মিরাজ কি সরকারের উদাসীনতার বলি

শাহরিয়ার কবীরশাহরিয়ার কবীর
Published : 12 March 2013, 09:45 AM
Updated : 12 March 2013, 09:45 AM

বাংলাদেশের সঙ্গীত জগতের একজন স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধাপরাধীদের মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন বলে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা ও শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের অপরাধের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছিলেন। তিনি এই যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে চলমান বিচারকাজের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী। দুঃখজনক বিষয় হল, দুদিন আগে তার একমাত্র ছোট ভাই মিরাজকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হল। সারাদেশের মানুষ এ ধরনের ঘটনায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বুলবুল গোলাম আযমের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছেন বলেই কি তার ভাইকে প্রাণ দিতে হল? তাহলে ওইসব গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে কেউ কি আর এগিয়ে আসবেন?

দুঃখ পাচ্ছি এটা ভেবেই যে, সাক্ষী নিরাপত্তা আইন করার আমরা বরাবরই বলে এসেছি। গত তিন বছর ধরে এই একটি কথাই অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলছি আমরা। সরকার আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছেন যেটি আমাদের দীর্ঘদিনের একটি দাবি ছিল। ট্রাইব্যুনালকে আমরা সবরকম তথ্য দিযে সহযোগিতা করেছি। কারণ আমরা চেয়েছি যে, আমাদের নিজস্ব জনবল দিয়ে একটি বড় কাজ হোক, একটি আন্তর্জাতিক মানের বিচারপ্রক্রিয়া আমরা সফলভাবে করতে পারলে এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

সন্দেহ নেই যে, এ বিচারপ্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে শেষ করার জন্য সাক্ষ্যদান একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়্। একাত্তরে আমাদের জাতির ওপর সংগঠিতভাবে নৃশংস অত্যাচার চালানো হয়েছে। এসব ঘটনার প্রচুর সাক্ষী রয়েছেন সারা দেশেই। কিন্তু তখনই আমরা সাক্ষীদের কাছ থেকে পরিপূর্ণ সহযোগিতা পাব যখন সাক্ষীদের নিরাপত্তা দিতে পারব। সে কাজটি করতে হবে সরকারকে।

আমরা দেখেছি, শুরু থেকেই সরকার এ ব্যাপারে উদাসীন। এর ফলে, আমি নিশ্চিত যে, অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্য আমরা হারিয়েছি। আর যুদ্ধের সময় গণহত্যার মতো অপরাধ সংঘটনকারীদের বিচার আন্তর্জাতিক মানের হতে হলে, প্রত্যক্ষদর্শী ও ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে ঘটনাগুলো জানা খুবই দরকার। প্রতিটি মামলায় এভাবে সাক্ষ্য এলে কোনো অপরাধীর পক্ষে পার পেয়ে যাওয়া সহজ হবে না।

এতদিন ধরে আমরা যে কথাগুলো বলে এসেছি, সাক্ষী সুরক্ষা আইনের রক্ষাকবচের মাধ্যমে সাক্ষীদের কাছ থেকে যথাযথ সহযোগিতা আদায় করা, তা না হওয়ায় আমরা এখন এর মর্মান্তিক পরিণতিগুলো দেখতে পাচ্ছি। জামায়াতে ইসলামীর মতো ফ্যাসিস্ট দল যেকোনো কিছুই করতে পারে। এরা যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য এতদিন ধরে বাইরের বিশ্বে লাখ লাখ ডলার খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করেছে, তাদের দিয়ে বিচারের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে। এমনকি আমাদের এক বিচারকের সঙ্গে আন্তর্জাতিক এক বিশ্লেষকের স্কাইপ-কথোপকথন হ্যাক করার মতো ষড়যন্ত্রও হযেছে। এসবই ওরা করেছে বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য।

দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্তের বাধা ঠেলে আমরা যখন কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচারকাজ শেষ করতে পেরেছি, তখন এরা বাকি অপরাধীদের বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা দেখেছি, গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ট্রাইব্যুনাল দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় দেওয়ার পর জামায়াত-শিবির সারাদেশে ফ্যাসিস্ট কায়দায় সহিংসতা চালাচ্ছে। তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আমাদের যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এভাবে সারাদেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছে তারা যাতে দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়া যায় এবং জনগণ আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটায়। একাত্তরেও ওরা আমাদের জাতির বিরুদ্ধে এভাবেই সংগঠিত অপরাধ করেছে। তখন করেছে ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষা করতে; আর এখন করছে যুদ্ধাপরাধের বিচার বাধাগ্রস্থ করার জন্য।

