নিকৃষ্ট সাংবাদিকতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ

এবিএম নাসির
Published : 2 March 2013, 09:11 AM
Updated : 2 March 2013, 09:11 AM

ভারতের 'টাইমস অব ইন্ডিয়া'র ফেব্রুয়ারি ২৬ তারিখে "প্রোটেস্টারস অ্যাট শাহবাগ ইন বাংলাদেশ ব্যাকড বাই ইন্ডিয়া" শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিবেদনটির কিছু শব্দ বিকৃত করে, উস্কানিমূলক শব্দ ব্যবহার করে পরদিন বুধবার, ২৭ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার 'আমার দেশ' পত্রিকায় দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। 'আমার দেশ' পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল "ভারতের মদতে শাহবাগ আন্দোলন: 'টাইমস অব ইন্ডিয়া'র প্রতিবেদন"।

এখানে অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, 'টাইমস অব ইন্ডিয়া'র প্রতিবেদনটির শিরোনাম নিয়েও যথেষ্ট বিভ্রান্তির অবকাশ আছে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম হতে পারত ''ইন্ডিয়া সাপোর্টস শাহবাগ প্রোটেস্ট''। তাহলে হয়তো 'আমার দেশ' রং মাখিয়ে সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা দেওয়ার সুযোগ পেত না।

'আমার দেশ'-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,
"শাহবাগ আন্দোলন ভারতের মদতপুষ্ট বলে জানিয়েছে দেশটির সর্বাধিক প্রচারিত ইংরেজি দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া।… প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম শাহবাগ মোড়ের আন্দোলনকারীদের প্রতি প্রতিবেশি ভারতের জোরালো মদত রয়েছে। মদতের প্রমাণ হিসেবে প্রতিবেদনে ভারতের অন্যতম দুজন নীতিনির্ধারকের বক্তব্যকে উদ্ধৃত করা হয়েছে। এদের একজন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন এবং অন্যজন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদ।"

অথচ, 'আমার দেশ' পত্রিকায় শিবশঙ্কর মেননের বক্তব্যের বাংলা অনূদিত ভাষ্যে কোথায় 'মদত' দেওয়ার কখা উল্লেখ করা হয়নি। যেমন, 'আমার দেশ'-এর অনূদিত ভাষ্যে বলা হয়েছে, "শিবশঙ্কর মেনন শুক্রবার বলেছেন, 'বাংলাদেশি মুক্তমনা তরুণরা শাহবাগে বিক্ষোভ করছে। তারা উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক মৌলিক মূল্যবোধকে সমর্থন দিচ্ছে।"
একইভাবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশীদের বক্তব্যের অনুবাদে 'আমার দেশ' পত্রিকায় 'সংহতি', 'জোরালো অনুভূতি' ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যাবহার করা হয়েছে।
অর্থাৎ উভয় ক্ষেত্রেই আমার দেশের অনূদিত ভাষ্যে 'মদতের' পরিবর্তে সমর্থন ও সংহতি কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে।

বাংলা ভাষায় 'মদত' শব্দটি মূলত নঞর্থক ও 'সমর্থন' শব্দটি ধনাত্নক অর্থে ব্যাবহার করা হয়। 'মদত' শব্দটি সচরাচর সমর্থনের সমার্থক হিসেবে ব্যবহার হতে দেখা যায় না।
তাহলে 'আমার দেশ-এর প্রতিবদনটিতে 'সমর্থন' ও 'সংহতি' শব্দ দুটোর বদলে 'মদত' শব্দটি কেন ব্যবহার করা হল? এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে, শাহবাগ আন্দোলন ভারতের পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছে এ ধারণা প্রচার করে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর একটি অংশের ভারতবিদ্বেষী মনোভাবকে উসকিয়ে দিয়ে আন্দোলনটিকে নসাৎ করা।

স্বৈরাচারী এরশাদও একইভাবে পতনের অন্তিম মুহুর্তে্, ১৯৯০ সালের অক্টোবরে, মওলানা মান্নানের পত্রিকা দৈনিক ইনকিলাবকে ব্যবহার করে স্বৈরচারবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন নসাৎ করার চেষ্টা করেছিল। ১৯৯০ এ অক্টোবরের ৩১ তারিখের দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত বাবরি মসজিদ ধ্বংস-সংক্রান্ত মিথ্যা সংবাদের ওপর ভিত্তি করে মৌলবাদীরা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্থানগুলোতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী ঢাকেশ্বরী মন্দিরসহ সারাদেশের হিন্দু উপাসনালয়গুলোতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটাপাট করা হয়।

জনগণের প্রতিরোধে যদিও হামলাকারীরা পালিয়ে যায়, হামলায় মদতদানকারী দৈনিক ইনকিলাব ও তার অবৈধ মালিক ডা. আলীম চৌধুরীর হত্যায় সহায়তাকারী মওলানা মান্নানকে কখনও এজন্য জবাবদিহি করতে অথবা শাস্তি পেতে হয়নি। শুধুমাত্র ইনকিলাবের নিবন্ধন সাময়িকভাবে (১৭ দিনের জন্য) বাতিল করা হয়েছিল।

এ দায়মুক্তির ফলশ্রুতিতে, নব্বই-উত্তর বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় ও প্রগতিবাদী জনগণের ওপর একের পর এক আঘাত আসতে থাকে। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতের হিন্দু মৌলবাদীদের বাবরি মসজিদ ভাঙার পর, দেশব্যাপী হিন্দু সমাজের ওপর যে বর্বর ও ভয়াবহ নির্যাতন নেমে আসে- তা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি মিলিটারি ও তাদের দোসরদের হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন ও লুণ্ঠনের বিভীষিকার কথাই মনে করিয়ে দেয়।

বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে, ২০০১ সালে নির্বাচন-উত্তর যে খুন ও ধর্ষণ হয়েছিল তা যে কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে নজিরবিহীন। নির্বাচন-উত্তর হামলার পর বহু হিন্দু পরিবারকে প্রাণের মায়া নিয়ে বসতভিটা ছেড়ে, দেশান্তরী হতে হয়েছিল। জামায়াত-বিএনপির ক্যাডারদের হাতে সম্ভ্রমহানি হওয়া পূর্ণিমাকে বহুদিন পালিয়ে থাকতে হয়েছিল প্রাণের মায়ায়।

এবিএম নাসির : যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।