জামায়াতের শক্তিবৃদ্ধি বিএনপির জন্যও অশনি সংকেত

নাজমুল হুদা
Published : 3 March 2013, 03:10 PM
Updated : 3 March 2013, 03:10 PM

বিরোধীদলীয় নেতা এবং বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ১ মার্চ জামায়াতে ইসলামীর চলমান কর্মসুচিতে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। আমি বলব, তিনি হচ্ছেন চারদলীয় জোটের প্রধান। জোটের অন্যতম প্রধান শরীক দল জামায়াতে ইসলামী। বিএনপি প্রথম থেকেই শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ সম্পর্কে বলে এসেছে যে, এটা কমবেশি 'আওয়ামী চত্বর' হয়ে গেছে। তারা বলতে চাচ্ছে যে, 'জয় বাংলা' শ্লোগানটি এ চত্বরে উচ্চারিত হয়েছে একটি দলের শ্লোগান হিসেবেই। পাশাপাশি, তারাও এটাও বলছে যে, এ সরকারের খুব কাছের একজন লোক শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা ইমরান এইচ সরকারকে পরামর্শ ও উপদেশ দিচ্ছেন।

এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে এবং এ পর্যন্ত যা হয়ে এসেছে তাতে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী, আওয়ামী নেতৃবৃন্দ এবং ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দের প্রভাব শাহবাগ চত্বরে আছে বলেই বিএনপির মূল্যায়ন। সেখানে যেহেতু ফাঁসির দাবিটিই প্রধান তাই এর মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ একটি বিরাট রাজনীতি করছে- এ ধারণা থেকে বিএনপি আন্দোলনটিকে এভাবে দেখছে।

একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে এবং বিরোধী দলের রাজনৈতিক কৌশল বুঝে নিয়ে নিজেদের কৌশল ঠিক করার ক্ষেত্রে খালেদা জিয়া ১ মার্চ যে বক্তব্য দিয়েছেন তা দলটির রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এটা ভালো কী মন্দ সেটা পরের ব্যাপার।

শাহবাগ চত্বরে গত ৫ ফেব্রুয়ারি নতুন প্রজন্মের যে আন্দোলন শুরু হয় সেটিকে বিএনপি প্রথমে সতর্কতার সঙ্গে সমর্থন দিযেছিল। তারা বলেছিল যে, যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবির সঙ্গে তরুণ প্রজন্মের উচিত হবে পদ্মাসেতু দুর্নীতিসহ দেশের অন্যান্য সংকট নিয়েও কথা বলা। প্রথমদিকে বিএনপি এটিকে একটি 'স্বচ্ছ' আন্দোলন হিসেবেই গ্রহণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন যে, আন্দোলনটির 'রাজনীতিকরণ' করা হচ্ছে।

বাস্তবতা হল এই যে, আগামী নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজনীতি করবে এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি মনে করছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি চাপিয়ে রাখতে বা আড়াল করতেই আওয়ামী লীগ বর্তমানে এ কৌশল গ্রহণ করছে। তাই এ মুহুর্তে জোটের অন্যতম শরীক দল জামায়াতে ইসলামীর বিপদের দিনে দলটিকে সমর্থন ও সহায়তা দেওয়াই জোটনেত্রী হিসেবে খালেদা জিয়ার কাছে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে।

বিভিন্ন দলের সঙ্গে জামায়াতের অতীত সম্পর্ক যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখা যাবে যে, জামায়াতের ভোট-ব্যাংক বিএনপিকে ক্ষমতায় যেতে সাহায্য করেছে। ঠিক একইভাবে আওয়ামী লীগও জামায়াতকে নানাভাবে ব্যবহার করেছে বা করার চেষ্টা করেছে। জামায়াতের অবস্থান কিন্তু যেকোনো দলের কাছেই ভোট আনার মতো একটি অবস্থান। সেদিক থেকে আমার মনে হয়, জামায়াত বর্তমানে যেভাবে শক্তি প্রদর্শন করছে- যদিও সবসময় সেটা প্রত্যক্ষভাবে হচ্ছে না এবং একে অনেকে সঠিক বলে মনেও করছেন না- তারপরও তাদের শক্তি দেখানোর কাজটা ঠিকই হচ্ছে। আর এ কারণেই চারদলীয় জোটে জামায়াতকে পাওয়া বিএনপির জন্য বড় একটি পাওয়া বটে।