ইতোমধ্যেই সাঈদীর মামলায় ফাঁসির রায় হলেও কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে মামলায় ফাঁসির রায় হয়নি। আমরা জানি, ট্রাইব্যুনালে প্রয়োজনীয় সংশোধনীর মাধ্যমে এখন কাদের মোল্লার মামলাটির বিরুদ্ধে সরকার আপিল করছেন। ওদিকে আরও সাত শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে। আগামীতে আরও ক'জন অপরাধীর বিরুদ্ধে মামলা দাযের ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে।

এ সময় দেখা যাচ্ছে, বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের ওপর নানাভাবে আঘাত আসছে। এর আগে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মামলার এক সাক্ষীকে হত্যা করা হয়েছে। সুরকার বুলবুলের ভাইকে হত্যার ঘটনাটি পুরো দেশকে নাড়া দিয়েছে। কদিন আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ছেলে সুমন মাহবুবকে আঘাত করা হয়েছে। আমাদের কাছে খবর আছে যে, সাঈদীর বিরুদ্ধে মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া সংখ্যালঘুদের অনেককেই নানাভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ফ্যাসিস্টরা তাদের বলছে যে, 'তোদের সাক্ষ্যের কারণে সাঈদীর ফাঁসির রায় হয়েছে। তোদের ছেড়ে দেওয়া হবে না।' এরকম বিপন্নতার মুখে পড়তে পারেন যেকোনো সাক্ষী বা তার পরিবার।

এখানে সরকারকে দৃঢ়তার সঙ্গে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। অন্যান্য যুদ্ধাপরাধীর বিচারপ্রক্রিয়ায় যাবতীয় দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হলে খুব জরুরি হল সাক্ষ্যদানের বিষয়টিকে অবাধ করে দেওয়া, সাক্ষীরা যাতে কোনো ধরনের ভয়ভীতির মুখে পিছিয়ে না যান।

এ জন্য আমরা একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে সুস্পষ্ট ও সরাসরি বক্তব্য রেখেছি। আমরা বলেছি, সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়নের মাধ্যমে সাক্ষীদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক নিরাপত্তা দিতে হবে। পারিবারিক নিরাপত্তার দাবি করার কারণটিও খুব স্পষ্ট। সুরকার বুলবুল গোলাম আযমের বিপক্ষে সাক্ষী দিয়েছেন, তার ভাই মিরাজ দেননি। কিন্তু এ জন্যই মিরাজকে হত্যা করা হল। তাই প্রত্যেক সাক্ষী ও তার পরিবারের ঘনিষ্ঠ সদস্যদের পরিপূর্ণ নিরাপত্তা দেওয়া সরকারের দায়িত্ব।

এখন এ কাজটি কেন হচ্ছে তা আমরা জানি না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, আইন মন্ত্রণালয় এটা করবে- আবার আইন মন্ত্রণালয় বলছে, ওটা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। এভাবে পরস্পর পরস্পরের দিকে বল ছুঁড়ে দিলে সমাধান কীভাবে হবে আমি জানি না। আর এর ফলে আগামীতে যুদ্ধাপরাধ মামলাগুলোর সাক্ষীদের আমরা পিছিয়ে যেতে দেখব, অথবা যারা সাহস করবেন তাদের বা তাদের আপনজনদের নিষ্ঠুরভাবে খুন হতে দেখব। আমাদের জাতির দায় পরিশোধের জন্য আমাদের মানুষদের আর কত মূল্য দিতে হবে?

মূল কথা হল, জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি ফ্যাসিস্ট দল, যারা একাত্তরে আমাদের শত্রু পাকবাহিনীকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছিল- এ দেশের মাটিতে তাদের আমরা যতদিন রাজনীতি করতে দেব ততদিন তারা এমন ঔদ্ধত্য দেখানোর সাহস পাবে। গত একুশ বছর্ ধরে আমরা, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি দুটি দাবি করে এসেছি। একটি হল যুদ্ধাপরাধের বিচার; দ্বিতীয়টি বাংলাদেশের মাটিতে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত। চূড়ান্ত বিচারে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা না হলে আমরা ওদের নানা সহিংসতার শিকার হতেই থাকব। সরকার কেন এ কাজটি এখনও করছেন না তা আমাদের কাছে মোটেই বোধগম্য নয়।

জামায়াতে ইসলামীর সহিংসতাকে আমরা সবসময় ছোট করে দেখেছি। এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া চালিয়ে নেয়া মুশকিল হবে। আমরা যদি দৃঢ়তার সঙ্গে ওদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজটি করতে পারি তাহলে জাতি দায়মুক্ত হবে।

না হলে আঁধারের শক্তির সঙ্গে সংগ্রাম করতে করতে আমরা ক্ষয়ে যাব।

শাহরিয়ার কবীর:লেখক, সাংবাদিক, চিত্রনির্মাতা ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির কার্যকরী সভাপতি।