আসাদের সিরিয়া ও বিদ্রোহীরা কে কেমন আছে

নাদিরা মজুমদার
Published : 13 March 2013, 05:05 PM
Updated : 13 March 2013, 05:05 PM

সিরীয় বিদ্রোহী দল জাতিসংঘের শান্তি মিশনের ২১ জনকে অপহরণ ও আটক করে বন্দী রেখে বেশ হৈচৈ ফেলে দিয়েছিল। হৈচৈ সৃষ্টির কারণ অবশ্য এই নয় যে তারা ছিল জাতিসংঘ শান্তি মিশনের সদস্য; কারণ, অতীতেও সদস্য, অসদস্যরাও বিদ্রোহীদের হাতে বন্দী হয়েছে-সিরিয়াতে বা অন্য কোনো দেশে। তেমন শোরগোল তো হয় না বা হয়নি। কিন্তু এবারে আটকের ঘটনাটি ঘটেছে সরাসরি গোলান হাইটসে, একেবারে ইজরাইলের গা ঘেঁষে। গোলান হাইটসের আদি অধিকারি ছিল সিরিয়া। ১৯৬৭ সালের ছয়দিনের যুদ্ধের সময়ে দুই তৃতীয়াংশ দখল করে নেয় ইজরাইল আর বাকি এক তৃতীয়াংশ থেকে যায় সিরিয়ার ভাগে। আন্তর্জাতিকভাবে মালিকানার প্রশ্নে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও ১৯৮১ সালে ইজরাইল বেশ পটুতার সঙ্গেই গোলান হাইটসকে সংযুক্ত করে নিজের দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৭৪ সাল থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষামিশন ইজরাইল-সিরিয়া যুদ্ধবিরতি মনিটরের কাজ করে আসছে। গোলান হাইটস মালভূমি, তার উপত্যকা ধরে বয়ে চলেছে ইয়ারমুক নদী। যে দলের সদস্যরা শান্তিমিশনের সদস্যদের জিম্মি করে রেখেছিল, সেটির নাম নদীটির নামে, যোদ্ধারা সব 'ইয়ারমুকের শহীদরা' নামক বিদ্রোহী দলের। আপাতদৃষ্টে, তাই ইজরাইলের উত্তর সীমান্ত অঞ্চলেও সিরীয়-সঙ্কট ফেনিয়ে ওঠার পর্যায়ে চলে আসে। ফলে, গোলান হাইটস এলাকা কয়েকদিনের জন্য আবার বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিল।

