অসংখ্য জীবনের জন্য ছিলো চাবেস-এর জীবন

আনু মুহাম্মদ
Published : 7 March 2013, 11:28 AM
Updated : 7 March 2013, 11:28 AM

উগো চাবেস(প্রচলিত উচ্চারণ হুগো শ্যাভেজ)-এর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে দুবার। বেনেসুয়েলা( প্রচলিত উচ্চারণ ভেনেজুয়েলা)র রাজধানী কারাকাসে। একবার আমাদের সঙ্গে বিশ্বরাজনীতি, অর্থনৈতিক সংকট, বলিভারিয়ান বিপ্লব, বিশ্বের একুশ শতকের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন নিয়ে মতবিনিময় সভায়। এই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল ৫ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে। আরেকবার কারাকাস শহরের বিভিন্ন অংশে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা কমিউনিটি কাউন্সিলের প্রতিনিধি সভায়, তিনি সেখানে আমাদের কয়েকজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন।

প্রথমটি অনুষ্ঠিত হল আলবা কারাকাস হোটেলে আর দ্বিতীয়টি শতবর্ষ পুরনো পরিত্যক্ত থিয়েটার হলকে নবায়ন করে বানানো কমিউনিটি সেন্টারে। আমরা কমিউনিটি সেন্টার বলতে যা বুঝি, ভাড়া নিয়ে বিয়েসহ নানা অনুষ্ঠানের জায়গা, তা নয়, এটা হল নির্দিষ্ট এলাকার মানুষদের মিলন-সভা-সাংস্কৃতিক তৎপরতার কেন্দ্র, প্রকৃত অর্থেই কমিউনিটি সেন্টার যা এলাকাবাসীর সামষ্টিক তৎপরতার কেন্দ্র। বর্তমান সময়ে খুবই সজীব। সমাজকে বদলে ফেলার নানা পরিকল্পনা ও তৎপরতার এক একটি সদা সক্রিয় ঠিকানা।

উগো চাবেস দীর্ঘদেহী। পরনে প্রথাগত নয় কিন্তু একধরনের যোদ্ধা পোশাক। দীর্ঘক্ষণ কথা বলেন, ফিদেল কাস্ত্রোর ভঙ্গীতে সবকিছু চুলচেরা তথ্য উপাত্ত দিয়ে বিশ্লেষণ করা তাঁরও স্বভাব হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। চাবেস সামরিক বাহিনীতে ছিলেন, বিপ্লবী রাজনীতিতে তাঁর আকর্ষণ ছোটবেলা থেকেই, অনেকটা আমাদের কর্ণেল তাহেরের মতো। শৈশব কেটেছে দারিদ্রের মধ্যে, শরীরে জন্মসূত্রে লাতিন আমেরিকার সব বর্ণ ও জাতিকে ধারণ করে আছেন।

বিভিন্ন জাতি ও বর্ণের মধ্যে মিশ্রণে বিশ্বে সবচাইতে এগিয়ে আর্জেন্টিনা। উগো চাবেসের নিজের রক্তপ্রবাহে বিভিন্ন পর্যায়ে যুক্ত হয়েছে আদি আমেরিকান বা আদিবাসী, দখলদার ইউরোপীয় শ্বেতাঙ্গ, আফ্রিকার মুক্ত মানুষকে ধরে দাস বানিয়ে নিয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গ। এই কয়েক ধরনের মানুষই পাওয়া যায় লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে। এখন মিশ্র মানুষদের সংখ্যাই বেশি। তবে জাতিগত সমস্যা যেমন কুবা(প্রচলিত উচ্চারণ কিউবা) অনেক আগেই সমাধান করেছে অন্যান্য দেশে তা হয়নি। বেনেসুয়েলা আর বলিবিয়া(প্রচলিত উচ্চারণ বলিভিয়া)য় ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠ আদিবাসী বা মিশ্র জনগোষ্ঠী এখন ক্ষমতার সঙ্গে যুক্ত।

