আমরা কি এই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম

এবিএম নাসির
Published : 29 Sept 2016, 05:14 AM
Updated : 8 March 2013, 05:12 PM

গত কয়েকদিন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যোগাযোগের চেষ্টা করছিলাম পরিচিত অমুসলিম পরিবারগুলোর সাথে। জানতে চাইছিলাম, কেমন আছে তারা। কেউই তেমন কিছু বলতে চাইছিল না। অবশেষে কাছের এক বন্ধু মনের কথা খুলে বললো। জানালো, ওর বউ শাঁখা-সিদুঁর পরা বন্ধ রেখেছে। প্রয়োজন ছাড়া ওরা তেমন একটা বাইরে বেরুচ্ছে না। বললো হিন্দুধর্মের আচার বজায় রাখার চেয়ে আপাতত নিরাপদে বেঁচে থাকা অনেক বেশী জরুরী। যা শুনছিলাম তা বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যখন আরও কয়েকটি হিন্দু পরিবারের কাছে সরাসরি জানতে চাইলাম, তাঁদের ধর্মীয় আচারের কথা, তখন অনেকেই জানালো, তাঁরা আপাতত মন্দির পরিহার করে চলছেন। মহিলারা শাঁখা-সিদুঁর পরছেন না। মন্দিরের ঘন্টা আর ঘটা করে বাজছে না। শুধুমাত্র যতটুকু নিয়ম মানতে হয় তাই পালন হচ্ছে।

এ সকলই সারা দেশে জামাত-শিবিরের সহিংস সাম্প্রদায়িক ফল। সহিংস তান্ডব তছনছ করে দিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনযাত্রা। মনে হল, এ কেমন স্বাধীন দেশ, গণতান্ত্রিক দেশ, যেখানে স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও অমুসলিমদের অনিরাপত্তার কারনে তাঁদের ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান বাদ দিতে হয়। মনে হচ্ছিল ৯/১১ উত্তর যুক্তরাষ্ট্রের মুসলমানদের কথা। যখন, মুসলিম সন্দেহে টারবান পরিহিত শিখ সম্প্রদায়ের একজনকে হত্যা করা হয়েছিল। মুসলিম ইমামদের উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল নিরাপত্তার অযুহাতে।

হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ নেতারা অভিযোগ করেছেন যে সাঈদীর রায় ঘোষণার পর থেকে সারাদেশে জামাত-শিবিরের ক্যাডাররা হিন্দুসম্প্রদায়ের এক হাজারেরও বেশী বাড়িঘর ভাঙচুর করেছে। জামাত-শিবিরের তান্ডবের খন্ডচিত্রের কিছু নমুনা হচ্ছে, ২৮ ফেব্রুয়ারী, চট্টগ্রামের বাশঁখালিতে জামাতের হামলায় নিহত দয়াল হরি শীল (৬৫)। হরি শীলকে হত্যা করা ছাড়াও জামাতের ক্যাডাররা বাশঁখালির মন্দির ও বাড়িঘরে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট চালায়(প্রথম আলো, ৩/১)। একই দিন, কুমিল্লার ব্রাহ্মনপাড়ায়, হিন্দু সম্প্রদায়ের ২০টি ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়, যাতে আহত হন ১৬ জন। ভাঙচুর করা হয় বেগমগঞ্জের রায়গঞ্জ বাজারের বাইন্নাবাড়ির কালিমন্দিরসহ দুটি মন্দির ও ৮টি হিন্দুবাড়ি। সাতকানিয়ার ৮টি বাড়ি ও ১টি বৌদ্ধমন্দির। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় চট্টগ্রামের চট্টেশ্বরীতে হিন্দুদের দোকান, গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের বেলকা গ্রামের ৮টি ও ব্রাহ্মনডাঙা গ্রামের ৬টি বাড়ি (ঢাকাটাইমস, ৩/৩)। লুট করা হয় সিলেটের কানাইঘাটে হিন্দুদের দোকান। আগুন দেয়া হয় চাপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলায় মন্দিরে, ভাঙচুর চালানো হয় দিনাজপুর সদর উপজেলার রাণীগঞ্জের উত্তর মহেশপুর গ্রামে বসাক পরিবারের ১১টি বাড়িতে। এছাড়াও মৌলভীবাজারের বড়লেখা, ‍ঠাকুরগায়ের গড়েয়া গ্রাম, চাপাইনবাবগঞ্জের কানসাট, সাতক্ষীরার শ্যামবাজার, বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ, রংপুরের মিঠাপুকুর, কুমিল্লার কসবাসহ সারাদেশে ১৯৭১, ৯০, ৯২, ও ২০০১ সালের মতো জামাত-শিবিরের নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক হামলা চালিয়ে ভাঙচুর, অগ্নিকান্ড, লুটপাট ও অত্যাচার করা হয়।

এ গুলো কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অত্যন্ত পরিকল্পিত এবং প্ররোচিত। সাঈদীর রায় ঘোষণার কিছুদিন আগে থেকেই নিবন্ধ ও প্রতিবেদনের মাধ্যমে জামাত-শিবির সমর্থিত পত্রিকাগুলোতে উস্কানীমূলক প্রারোচনা দেয়া হতে থাকে। যেমন, ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকায় বলা হয়, "শাহবাগ স্কয়ারে বাম-রাম ও কমিউনিস্টদের মিলন মেলায় পরিণত হয়েছে। তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির নাটক মঞ্চস্থ করার আড়ালে মূলত ইসলামের দুশমনেরা দেশ থেকে ইসলাম নির্মূলের হুঙ্কার দিচ্ছে। " ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ প্রকাশিত একই পত্রিকায় আল্লামা শাহ্ আহমদ শফী বলেন, "বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এবং চিহ্নিত নাস্তিকরা যেভাবে একের পর এক ইসলামের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারমূলক আঘাত হানার প্রয়াস এবং দাড়ি-টুপীধারী পুরুষ ও পর্দানশীন নারীদের উপর হামলা চালানোর মত বর্বরতা ও দুঃসাহস দেখাচ্ছে, তাতে কোন মুসলমানই উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেনা। তিনি সকল ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে মুসলমানদেরকে এক কালিমার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করেন।"

২০ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম প্রত্রিকায় জাগপা সভাপতি শফিউল আলম প্রধান বলেন, "এটা এখন দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, আমাদের ধর্ম স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আল্লাহর দুশমনরা প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিম সভ্যতার বিরুদ্ধে ইহুদি ও ব্রাহ্মণ্যবাদী এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই শাহবাগে প্রজেক্ট চালু করা হয়েছে।" সংগ্রাম পত্রিকার ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সংখ্যায় বিবিসির বংলা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সিরাজুর রহমান বলেন, "এ দেশে প্রধানমন্ত্রী আল্লাহর শুকরিয়া আদায়ের কথা ভাবতে পারেন না। ফসল ভালো হলে তিনি 'মা-দুর্গার' প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।" একই পত্রিকাটির ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ এর সম্পাদকীয় তে বলা হয়েছে, "আবার নারী-পুরুষ একই সাথে, একই কাতারে নামাজ পড়েছে। আবার হিন্দুরাও নাকি নামাজে অংশগ্রহণ করেছে।" একইভাবে, ২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সংখ্যায় চরমোনাইপীর ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মো: ফয়জুল করিমের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, "দেশের ২৭টি জেলার প্রশাসক হিন্দু, ২০০ ওসি হিন্দু, সচিবালয়সহ সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের প্রমোশন দিয়ে পুরস্কৃত করা হচ্ছে। আর প্রকৃত মুসলমান আমলা ও কর্মকর্তারা হচ্ছেন ওএসডি বা চাকরিচ্যুত।"

দৈনিক আমার দেশের ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ সংখ্যায় সম্পাদক মাহমুদুর রহমান লিখেছেন, "ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক … সংখ্যালঘু শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আমার দেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। … ভারতীয় কায়দায় প্রদীপ প্রজ্বলন : গতকাল সমাবেশের পঞ্চম দিনে কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীর উপস্থিতিতে ভারতীয় হিন্দুদের রীতিতে প্রদীপ প্রজ্বলন করা হয়।" আমার দেশের ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ প্রকাশিত আরেকটি নিবন্ধে মাহমুদুর রহমান, সাবেক উপদেষ্টা সুলতানা কামালকে সুলতানা কামাল চক্রবর্তী নামে অভিহিত করেন। একইভাবে গোলাম আযমও ১৪ আগষ্ট, ১৯৭১ সালে এক অনুষ্ঠানে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদকে শ্রী তাজউদ্দীন নামে উল্লেখ মুক্তিযু্দ্ধের সাম্প্রদায়িক রূপ দিতে চেষ্ট করেছিলেন।

আর এ সকল উস্কানীমূলক বক্তব্যেরই পরিণতি হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের সদস্যদের উপর একের পর এক হামলা যা অনেক হিন্দুকে নিরাপত্তার কারণে বসতবাড়ী ছেড়ে, শাঁখা-সিদুঁর ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিহার করে নিজেদের ধর্মীয় স্বত্তা বর্জন করতে বাধ্য করছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি মিলিটারিরা একইভাবে বাঙালি পুরুষদের মুসলমানিত্ব প্রমাণ দিতে বাধ্য করতো।

কিন্তু, স্বাধীনতার ৪২ বছর পরও যখন অমুসলিম সম্প্রদায়ের সদস্যদের ১৯৭১ সালের মতো প্রাণের মায়ায় স্বাতন্ত্র বিসর্জন দিতে হয়, তখন মনে হয় এ কেমন স্বাধীনতা এ কেমন স্বাধীন দেশ!