জামাল নজরুল ইসলাম: একটি প্রয়াণগাথা

আলম খোরশেদআলম খোরশেদ
Published : 18 March 2013, 06:26 AM
Updated : 18 March 2013, 06:26 AM

হঠাৎ করেই চলে গেলেন জামাল নজরুল ইসলাম! এই তো গেল মাসেই সাড়ম্বরে উদ্‌যাপিত হলো তাঁর ৭৪তম জন্মদিন। পত্রিকায় তাঁর সহাস্য ছবি দেখেছি জন্মদিনের অনুষ্ঠানের। আর তাঁকেই কিনা শেষ দেখা দেখে আসতে হলো কাল শহীদ মিনারে গিয়ে, হিমগাড়ির ছোট্ট, চৌকো একটি ফোঁকর দিয়ে। মহাবিশ্বের বিশাল, বিপুল, অনিঃশেষ জগত নিয়ে ছিল যাঁর সারাজীবনের চিন্তা ও কর্ম, তিনি কিনা শুয়ে আছেন এমন ক্ষুদ্র,অপরিসর চৌদিকঘেরা একটি গুমটি ঘরে!

এ-দৃশ্য সহ্য করা খুব কঠিন আমাদের জন্য, যাদের সুযোগ হয়েছিল এই বিরাট মাপের, প্রায় মহাকাশতুল্য মানুষটিকে কাছ থেকে দেখার এবং তাঁর ততোধিক বিরাট মনের পরিচয় পাবার। তিনি কত বড় মাপের বিজ্ঞানী ছিলেন, কী সুগভীর ছিল তাঁর দেশপ্রেম, যার টানে তিনি বিদেশের যাবৎ প্রলোভন উপেক্ষা করে দেশে ফিরে এসেছিলেন, বিজ্ঞানের পাশাপাশি সংস্কৃতির প্রতিও ছিল তাঁর কী অতুল অনুরাগ, আমাদের দেশের তাবিজ-পৈতে পরা মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণায় পুষ্ট তথাকথিত বিজ্ঞানীদের বিপরীতে তিনি কতটা অগ্রসর ও প্রগতিশীল ছিলেন, এসব এতক্ষণে সবার কমবেশি জানা হয়ে যাবার কথা। তাই আমি এই লেখায় সেসব প্রসঙ্গের পুনরাবৃত্তি না করে তাঁর সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত কিছু মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করে এবং তাঁর চরিত্রের গভীর মানবিক কিছু অনুষঙ্গের ওপর আলোকপাত করেই ক্ষান্ত হবো।

জামাল নজরুল ইসলাম মানুষ হিসাবে ছিলেন প্রায় দেবতুল্য, অবিশ্বাস্য রকমের সজ্জন ও উপকারী স্বভাবের। তিনি পারতপক্ষে কোনো অনুরোধ, উপরোধ বা প্রস্তাবে "না" বলতেন না। আর এই ভালোমানুষির মাশুলও তাঁকে দিতে হয়েছে প্রবলভাবে। পঠন-পাঠন, লেখালেখি আর গবেষণার কাজ ফেলে প্রায়শই নিজের মহামূল্যবান সময়ের অপচয় করতে হয়েছে তাঁকে—ছড়া পাঠের আসরের প্রধান অতিথি হয়ে, কি পোশাক-প্রদর্শনীর ফিতে কেটে, কি সুফি সম্মেলনের উদ্বোধন করে, কিংবা একেবারেই অনুল্লেখ্য কোনো গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করে।


আমি তাই পারতপক্ষে আমাদের প্রিয় প্রতিষ্ঠান বিশদ বাঙলার নিয়মিত অনুষ্ঠানসমূহে আমন্ত্রণ জানিয়ে তাঁকে বিরক্ত ও বিব্রত করতে চাইতাম না। তবে যে-ক'বারই আসতে বলেছি, যথারীতি ঘড়ির কাঁটায় সময় মিলিয়ে উপস্থিত হয়েছেন, ব্যতিক্রমহীনভাবে সস্ত্রীক। এই সুযোগে বলে রাখি,পত্নীপ্রেম ও জীবনসঙ্গীনির প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা, সম্মান ও ভালোবাসা ছিল তুলনারহিত। সর্বশেষ তিনি বিশদ বাঙলায় এসেছিলেন ভারতবর্ষের বিখ্যাত তত্ত্বীয় পদার্থবিদ, বাংলার আইস্টাইনখ্যাত অমল কুমায় রায় চৌধুরীকে নিয়ে আয়োজিত একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে। এর আগে তাঁকে ডেকেছিলাম টেলিস্কোপ আবিষ্কারের চারশত বছর পূর্তি উপলক্ষে গ্যালিলিও বিষয়ক একটি প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনীর অনুষ্ঠানে। মনে আছে, সেবার বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কবলে পড়ে আমাদেরকে প্রায় গোটা অনুষ্ঠানটিই পরিচালনা করতে হয়েছিল মোমের আলোয়, পাখাবিহীন ঘরের গুমোট আবহে। অথচ এক মুহূর্তের জন্যও অসহিষ্ণু হন নি তিনি, অনুযোগ করেন নি শারীরিক অস্বাচ্ছন্দ্যের জন্য, হাসিমুখে আলোচনা চালিয়ে গেছেন অনুষ্ঠানের শেষ পর্যন্ত।

জামাল নজরুল ইসলামের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল তাঁরই বাড়িতে; কবি, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক উইলিয়াম রাদিচের সঙ্গে আড্ডায়। সেদিন তাঁকে দেখেছিলাম অসম্ভব প্রাণবন্ত, হাস্যোজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত এক কথকের ভূমিকায়। নিজে থেকেই এক ফাঁকে গিয়ে বসেছিলেন প্রিয় পিয়ানোতে। গভীর নিবেদনের ভঙ্গিতে সাদাকালো রিডগুলোকে বাঙ্ময় করে তুলেছিলেন কুশলী আঙুলের ছোঁয়ায়, রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুরে। অল্পবিস্তর সেতারও বাজাতে জানতেন তিনি। বিশদ বাঙলার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে একবার বাজাবেনও বলেছিলেন। সে-সুযোগটা আর হলো না আমাদের।

চট্টগ্রামের অন্যতম নিসর্গশোভিত অঞ্চল সার্সন রোডের বৃক্ষঘেরা, সবুজমণ্ডিত পাহাড়চূড়ায় তাঁর তিনতলা বাড়িটার কথাও একটু বলি। এ-বাড়ির দোতলা-তিনতলা জুড়ে থাকতেন কপোত-কপোতী তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুটি মানুষ। সারা বাড়ি শুধু বই আর বই, দেয়ালজুড়ে তাঁর নিজের আঁকা অসংখ্য ছবি আর সংগ্রহ করা/উপহার পাওয়া বেশ কিছু চিত্রকলা ও সৌখিন গৃহসজ্জাসামগ্রী। সেগুলোর মধ্যে ছিল চোখে পড়ার মতো আকর্ষণীয় একটি ট্যাপেস্ট্রির কাজ, যা এ-দম্পতি উপহার পেয়েছিলেন বিশ্ববিশ্রুত বিজ্ঞানী, স্বয়ং রিচার্ড ফাইনম্যান-এর কাছ থেকে। একদিন আড্ডার ফাঁকে তিনি আমাকে নিয়ে নিচের তালাবদ্ধ ঘরগুলো খুলে দেখিয়ে বললেন নিচতলাটা তাঁরা কাউকে ভাড়া দিতে চান না; আমি এটিকে কোনো সৃজনশীল কাজে ব্যবহার করতে চাইলে তাঁরা তা সানন্দে ছেড়ে দেবেন। সেই থেকে ভাবছিলাম, কী করা যায়। একদিন মনে হলো, যদি তাঁর নামে একটি বিজ্ঞানচর্চা কেন্দ্র খোলা যায় সেখানে, তা হলে কাজের কাজ হয়। মনে মনে একটা খসড়া পরিকল্পনাও করে ফেলি।

মাস তিনেক আগে সাক্ষাৎ চেয়ে একদিন ফোন করি তাঁর জীবনসঙ্গীনি সুরাইয়া ইসলামকে (এখানে বলে রাখা ভালো যে, জামাল নজরুল ইসলাম এই তুমুল ডিজিটাল যুগেও মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না)। জানলাম পরদিনই তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন সমাবর্তন বক্তৃতা দিতে। ফলে এ-বিষয়ে আর কথা হলো না তাঁর সঙ্গে।

এরপর যথারীতি আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অলঙ্ঘ্য ব্যস্ততা এসে পথ রোধ করে দাঁড়ালো, আচমকা পাল্টে গেলো দেশের রাজনৈতিক চালচিত্র, পাশব শক্তির সহিংস আস্ফালনে প্রায় ঘরবন্দী হয়ে পড়লাম আমরা সবাই।

আর এরই মাঝখানে একদিন খুব অগোচরে, বুঝিবা খুব অভিমানেই, সবাইকে ছেড়ে একাকী তিনি পা বাড়ালেন অন্তহীন মহাপ্রস্থানের পথে। বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলামের এই মহাজাগতিক ভ্রমণ ভরে উঠুক অজস্র আবিষ্কারের আনন্দে।

আলম খোরশেদ: প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও বিশদ বাঙলার কর্নধার ।