ইয়ারমুকের শহীদরা দলের এই এ্যাডভেঞ্চারের আগে বিদ্রোহীদের অন্য দলও অপহরণ, মুক্তিদান প্রায়ই করে আসছে। যেমন কিছুদিন আগে দুই রুশ ও এক ইতালীয় নাগরিককে এক বিদ্রোহীদল বন্দী করে দিন কয় আটকে রাখে, পরে ছেড়েও দেয়। এধরণের সাধারণ মানুষজন বন্দী হলে খুব একটা আলোড়ন হয় না। তাছাড়া, বিদ্রোহীদের এতো এতো দল উপদল রয়েছে যে কে কোথায় কখন কী করছে, সেসবের উপরে নজরদারি রাখা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তবে ইয়ারমুকের শহীদরা দলের যোদ্ধাদের এই অপহরণে ইজরাইলও বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। হবেই; নিজের সীমান্ত থেকে মাত্র দেড় দুই কিলোমিটার দূরে এমন ঘটনা ঘটলে, সবারই অস্বস্তি হয়। বিশেষ করে যখন পৃথিবীর সংবেদনশীলতম সামরিক যুদ্ধ-বিরতি লাইনগুলোর একটি এই গোলান হাইটস, অস্বস্তির সঙ্গে তখন যুক্ত হয় বাড়তি আশঙ্কা। বিগত মাসগুলোতে কখনো সরকারি বাহিনী কখনোবা বিদ্রোহী দল গোলাগুলি করলে, ইজরাইলও রুটিনমাফিক পাল্টা উত্তর দিয়ে আসছিল। গোলান তথা সিরীয় ভূ-খন্ড দখল করে রাখায়, আসাদের বাহিনী ও বিদ্রোহী দল, ইজরাইলের প্রতি সমপরিমাণেই বৈরী। তাই পরিস্থিতি যদি অন্যমোড় নেয়ার পাঁয়তারা করে, সম্ভাবনাটি উড়িয়ে দেয়ার মতো ছিল না। তদুপরি, যোদ্ধাদের দাবি ছিল একটিই, সরকারি বাহিনীকে গোলান হাইটস এলাকা থেকে সরে যেতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে ইজরাইলের কাছে চরমপন্থি ইসলামবাদীর চেয়ে আসাদ বাহিনী অনেক বেশি শ্রেয়। ইজরাইল খুব দ্রুত সিদ্ধান্তে আসে। প্রথমত, কড়া ভাষায় বলতে থাকে যে প্রয়োজনে বিদ্রোহীদের সমূলে ধ্বংস করতে দ্বিধা করবে না ইজরাইল; দ্বিতীয়ত, দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে থাকে যে জাতিসংঘ নিজেই এর সুরাহা করতে সক্ষম। এমন দাবীর মধ্যে অবশ্য ঝুঁকি একটি ছিল। ফলে, বান কি মুন সশরীরে বিশ্ব প্রেসের সামনে হাজির হন। অপহৃতরা সবাই ফিলিপাইনের হলেও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে অন্য দেশের যে লোকবল নিয়োজিত রয়েছে, তারা যদি নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে যার যার লোকবল সরিয়ে নেয়? বা চরমপন্থি ইসলামবাদীরা গোলান হাইটসে জেঁকে বসে যদি?

বান কি মুনের উপস্থিতি ও অপহরণকারি দলের প্রতি অপহৃতদের দেশ ফিলিপাইনের কড়া নিন্দা শান্তিরক্ষা বাহিনীকে সহসা বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে দেয়। ক্যানাডা ও জাপান তাদের ছোটো খাটো সেনাদলকে মাস কয়েক আগেই ফিরিয়ে নিয়েছিল; অপহরণ-নাটক চলাকালীন সময়ে ক্রোয়েশিয়াও তার ১০০ সদস্যের সেনাদলকে সরিয়ে নেয়ার কথা বলেছে। এই ঘটনার পরে শান্তিরক্ষা বাহিনীর মাধ্যমে ফিলিপাইন তার সাহায্য অব্যাহত রাখবে নাকি সরিয়ে নেবে-বলা সহজ নয়; তবে অষ্ট্রিয়া ও ভারতের সেনাদল থাকছে। আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে শান্তিরক্ষাবাহিনীর যতোটুকু 'হৃষ্টপুষ্ট' হওয়া প্রয়োজন ছিল, সেরকম সে শুরু থেকেই ছিল না। অপহরণ অধ্যায়টি এবারে কিছু কিছু দেশকে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরত রাখবে। ফলে, শান্তিরক্ষাবাহিনীও হয়তো 'হৃষ্টপুষ্ট' আর হবে না।

'ইয়ারমুকের শহীদরা' দলের যোদ্ধাদের অপহরণ সংঘটনের পূর্বে দুটো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। এক, ইজরাইলী বিমাণবাহিনীর উড়োজাহাজ প্রতিবেশি দেশের রাডারকে ফাঁকি দিয়ে সিরিয়ার গভীর অভ্যন্তরে ঢুকে বোমাবর্ষণ করে আসে। সেদিন ছিল ৩০ জানুয়ারি, ২০১৩ সাল। কিসের উপরে বোমাবর্ষণ করা হয়, সে বিষয়ে দুই পক্ষের দাবী ভিন্ন ভিন্ন ধরণের। সিরিয়া বলছে যে বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র ও তার আশপাশের দালানকোঠায় বোমা মেরে ধ্বংস করা হয়েছে; পশ্চিমের প্রেস যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বরাত দিয়ে বলে যে হেজবুল্লাহর জন্য সমরাস্ত্রপূর্ণ কনভয়কে বোমা ফেলে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে।

