাম এবং আমাদেরও প্রশ্ন। দুঃখ এই যে আমাদের অতি প্রিয় জে. এন. ইসলামের সঙ্গে এসব প্রশ্ন নিয়ে আরো আলোচনা করার সুযোগ আর আমাদের থাকবে না।

কিন্তু তবু প্রিয় বন্ধু , আপনি আমাদের জীবনকে অর্থবহ করে গিয়েছেন। আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।

এ. এম. হারুন-অর-রশিদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, বিজ্ঞানী এবং বিজ্ঞানলেখক।