তবে আমি মনে করি, শাহবাগ প্রজন্ম যে আন্দোলন শুরু করেছিল সেটিকে আরও বেগবান করা যেত, একে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ রাখার সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়নি। আজ 'জয় বাংলা' শ্লোগান এবং 'জয় বাংলা' গানটি পর্যন্ত আওয়ামী লীগ দলীয়করণ করেছে। এ গান বা শ্লোগান তো আমার বা বেগম খালেদা জিয়ার মুখেও থাকা উচিত ছিল। এটা যদি মুক্তিযুদ্ধের শ্লোগান হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে তোলা থাকত, তবে একে কেন্দ্র করে বিরাট আন্দোলন গড়ে তোলা যেত। তাহলে এ ধরনের একটি স্বচ্ছ নির্দলীয় আন্দোলনের দিকে কেউ চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে পারত না।

কিন্তু সেটা হয়নি। এখন বরং এটি একটি পাল্টাপাল্টি পর্যায়ে চলে গেছে। আমাদের জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেমন এক ধরনের পাল্টাপাল্টি বিষয় রয়েছে- শাহবাগ আন্দোলন নিয়েও এখন তাই হচ্ছে। খালেদা জিয়া শাহবাগের মঞ্চটিকে 'আওয়ামী চত্বর' নাম দিয়ে এর গায়ে রঙ চড়ানোর চেষ্টা করছেন। এতে তারা কতটা সফল হবেন সেটা ইতিহাসের হাতে ছেড়ে দেতে হবে। যদি বেগম জিয়ার অভিযোগ সত্যি হয়ে থাকে, তবে সময়ের বিচারে তিনি সঠিক বলে বিবেচিত হবেন।

যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে বিএনপির অবস্থান নিয়ে বলব, বিএনপি এ বিচার করবে না তা তো কখনও বলেনি। তবে বলেছে, বিচারটি হতে হবে স্বচ্ছ এবং সত্যিকারের আন্তর্জাতিক একটি ট্রাইব্যুনালের অধীনে যাতে এ ট্রাইব্যুনাল বাইরে স্বীকৃতি পায়। যুদ্ধাপরাধের দায়ে যে নেতাদের বিচার চলছে তারা যদি এসব অপরাধ করে থাকেন তাহলে অবশ্যই তাদের বিচার হতে হবে। শুধু যুদ্ধাপরাধ কেন, সাধারণ খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধের জন্যই তো ফাঁসির আদেশ হওয়া উচিত। তাই যুদ্ধাপরাধের মতো অপরাধের জন্য কারও শাস্তি হবে না বিএনপি এটা কখনও বলেনি।

কিন্তু আওয়ামী লীগ যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে যা করেছে তাতে রাজনৈতিক হিসেব-নিকেশ আছে। কারণ একাত্তরের পর আটক পাকিস্তানি সেনাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচার না করে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ছিয়ানব্বইতে ক্ষমতায় এসেও আওয়ামী লীগ যুদ্ধপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়নি। এবার এ উদ্যোগ নিয়েছে চারদলীয় জোটকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করার জন্য।