কোনটি সঠিক আর কোনটি বেঠিক বলা না গেলেও, বলা যায় যে ইজরাইলী বিমাণবাহিণী সহজেই অন্য দেশের গভীর অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে পারে; অতীতেও বার কয়েক তারা তাদের বাহাদুরি দেখিয়েছে। দ্বিতীয়ত, ফেব্রুয়ারি মাস শেষ হতে না হতেই, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, এবং যুক্তরাজ্যের ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সক্রিয় দেনদরবারের চাপে ইউরোপীয় ইউনিয়ণ ঠিক করে ফেলে যে সিরীয়া-বিরোধী কোয়ালিশন নামক ছত্রচ্ছায়ায় যেসব দল উপদলগুলো সম্মিলিত হয়েছে, যারা সত্যিকারের আসাদ-বিরোধী, তাদেরকে আরো উন্নতমানের ও আরো বেশি পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হবে, এবং এগুলো সবই নন-লেথাল সাহায্য হবে। ব্রিটিশ বৈদেশিক মন্ত্রী উইলিয়াম হেগ সংসদে নন-লেথালের ব্যাখ্যা দিতে বলেন যে এই সাহায্যের মধ্যে পড়ছে, যেমন, বর্ম-আচ্ছাদিত সামরিক মোটরগাড়ি, এবং বিদ্রোহীদের বেসামরিক নেতারা নিজেদের আত্মরক্ষার কাজে এগুলো ব্যবহার করবে।

কেন নন-লেথাল সাহায্য জরুরী হয়ে পড়েছে, তার কারণ দিতে আরো বলা হয় যে সাম্প্রতিককালে, সিরীয় বিদ্রোহী দলের মধ্যে চরম ইসলামপন্থিরা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে, এবং 'কে যে কে?' সনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে; এমতাবস্থায় কেবলমাত্র মধ্যপন্থি আসল আসাদ-বিরোধীদের জোরদার করতে এখনই মোক্ষম মুহূর্ত। এই সাহায্য তাই মধ্যপন্থি আসল আসাদ-বিরোধীদের জন্যই মঞ্জুর করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, যেমন: আল-নুসরা ফ্রন্টের যোদ্ধারা মুক্ত সিরীয় সেনাদল ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সঙ্গে পাশাপাশি থেকে পূর্বাঞ্চলের রাকাহ্ শহর বিজয়ে অংশ নেয়। আল-নুসরা ফ্রন্ট আল-কায়েদার সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে অনেককাল ধরেই। যুক্তরাষ্ট্র তাকে সন্ত্রাসীদের কালো তালিকায় আগেই অন্তর্ভুক্ত করেছে বটে কিন্তু আল-নুসরাকে সিরিয়ার বিদ্রোহী দলের সঙ্গে ওঠাবসা করতে দেখে যুক্তরাষ্ট্র যেমন ফাঁপরে পড়েছে, তেমনি বেড়েছে তার অস্বস্তি। এই নন-লেথাল সাহায্য ঘোষণা ও ইয়ারমুকের শহীদরা-দলের বিপজ্জনক এ্যাডভেঞ্চারের সঙ্গেও সম্পর্ক কী ছিল, কে জানে? হতে পারে যে 'ইয়ারমুকের শহীদরা'-কেও চরমপন্থির দলে ফেলা হয়। বা হতে পারে যে নন-লেথাল সাহায্যের মধ্যে এমনকি ট্যাঙ্কও যদি থাকে, তবু বিদ্রোহীরা দ্রুত কোনো অলৌকিক কিছু করতে পারবে না; কারণ, সরকারি বাহিনীর হাতে রয়ে যাচ্ছে আকাশ, যুদ্ধবিমানগুলো আর ভূমি থেকে বায়ুতে ব্যবহারের ক্ষেপনাস্ত্র। হতে পারে যে ' ইয়ারমুকের শহীদরা', পরামর্শ সাপেক্ষে, ন্যাটো ও মধ্যপ্রাচ্যের বন্ধুদেশগুলোর উপরে চাপ সৃষ্টির প্রয়াসে অপহরণ পরিচালনা করে। অতঃপর পাঁচদিন স্থায়ী নাটকীয় পরিস্থিতির অবসান ঘটে। মুক্তিপ্রাপ্ত জিম্মিদের জর্ডানে নিয়ে যাওয়া হয়। ফ্রি সিরিয়ান আর্মি জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দলকে অপহরণ করার জন্য ওদের খুব নিন্দাও করে। এর পরপরই তুরস্ক ও উপসাগরীয় দেশগুলো বিদ্রোহীদের "উপযুক্ত" সহায়সাহায্য দেয়ার কথা ঘোষণা করে।

