নাগিনীর নিঃশ্বাস ও সতর্ক প্রহর

সালাহউদ্দীন আহমদ
Published : 1 March 2013, 04:54 PM
Updated : 1 March 2013, 04:54 PM

২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ দিনটি আমাদের জন্য একটি বিজয়ের দিন। দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির রায় ঘোষিত হল। রায়টি গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এর আগে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ দেওয়া হলেও সে পলাতক। আর কাদের মোল্লার তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হল যে প্রেক্ষিতে দেশজুড়ে তৈরি হয়েছিল গণজাগরণ। তরুণদের অভিনন্দন জানাই এ জন্যই যে, ওরা কোন বাংলাদেশ চায় সেটি দেখিয়ে দিয়েছে বলে জাতি পথনির্দেশণা পেয়েছে।

আমি বরাবরই বলে এসেছি যে, জামায়াতে ইসলামী নামের দলটির রাজনীতি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ। একাত্তরে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা আমাদের সাধারণ নিরীহ মানুষজনের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতায় নৈতিকসহ প্রত্যক্ষ সব সহযোগিতা দিয়েছে। এ জন্য তারা গঠন করেছিল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনি। তাই এ দলের সে সময়কার নেতৃত্ব ও ওইসব সগঠনের তখনকার কর্মীদের আমাদের দেশে রাজনীতি করার কোনো অধিকার নেই।

তবু তারা করেছে। এতদিন ধরে এটা আমাদের সয়ে যেতে হয়েছে। এখন সময় এসেছে ওদের প্রতিরোধের। জামায়াতের এক শীর্ষ নেতা এবং অন্যতম শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী সাঈদীর বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার রায়ে তার ফাঁসির আদেশ হল। এটা যেমন এ জাতির দায়মুক্তির পথ খুলে দিল, তেমন আগামীতে নতুন দিনের স্বপ্ন দেখতেও আমাদের অনুপ্রেরণা জোগাবে।

যুদ্ধাপরাধী দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় প্রত্যাশিতই ছিল। কারণ এর আগে ট্রাইব্যুনালে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে ফাঁসির রায় না দেওয়ায় তরুণরা শাহবাগ চত্বরে আন্দোলন শুরু করেছিল। তরুণ প্রজন্মের এ ক্ষোভ ছিল যৌক্তিক। কারণ কাদের মোল্লা একাত্তরে 'কসাই কাদের' নামে পরিচিত ছিল। তার হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়েছিল শতশত মানুষ। তার বিরুদ্ধে ছয়টির মধ্যে পাঁচটি অভিযোগই ছিল প্রমাণিত। তবু তার ফাঁসির আদেশ না হওয়া ছিল চরম অপ্রত্যাশিত। মাত্র একজন মানুষকে ঠাণ্ডা মাথায় ও পরিকল্পিতভাবে হত্যার ঘটনা প্রমাণিত হলেও অপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। যেহেতু আমাদের দেশের প্রচলিত আইনে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে তাই এটাই ছিল কাঙ্ক্ষিত।

শাহবাগ চত্বরের তরুণদের আন্দোলন দেখে আমি মুগ্ধ। তাদের তৈরি ওই 'গণজাগরণ মঞ্চ' আসলে আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া একটি বিপ্লব। তরুণদের হাতে গড়া দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ যে এত স্বতঃস্ফুর্তভাবে জেগে উঠতে পারে, তা এ ঘটনা না ঘটলে আমরা হয়তো বিশ্বাস করতেই পারতাম না।

এ তরুণদের আমরা স্বার্থপর বা আত্মকেন্দ্রিক বলেই গালি দিয়েছি এতদিন। অথচ ওরা এবার প্রমাণ করে দিল যে, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা ওরা লালন করে। ওদের বুকের গভীরে সুপ্ত ছিল এটা। গণজাগরণের তরুণরা বুঝিয়ে দিয়েছে যে, আমাদের তরুণরা দেশ নিয়ে ভাবে। শুধু ওরা নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যেও যে চেতনাটির স্ফুরণ ঘটেছিল সেটা এবার বোঝা গেল। নইলে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বা দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এভাবে তরুণদের কাতারে শামিল হতেন না তারা।

আমাদের জনতা ভাষা আন্দোলন করেছে, ষাটের দশকে বারবার গর্জে উঠেছে, একাত্তরে তো দেশটি স্বাধীনই করে ফেলল তারা। এবারের বিজয় বাঙালির জন্য আরেকটি বড় বিজয়। তবু সাবধান থাকতে হবে। চারপাশে ওৎ পেতে আছে ওরা, যুদ্ধাপরাধী ও তাদের দলের কর্মী-সমর্থকরা। কিছু নমুনা ইতোমধ্যেই দেখিয়ে দিয়েছে ওরা। ওদের চোরাগোপ্তা হামলায় ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটছে।

এ পরিস্থিতিতে জনতাকে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। এমন কিছু করা ঠিক হবে না যাতে ওরা জল ঘোলা করার সুযোগ পায়। খুব সজাগ থাকতে হবে। ভেবেচিন্তে কাজ করতে হবে। জামায়াতে ইসলামী দলটির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি নিয়ে গভীরভাবে ভেবে সিদ্ধান্ত ঠিক করতে হবে।

দেশি-বিদেশি নানা চক্রান্ত চলছে চারদিকে। অনেক টাকা খরচ করে বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে জামায়াতিরা তাদের পক্ষে প্রোপাগাণ্ডা কিনে নিচ্ছে। তাই ওরা ঔদ্ধত্য দেখাতে সাহস পায়। বিয়াল্লিশ বছর আগেই ওদের বিচার করতে পারলে ভালো হত। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর থেকেই এদেশের রাজনীতি উল্টো স্রোতে বইতে শুরু করেছিল। তাই সেটা সম্ভব হয়নি। এখন সম্ভব হচ্ছে। সেটাই সুখের কথা। এ বিজয় ধরে রাখতে হলে আমাদের প্রতিটি বিষয়ে সজাগ থেকে এগিয়ে যেতে হবে। কোনো ভুল করা চলবে না।

ড. সালাহউদ্দিন আহমদ : জাতীয় অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।