যেহেতু দেড় দশক আগেও বেনেসুয়েলাসহ এই দেশগুলোতে ক্ষমতা সম্পর্ক, মালিকানা ও কর্তৃত্বের কেন্দ্রে ছিল শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের উত্তরসূরীরা এবং তাদের মাধ্যমে পুঁজির নিয়মে অর্থনীতি চলছিল, সেহেতু আদিবাসী বা কৃষ্ণাঙ্গদের অবস্থানও ছিল একেবারেই প্রান্তিক। অনেক দেশেই আদি আমেরিকান বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও গরীব প্রান্তিক শ্রমজীবী মানুষ অভিন্ন। যেমন বলিবিয়াতে আদি আমেরিকান আদিবাসীর অনুপাত ছিল শতকরা ৬০-এরও বেশি। এরাই ছিলেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত মানুষের অংশ। ইভো মোরালেস এদেরই জাতিভুক্ত মানুষ। সেজন্য ২০০৫ সালে ইভো মোরালেস যখন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন তখন সেটা ছিল এক বিরাট পরিবর্তনের ইঙ্গিতবহ। মোরালেস প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিতে গিয়ে তাই যখন বলেন, '৫০০ বছরের ইতিহাস পরিবর্তনের যাত্রা এবার শুরু হল' তখন নিপীড়ন, আধিপত্য, দখল ও নৃশংসতার ইতিহাস পাল্টে দেয়ার অঙ্গীকারই তিনি প্রকাশ করেন। জাতিগত ও শ্রেণীগত নিপীড়ন ও বৈষম্য যেহেতু একাকার সেহেতু এই অঙ্গীকার এই দুইকে নির্মূল করতেই দায়বদ্ধতা প্রকাশ করে। সেই অঙ্গীকারই মোরালেসকে এখনও জনগণের আস্থাভাজন রেখেছে।

উগো চাবেস জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৪ সালের ২৮ জুলাই। সেসময় লাতিন আমেরিকার অনেক দেশে সামরিক স্বৈরশাসন আর মার্কিনী বহুজাতিক কোম্পানির যথেচ্ছাচার নৃশংসতা চলছে। এই বছরই গুয়াতেমালার নির্বাচিত জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট জেকোবা আরবেনজকে ক্ষমতাচ্যুত করে সিআইএ। আরবেনজ কমিউনিস্ট ছিলেন না। তিনি 'আমেরিকান বিপ্লব' এর আদর্শ নিয়েই জাতীয় স্বার্থ রক্ষা এবং গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ভুমিসংস্কারসহ নানারকম সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন। সেসময় মায়া সভ্যতার কেন্দ্রভূমি এই গুয়াতেমালায় মায়া জনগোষ্ঠী ছিলেন সবচাইতে নিপীড়িত ও নিগৃহীত অবস্থায়। এইদেশে তখন শতকরা ২ ভাগ জনগোষ্ঠীর হাতে ছিল শতকরা ৭০ ভাগ জমি। জনগণের স্বার্থে ভূমি সংস্কার করতে গিয়ে যাদের স্বার্থে বড় আঘাত লেগেছিল সেটি হল মার্কিন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি।

এই কোম্পানি ও তার সমগোত্রীয়রা গুয়াতেমালাকে 'বানানা রিপাবলিকে' রূপান্তর করেছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় নীতি, জমি আর শ্রমের উপর তারা কায়েম করেছিল একচ্ছত্র অধিকার। মার্কিন আধিপত্যের বিরোধিতার শাস্তি হিসেবে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আখ্যা দিয়ে আরবেনজ-বিরোধী প্রচারণা শুরু হয়, অন্তর্ঘাত চলতে থাকে, মার্কিন বিমান থেকে রাজধানীতে বোমা ও প্রচারপত্র ফেলা হতে থাকে। আরবেনজকে উচ্ছেদ করে কায়েম হয় জেনারেল-এর নেতৃত্বে সামরিক শাসন। এই সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথমেই ভূমি সংস্কার কর্মসূচি বাতিল করে। একটানা ৪০ বছর এই সামরিক শাসন চলে যাতে গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন, গুমখুনে প্রায় ২ লক্ষ মানুষ নিখোঁজ হন। প্রতিরোধও শুরু হয় প্রথম থেকেই।

গুয়াতেমালার ভয়ংকর স্বৈরশাসন প্রত্যক্ষ করে চে গেবারা(গুয়েভারা) পুরোপুরি পাল্টে যান এবং জীবনকে বিপ্লবের জন্য হাজির করেন। ফিদেল কাস্ত্রোর সঙ্গে তাঁর ভবিষ্যৎ নির্ধারক বৈঠকটি হয় এই সময়েই। চাবেস-এর জন্মের পাঁচ বছর পর, কয়েক বছরের গেরিলা যুদ্ধের জয় পরাজয়ের মধ্য দিয়ে, কুবা উঠে দাঁড়ায় বিপ্লব নিয়ে যা পুরো লাতিন আমেরিকার ভবিষ্যৎ গতিমুখ নির্ধারণ করে দেয়। তখন এতসব ঘটনার তাৎপর্য বোঝার বয়স চাবেস-এর হয়নি, কিন্তু আমরা এখন জানি তাঁর জীবনের মানচিত্রও তখনকার এসব ঘটনাবলীর মধ্যে দিয়েই ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

স্কুল শিক্ষক মা ও বাবার সন্তান চাবেস-এর জন্ম একটি ছোট মাটির কুটিরে। দারিদ্র, খাদ্যাভাব, কাপড় বা জুতার অভাব এগুলোর কথা চাবেস সবসময়ই মনে রেখেছিলেন। দারিদ্রের কারণে শৈশবেই তাঁকে কাছাকাছি শহর সাবানেতাতে দাদীর কাছে পাঠিযে দেয়া হয়। সেখানেই তাঁর লেখাপড়া আর সেইসঙ্গে ছবি আঁকা, গান গাওয়া আর বেসবল খেলার শুরু। দাদী ছিলেন আদিবাসী, যাদের বলা হয় 'আমেরিন্ডিয়ান'। চাবেস প্রায়ই বলতেন, আমাদের সঙ্গে কথা প্রসঙ্গেও বলেছেন, এই দাদী এবং তাঁদের সম্প্রদায়ের সাম্য ও সংহতির সংস্কৃতি তাঁকে অনেক প্রভাবিত করেছিল। রোমান ক্যাথলিক ধর্মবিশ্বাসী পরিবারে তাঁর জন্ম হলেও এসব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও চর্চায় বৈষম্যমূলক রীতিনীতি তাঁকে খুব আকর্ষণ করেনি, বরং অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

১৭ বছরে তিনি 'ভেনেজুয়েলা একাডেমী অব মিলিটারী সাইন্সেস' এ ভর্তি হন। ১৯৭৫ এ মিলিটারী আর্টস এন্ড সাইন্সেস এ ডিগ্রীসহ সাব লেফটেন্যান্ট হবার পর কয়েকমাস সামরিক বাহিনীতে কাজ করেন। এর পর তিনি সিমন বলিবার বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গ্রাজুয়েট শিক্ষার অনুমতি পান। ডিগ্রী না হলেও এই সময়কালেই তিনি গড়ে ওঠেন ভিন্ন রাজনৈতিক চেতনায়। কবিতা, গল্প, নাটক চর্চাতেও আগ্রহী হয়ে উঠেন। বলিবারের রাজনৈতিক জীবন ও সংগ্রামের বিপ্লবী উপাদানে আকৃষ্ট হন, এবং সেইসূত্রে তাঁর পরিচয ঘটে মার্কস, লেনিন, ট্রটস্কি, কাস্ত্রো, চে গেবারার লেখালেখি ও জীবন সংগ্রামের সঙ্গে। তিনি 'বলিভারিয়ানিজম' নামে একটি গোষ্ঠীও গড়ে তোলেন। এই একই সময়ে ভিয়েতনামে যুক্তরাষ্ট্রীয় সাম্রাজ্যবাদ তার দানবীয় বাহিনী নিয়ে নাকানিচুবানি খাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রেও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী প্রতিবাদী কন্ঠ তখন অনেক সোচ্চার। ১৯৭৫ এ ভিয়েতনাম বিপ্লবের বিজয় ছিল মার্কিনী সাম্রাজ্যবাদের জন্য সবচেয়ে বড় পরাজয়।

কিন্তু তা সত্ত্বেও অন্যান্য স্থানে মার্কিনী বর্বরতা থেমে ছিল না। চিলি তখন বিশ্ববাসী বিশেষত লাতিন আমেরিকার মানুষের সামনে দগদগে অভিজ্ঞতায় হাজির। পুরো চিলিই তখন যেন একটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। সেখানেও নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে তখন ক্ষমতায় ছিলেন জনপ্রিয় সালবাদর আইয়েন্দে। আগেই বলেছি ১৯৭৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সিআইএর পরিকল্পনা ও সরাসরি হস্তক্ষেপে প্রেসিডেন্ট ভবনের উপর বোমাবর্ষণ শুরু হয়, যুদ্ধ করতে করতে পরাজয় নিশ্চিত জেনে নিজের মাথায় গুলি করে আইয়েন্দে আত্মহুতি দেন।

চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে স্টেডিয়াম বানানো হয়েছিল হাজার হাজার নারী পুরুষের বন্দীশালায়। বন্দীদের অধিকাংশই ছিল তরুণ, পরিবর্তনের লড়াইয়ে শামিল সৃজনশীল মানুষ, রাজনৈতিক কর্মী, কবি, লেখক, শিল্পী। আটক তরুণদের মধ্যে একজন ছিলেন বিক্তর হারা(প্রচলিত উচ্চারণ ভিক্টর জারা), চিলির খুবই জনপ্রিয় গীতিকার কবি। ঐ বন্দী অবস্থাতেই তিনি গান গেয়ে সবাইকে সাহস জুগিয়েছেন। মেরে তাঁর হাত ভেঙে না দেয়া পর্যন্ত তাঁর গীটার থামেনি। তারপরও আহত অবস্থাতেও তিনি ছিলেন প্রেরণার উৎস। এক পর্যায়ে তাই তাঁকে হত্যা করা হয়। নির্যাতকেরা, ফ্যাসিস্টরা তাদেরকে মুখোমুখি দাঁড় করানো গান কবিতা সৃজনশীল উচ্চারণ আর মানুষের সাহস সহ্য করতে পারে না।

মৃত্যুর আগে হারার লেখা শেষ কবিতা পরে উদ্ধার হয়। মৃত্যুর মুখে জখম রক্তাক্ত শরীরে তিনি লেখেন:

ফ্যাসিবাদের বাহিনী কী ভয়াবহতা সৃষ্টি করতে থাকে
ছুরির মতো কী সূক্ষ্ণ নিপুণতায় ভয়ংকর কাজগুলো করে যায়..
তাদের কাছে আরও রক্ত মানে আরও মেডেল..
কী কঠিন আমাদের গান গাওয়া
কিন্তু এই ভয়াবহতার গান আমাদের গাইতেই হবে
কেননা নীরবতা আর গোঙানি মানে
গানেরই সমাপ্তি..

হত্যা করে সাহস আর গানের সমাপ্তি হয় না। আর তাই এই সাহস আর প্রাণের শক্তি নিয়ে চাবেস০এর মতো আরও অনেকেই তখন লাতিন আমেরিকা জুড়ে প্রস্তুত হয়েছেন। মানুষ ও দানবের মধ্যে লড়াইয়ের অসংখ্য অধ্যায় তৈরি হয়েছে দেশে দেশে।

দানবের বিরুদ্ধে মানুষের প্রবল কন্ঠ নিয়ে, বেনেসুয়েলায় জনগণের নানা লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, সামনে আসেন উগো চাবেস। জনগণের ভোটে বারবার নির্বাচিত হলেও তাঁকে যথারীতি স্বস্তি দেয়নি শত্রুপক্ষ। একদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও অন্যদিকে দেশি দানবদের সঙ্গে লড়াই ছিলো তাঁর প্রতিমুহূর্তের জীবন। বেনেসুয়েলা, লাতিন আমেরিকা ও বিশ্বের অসংখ্য জীবনের জন্য ছিলো তাঁর জীবনের লড়াই। মাদুরোর ভাষায় বলি, 'জীবনের জন্য যাঁরা মৃত্যুবরণ করেন তাঁদের কখনো মৃত বলা যায় না।'

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।