অবশ্য নন-লেথাল সাহায্যের বিষয়টি এমনই কুয়াশাচ্ছন্ন যে তাতে বিভিন্ন ধরণের সামরিক ট্রেনিংও অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। জার্মানির ডার স্পিগেলের রির্পোট অনুযায়ী, গত তিন মাস ধরে জর্ডানে ব্রিটিশ ও ফরাসি সামরিক প্রশিক্ষকরা ফ্রি সিরিয়ান আর্মির যোদ্ধাদের প্রতি-ট্যাঙ্কের উপরে ট্রেনিং দিয়ে আসছে। সিরীয় সরকারের মজুতে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে বলে মনে করা হয়। গত অক্টোবর মাসে পেন্টাগনের এক খবরে বলা হয়েছে যে যুক্তরাষ্ট্র তাই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার হলে কিভাবে কী করতে হবে বিষয়ের উপরে সিরীয় বিদ্রোহীদের নির্বাচিত একটি দলকে ট্রেণিং দিয়েছে। মধ্যপন্থি আসল আসাদ-বিরোধীদের মধ্যে মিশে যাওয়া চরম ইসলামপন্থিদের ফিল্টার করে আলাদা করার কাজও চলছে পুরোদমে, এবং জর্ডানের ইনটেলিজেন্স খুব যত্নের সঙ্গে সাহায্য করছে। সিরীয় সঙ্কটের মোকাবেলার মূল দায়দায়িত্ব ছিল তুরস্কের। কিন্তু বিগত কয়েকমাস ধরে জর্ডান প্রাধান্য পাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, কোনো বাছবিচার না করে চরম ইসলামপন্থিসহ সবাইকেই তুরস্ক দেদারে সামরিক সাহায্য ও ট্রেণিং দিয়ে যাচ্ছিল; এমনকি সিরিয়ার উত্তরাংশের ফ্রন্টে চরম ইসলামপন্থিদের সক্রিয় বিদ্রোহ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। যেমন: ইয়ারমুকের শহীদরা। হয় তা ছিল তুরস্কের ব্যর্থতা নয়তোবা ইচ্ছাকৃত- এমন মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের উপরে কতোটা ক্ষাপ্পা হয়ে রয়েছে। নতুন বৈদেশিক মন্ত্রী জন কেরির তুরস্ক সফরের কর্মসূচির অন্যতম একটি পয়েন্ট ছিল প্রধাণমন্ত্রী এরডোগানকে 'রোষ্ট' করা। তাতে ইজরাইলের সন্তুষ্টি কিছুটা নিশ্চয় পূর্ণ হয়। তুরস্কের ভূমিকায় হতাশ যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জর্ডানকে বেছে নেয় মধ্যপন্থি আসল আসাদ-বিরোধীদের নতুন প্রধাণ ঘাঁটি হিসেবে। নতুন এই ব্যবস্থায়, তুর্কি, সৌদি আরব, বাহ্রাইনসহ বন্ধুদেশগুলো জর্ডানের মাধ্যমে সিরীয় বিদ্রোহীদের সহায়সাহায্য পাঠাচ্ছে। আগামি কিছুদিনের মধ্যে ইত্যবসরেই কেন্দ্রীয়ভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়া সিরিয়া কোনদিকে মোড় নেয়, দেখা যাক।

নাদিরা মজুমদার: বিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক।