উপেক্ষিত ইতিহাস খণ্ডিত শিক্ষাক্রম

মোহাম্মদ সেলিম
Published : 26 Feb 2013, 02:37 PM
Updated : 26 Feb 2013, 02:37 PM

সাহিত্য, দর্শন বা ইতিহাসচর্চায় আগ্রহী শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমে হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু ছাত্রছাত্রীদের পছন্দের বিষয়ের তালিকায় মানবিক শাখার কোনো বিষয় স্থান পায় না। গত দু'তিন দশকে এ প্রবণতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। আবার মানবিক শাখার বিষয়গুলোর মধ্যে ইতিহাসের অবস্থা একটু বেশি নাজুক।

কারণ ইতিহাস বিষয়টি এক ধরনের বৈষম্যের শিকার। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জন্ম নেয়া পাকিস্তানে ইতিহাসের বিপরীতে ইসলামের ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা চলে। তারপরও স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে ইতিহাস স্বতন্ত্র বিষয় হিসেবে অবশ্যপাঠ্য ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পর ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশে ইতিহাস বিষয়ের প্রতি সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির প্রত্যাশিত পরিবর্তন দৃশ্যমান হয়নি। স্বাধীনতার পর একটা ভারসাম্য আসবে তা-ও হয়নি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। সামরিক শাসনামলে পাঠ্যপুস্তক থেকে শুরু করে সর্বত্র ইতিহাস বিকৃতি প্রকট আকার ধারণ করে। সামগ্রিকভাবে দেশে ইতিহাস-বৈরি অবস্থার সৃষ্টি হয়।

ইতিহাস মানববিদ্যার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। যে কারণে উপমহাদেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিষ্ঠালগ্নে যে সব বিভাগ নিয়ে যাত্রা শুরু করে এর মধ্যে ইতিহাস বিভাগও অন্তর্ভূক্ত ছিল। এমন কী সম্প্রতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় নামে যে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে যাচ্ছেন, সেখানেও অন্যান্য বিভাগের সঙ্গে ইতিহাসকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন। দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪। এর মাত্র ছয়টিতে ইতিহাস পাঠদানের ব্যবস্থা আছে। ৫৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনোটিতে ইতিহাস অধ্যয়নের সুযোগ নেই। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত বেসরকারি ২২৩৩টি মাদ্রাসায় ইতিহাস পড়ানো হয় না।

এর কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার গোড়ায় গলদ। স্কুলে শিক্ষার্থীদের কাছে ইতিহাস বিষয়কে কঠিন, নিরস ও গুরুত্বহীন বিষয় হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। কারিকুলামেও ইতিহাস খণ্ডিত বা বিকৃতভাবে সন্নিবেশিত হয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, স্কুলে ইতিহাসের কোনো শিক্ষক নেই। ইতিহাস যেহেতু নেই সুতরাং ইতিহাসের শিক্ষকেরও প্রয়োজন নেই। কর্তৃপক্ষের ধারণা, যে কোনো বিষয়ের শিক্ষকই ইতিহাস পাঠদান করতে সক্ষম। সুতরাং স্কুল পর্যায়ে শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে কখনই ইতিহাসের শিক্ষক চাওয়া হয় না। এমন পরিস্থিতি স্কুল থেকে কলেজ, কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। বিষয় হিসেবে ইতিহাস থেকে গেছে উপেক্ষিত।

কিছুদিন আগেও বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার অরাজক অবস্থার জন্য শিক্ষানীতির অভাবকে দায়ী করা হত। স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত সরকার মোট ৫টি শিক্ষা কমিশন গঠন করে। কমিশনসমূহ প্রতিবেদন আকারে তাদের সুপারিশ সরকারের নিকট জমা দেয়। কিন্তু কোনো কমিশনের সুপারিশই বাস্তবায়িত হয়নি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ২০০৯ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত 'শিক্ষানীতি ২০১০' বাস্তবায়নের কার্যকর উদ্যোগ নেয় সরকার। স্বাধীনতার চার দশক পর একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষানীতি গ্রহণ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ইতিহাসে যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হয়। প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার নানা দিকসহ বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক রূপরেখা পাওয়া যায় গৃহীত শিক্ষানীতিতে।