আমাদের দেশে অতীতে যুদ্ধাপরাধীদের বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো দল রাজনীতি করেনি। কখনও আওয়ামী লীগ, কখনও বিএনপি জামায়াতকে নিযে ফায়দা লুটেছে। আর এর ভেতর দিয়ে জামায়াতের রাজনৈতিক স্বীকৃতি হয়ে গেছে। তাই আমি এটাও সন্দেহ করি যে, যুদ্ধাপরাধের দায়ে একজন বা দুজন জামায়াত নেতার ফাঁসির আদেশ হলেও, তা কার্যকর করা হবে কিনা সেটাও একটা প্রশ্ন। দেখা যাবে, ফাঁসি কার্যকর করতে গিয়ে এই আওয়ামী লীগই আবার জামায়াতের সঙ্গে দর-কষাকষি করছে। কিছুই বলা যায় না।

বাংলাদেশের রাজনীতির এসব জটিল হিসেব-নিকেশের কারণেই আমি বলব, প্রজন্ম চত্বর প্রথমদিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও ভালো একটি কাজ করেছে- আর তা হল, যদি সত্যিই কোনো সমঝোতার ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের রায়গুলো দেওয়ার চেষ্টা হয়ে থাকে তারা সেটা বাস্তবায়ন করতে দেয়নি। তাদের বড় কৃতিত্ব এটি। এভাবে যদি তারা এগিয়ে যেতে পারত তাহলে আন্দোলনটি ভিন্ন মাত্রা পেত।

ওদিকে বিএনপির প্রসঙ্গে বলব, দলটির যথেষ্ট রাজনৈতিক শক্তি আছে। এ শক্তি দিয়ে নিজেরাই পথ চলতে পারত। তবু কেন তারা নির্ভর করছে জামায়াতের ওপর সেটা দলের নীতিনির্ধারকরেই ভালো বলতে পারবেন। কারণ বর্তমানে জামায়াত কিন্তু আরও শক্তিশালী হচ্ছে, আর সেটা প্রদর্শনও করছে। বিএনপির জন্যও অবশ্যই এটি একটি অশনি সংকেত। বিএনপির হয়তো নানা সময়ে জামায়াতকে প্রয়োজন হবে, কিন্তু জামায়াত যেভাবে এগুচ্ছে- তাতে আলটিমেটলি তারা একটি শক্তিশালী দল হিসেবে আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ দুটো দল মিলেই জামায়াতকে আমাদের রাজনীতিতে বড় একটি ফ্যাক্টর বানিয়ে তুলছে।

দু'দলেরই এটা বোঝা দরকার। জামায়াত আল্লাহর নামে রাজনীতি করে। মুসলিমদের কাছে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আর সে সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়েই জামায়াত তার শক্তি সঞ্চার করতে পারবে। ওদিকে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ সেই পুরনো পাল্টাপাল্টির চক্রে ঘুরপাক খেতে থাকবে। বেগম খালেদা জিয়া দেশে ফিরেই সেদিন যেভাবে কথা বলেছেন সে জন্য তার সমালোচনা করা হচ্ছে এটা ঠিক। কিন্তু বিএনপি নেতৃত্ব বলবেন যে, এটা আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী ঘরানার লোকদের বক্তব্য। আমাদের রাজনীতিতে এভাবে মেরুকরণ হয়ে গেছে বলে এমনটি হচ্ছে, হবে।

তাহলে এ মুহুর্তে কী করা উচিত? আমি বলব, আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব এখন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। কোনো দেশেই এত নৈরাজ্য ও অরাজকতা চলতে পারে না। জনগণের জানমাল বিপন্ন হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। অস্থিরতা দেশকে পিছিয়ে নিয়ে যাবে বা একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করবে।

এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে দ্রুত একটি জাতীয় কনভেনশন আহ্বান করা দরকার। সব কটি প্রধান রাজনৈতিক দল এখানে থাকতে পারে। সেখানেই অনেক কিছুর সমাধান হয়ে যাবে। দেশপ্রেমিক জাতীয় নেতারা একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার উপায় খুঁজে বের করবেন আশা করি।

আর এভাবেই দেশে একটি জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হোক।

নাজমুল হুদা : সাবেক তথ্যমন্ত্রী ও যোগাযোগমন্ত্রী।