জাতীয় শিক্ষানীতির সঙ্গে মিল রেখে প্র্রণীত হয়েছে নতুন শিক্ষাক্রম। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড এবং সেকেন্ডারি এডুকেশন সেক্টর ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের তত্ত্বাবধানে শিক্ষাক্রম উন্নয়নের কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। উল্লেখ্য, সর্বশেষ শিক্ষাক্রম ১৯৯৫ সালে প্রণীত হয়েছিল। দীর্ঘ ১৭ বছর পর সরকার নতুন শিক্ষানীতির আলোকে প্রণীত শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এ বছর ১১১টি পাঠ্যবই প্রকাশ করেছে। এ বিরাট কর্মযজ্ঞ অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে সরকার সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। এমনি মহৎ প্রচেষ্টা প্রশংসার্হ।

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে আমার সামান্য সম্পৃক্ততা ছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাক্রমে বিষয় হিসেবে ইতিহাস যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। যা ইতিহাসের ছাত্র-শিক্ষক-অনুরাগী সবাইকে ভীষণ হতাশ করেছে। আমাদের কষ্টের জায়গাটা হলো, শিক্ষানীতির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সঙ্গে নতুন শিক্ষাক্রমে যে ভাবে বিষয় হিসেবে ইতিহাসের স্থান সংকুচিত হয়েছে তা শিক্ষানীতির সঙ্গে কোনোভাবে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। শিক্ষানীতির ৩০টি উদ্দেশ্য, লক্ষ্য ও নীতিগত তাগিদের মধ্যে ৩,৪,৭ ও ৯ নম্বরে যে বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়েছে তা কোনোভাবে অর্জন করা সম্ভব হবে না, যদি না মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাক্রমে ইতিহাসকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

শিক্ষানীতির ৩-নম্বর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যে বলা হয়েছে, "মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করে তোলা ও তাদের চিন্তা-চেতনায় দেশাত্ববোধ, জাতীয়তাবোধ এবং তাদের চরিত্রে সুনাগরিকের গুণাবলীর বিকাশ ঘটানো।" (পৃ-১) অন্যদিকে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাক্রম মূল্যায়ন ও চাহিদা নিরুপণ শীর্ষক গবেষণার আলোকে শিক্ষাক্রম উন্নয়নের নীতিমালার প্রথমটি হলো, "ভাষা আন্দোলনে ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের ভিত্তিতে দেশপ্রেম বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি" করা।

ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হিসেবে ১৮টি বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এর ৩ ও ৪ নম্বরে উল্লেখ করা হয়েছে, "মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধের আলোকে শিক্ষার্থীর মধ্যে দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা এবং সম্ভাবনাময় নাগরিক হিসেবে বেড়ে উঠতে সহায়তা করা। শিক্ষার্থীর মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে সুসংহত জ্ঞানের ভিত রচনা তথা এর ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আর্থ-সামাজিক ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চার প্রতি আগ্রহ ও যোগ্যতা সৃষ্টির মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দেশের প্রগতি ও উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম করে গড়ে তোলা।"

জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটি চূড়ান্তভাবে যে শিক্ষাক্রম অনুমোদন করেছে তার সঙ্গে শিক্ষানীতি ও শিক্ষাক্রমের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ব্যাপক ব্যবধান দেখা যাচ্ছে। ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম শ্রেণিতে সকল ধারার জন্য আবশ্যিক বিষয় আছে ১০টি, নবম-দশম শ্রেণিতে আবশ্যিক বিষয় আছে ৭টি, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে সকল ধারার জন্য বাংলা, ইংরেজি ব্যতীত ১০০ নম্বরে তথ্য ও যোগযোগ প্রযুক্তি অবশ্যিক করা হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের ইতিহাস জানার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। কেবল নবম-দশম শ্রেণির মানবিক শাখার জন্য "বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা" পত্রটি আবশ্যিক করা হয়েছে।

এতে শিক্ষার্থীদের ক্ষুদ্র একটা অংশের কাছে ইতিহাস পৌঁছুতে পারছে। মাধ্যমিকে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ কোটি ৯ লাখ ৩৭ হাজার ৮২০ জন। এ বছর নবম-দশম শ্রেণির মানবিক শাখার জন্য ইতিহাস গ্রন্থের ৭ লাখ ৬০ হাজার ৮৯৪ কপি ছাপা হয়েছে যা মোট শিক্ষার্থীর তুলনায় নিতান্তই অপ্রতুল। শতকরা হিসেবে মাত্র ৭ ভাগ। কিন্তু বিরাট সংখ্যক শিক্ষার্থী যাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক মূল্যবোধে গড়ে তোলার কথা শিক্ষানীতিতে উল্লেখ করা হয়েছে সে কাজ কীভাবে সম্ভব হবে?

কারণ ৬ষ্ঠ থেকে ৮ম পর্যন্ত "বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়" গ্রন্থে ইতিহাসসহ ৬টি বিষয় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। প্রতিটি গ্রন্থে ১২/১৩টি অধ্যায়ের মধ্যে ২/৩টি অধ্যায় ইতিহাসের জন্য বরাদ্দ। এত স্বল্পপরিসরে বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংগ্রামের ঘটনা বর্ণনা করা সম্ভব নয়। নিদেনপক্ষে ১৯৪৭-১৯৭১ পর্বের ইতিহাস না বললেই নয়; সেটাও এ পরিসরে অসম্ভব। তাহলে মহান ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে নতুন প্রজন্ম কি সত্যিই বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে?

নবম-দশম শ্রেণির ব্যবসায় শিক্ষা শাখার জন্য 'বিজ্ঞান' আবশ্যিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে। ঐচ্ছিক তালিকায় "বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়" আছে। এটি কোনো বিবেচনায় যৌক্তিক হতে পারে না। একই শ্রেণির বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জন্য "বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়" বাধ্যতামূলক হলেও ব্যবসায় শিক্ষার জন্য তা ঐচ্ছিক। ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়বে এ নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস তাদের জন্য অপ্রয়োজনীয় হবে কেন ? ইতিহাসকে একেবারে বাতিল না করে বিজ্ঞান ৫০ নম্বর ও ইতিহাস ৫০ নম্বর করে একটা সমন্বয়ের চেষ্টা হতে পারত।

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষাক্রমে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এ পর্যায়ে ৬টি শাখার কোনো শাখার জন্যই ইতিহাস অবশ্যিক বিষয় নয়। সঙ্গীত বিভাগের জন্য ইতিহাস ঐচ্ছিক হিসেবে রাখা হয়েছে। মানবিক শাখায় ইতিহাস/ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি/ইসলাম শিক্ষা পাঠদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ অভিনব ব্যবস্থায় উচ্চ মাধ্যমিকে ইতিহাসপাঠের যে নূন্যতম সুযোগ ছিল তাও মুছে ফেলা হলো। ইতিহাস/ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি হতে পারে। কারণ দুটি বিষয়ের মধ্যে কিছু মিল তো অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু কোন বিবেচনায় ইসলাম শিক্ষা এর অন্তর্ভূক্ত হতে পারে তা মোটেই বোধগম্য নয়।

আমার একটু সুযোগ হয়েছিল ইতিহাসের শিক্ষাক্রম ও নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নে অংশগ্রহণের। শিক্ষাক্রম উন্নয়নে অয়োজিত কর্মশালায় বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষাক্রমে ইতিহাস বিষয়ের প্রতি গুরুত্বপ্রদানের অনুরোধ করেছি। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বিভিন্ন বিষয়ের সমন্বয়ে গুচ্ছ করে দেওয়ার প্রস্তাব করেছি। যাতে অন্তত কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর ইতিহাস পড়া নিশ্চিত করা যায়। দুভার্গ্য, আমাদের কোনো প্রস্তাবই গৃহীত হয়নি। আগে ইতিহাসের শিক্ষকদের অভিযোগ ছিল ইসলামের ইতিহাস সহজ, তাই ইতিহাস না পড়ে ছাত্রছাত্রীরা ইসলামের ইতিহাস পড়ে। কিন্তু বর্তমান শিক্ষাক্রম অনুযায়ী ইসলামের ইতিহাসও পড়বে না, বেশি নম্বরের আকর্ষণে সবাই ইসলাম শিক্ষা নেবে।

এ শিক্ষাক্রম সামগ্রিকভাবে ইতিহাস-বৈরি অবস্থার সৃষ্টি করেছে। এটি 'জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০' এর সঙ্গেও সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তাই জাতীয় স্বার্থে ইতিহাস বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে পুরো শিক্ষাক্রমের একটি পর্যালোচনা হওয়া দরকার। সত্যিকার অর্থে মানবিক গুণসম্পন্ন, আধুনিক, প্রগতিবাদী নাগরিক গড়ে তুলতে চাইলে ইতিহাস অধ্যয়নের বিকল্প নেই। পৃথিবীর বহু দেশে নিজ দেশের ইতিহাসপাঠ বাধ্যতামুলক। ইতিহাসপাঠ আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি অনুগত করে তোলে। একই সঙ্গে চেতনায় বিশ্বজনীনতা এবং মানবপ্রেম জাগ্রত করে। আমরা আরও বেশিমাত্রায় মানবিক হয়ে উঠি।

বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন লিখেছেন "ছাত্র যারা বেরুচ্ছে তাদের মনোজগতে এখন প্রগতির অধিপত্য কম। দেশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা কম। একটাই লক্ষ্য থাকে- কীভাবে বিদেশ বিশেষ করে আমেরিকায় চলে যাওয়া যায়, এ অবস্থাটা কিন্তু আগে ছিল না। আজ যে ছাত্ররাজনীতিতে আদর্শ নেই, টেন্ডার আর খুনখারাবি আছে তার কারণ এটি।.. .. এর একটা কারণ হতে পারে পাঠ্যবই। গত তিন দশকে পাঠ্যবইয়ে প্রগতির চিন্তা ছিল না; ইতিহাসের বিকৃতায়ন হয়েছে, ছাত্রছাত্রীরা বিভ্রান্তির শিকার হয়েছে।… মনোজগতে অধিপত্য বিস্তারের জন্য জরুরি মানবিক বিদ্যা। …নিজের দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে যদি বোধ না জন্মানো যায় তাহলে দেশপ্রেমিক মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষের সংখ্যা ক্রমেই কমে যাবে।" (দৈনিক জনকন্ঠ-১৮.০১.১৩)

ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা, ইসলাম শিক্ষা ও ইসলামের ইতিহাসের ওপর গুরুত্ব দিয়ে যে শিক্ষাক্রম চুড়ান্ত করা হয়েছে, সে শিক্ষাক্রম দিয়ে শিক্ষার্থীদের মনোজগতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সঞ্চার করা সম্ভব নয়। শিক্ষানীতিতে ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার উদ্দেশে বলা হয়েছে, "প্রত্যেক ধর্মে ধর্মীয় মৌল বিষয়সমূহের সঙ্গে নৈতিকতার উপর জোর দেওয়া এবং ধর্মশিক্ষা যাতে শুধু আনুষ্ঠানিক আচার পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে চরিত্রগঠনে সহায়ক হয় সেদিকে নজর দেওয়া।" কিন্তু বাস্তবে পাঠ্যপুস্তকে চরিত্রগঠনের চেয়ে আনুষ্ঠানিকতার বিষয় বেশি প্রধান্য পেয়েছে।

উচ্চ মাধ্যমিকে ইসলাম শিক্ষা স্বতন্ত্র শাখা রয়েছে। একইভাবে ইতিহাস শিক্ষা নামে স্বতন্ত্র শাখা খোলার দাবি আমরা করছি না। ইতিহাসের অস্তিত্বই এখন সংকটাপন্ন। দুর্বল ইতিহাসের শক্ত প্রতিপক্ষ ইসলাম শিক্ষা। কারণ ইসলাম শিক্ষার পক্ষে মৌলবাদীদের জঙ্গী মিছিল রাজপথ প্রকম্পিত করতে পারে। ইতিহাসের দুর্বল চিত্তের ছাত্র-শিক্ষক তা করতে পারেন না।

স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমরা কারও প্রতিপক্ষ নই। জাতীয় স্বার্থে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক কারিকুলামের পর্যালোচনা হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে নই আমরা। বরং এ নীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন সময়ের দাবি। কিন্তু বাস্তবায়নকারী সংস্থা কতটা দক্ষতার সঙ্গে তা করছে- সেটাই বড় প্রশ্ন।

ড. মোহাম্মদ সেলিম : অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি।