সৌরজগতের দূত সাইবেরিয়ার উল্কা

Published : 25 Feb 2013, 04:13 PM
Updated : 25 Feb 2013, 04:13 PM

পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে?
নীরব সুরের রামধনু শুধু দিগন্তে ছবি আঁকে।

পৃথিবীর গান আকাশ কি মনে রাখে? মুকুল দত্ত ও বিমল দত্তের কথায় হেমন্ত গেয়েছিলেন এ গান। অসীম আকাশে মানুষের গানের কি কোনো মূল্য আছে? মহাশূন্যের মাঝে ধাবমান পৃথিবীকে নিয়ে বিশাল মহাবিশ্ব কি কিছু ভাবে? জড় ব্রহ্মাণ্ড হয়তো কিছু ভাবে না, তবু তার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক যে নিবিড় সে কথা আমরা যেন ভুলে যাই। সে ভুল যেন সংশোধন করতেই মাঝে মাঝে শূন্যের মাঝ থেকেই উদয় হয় উল্কাপিণ্ডের, আমাদের বায়ুমণ্ডলে সবুজ হলুদ রঙ্গে উত্তপ্ত হয়ে সে বলে যায় মহাবিশ্বের সবকিছুই চলছে দুরন্ত বেগে, তার মাঝে তোমরা মানুষেরা নিতান্তই অকিঞ্চিৎকর, তবে আমার ও তোমাদের উৎস এক গভীর সূত্রে গাঁথা।

কিন্তু মানুষ যেমন বৃষ্টিভেজা আকাশে রামধনুর প্রতিসাম্য দেখে চমৎকৃত হয় তেমনই আবার রামধনু সৃষ্টি হওয়ার বিজ্ঞান আয়ত্ত করে সে তৃপ্ত হয়। সাইবেরিয়ার আকাশে উল্কার আবির্ভাব এরকমই একটি মূহুর্ত যখন আমরা সেটির উজ্জ্বল পথ দেখে চমৎকৃত হয়েছি; আবার সে উল্কার প্রকৃতি জেনে তার চেয়ে কম আশ্চর্য হইনি।

সাইবেরিয়া যেন উল্কাদের জন্য একটা চুম্বক। সেই ১৯০৮ সনের তুঙ্গুসকা ঘটনার কথা কি মনে আছে? জুন মাসের এক সকালে সাইবেরিয়ার এক গহীন অঞ্চলে কিছু একটা হয়, উজ্জ্বল আলোর রেখায় আকাশ থেকে নেমে আসে একটা কিছু, তার বিস্ফোরণে প্রায় ২,০০০ বর্গ কিলোমিটারেরও বেশি এলাকার গাছ উপড়ে পড়ে যায়। এখন মনে করা হয় সেটা ছিল ১০০ মিটার ব্যাস ও ৭০ কিলোটন ভরের কোনো পাথুরে উল্কাপিণ্ড বা গ্রহাণু; তবে এখনও কেউ কেউ মনে করেন সেটা ছিল একটা ধূমকেতু।

আর ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সালের সকালে, বাংলাদেশের তরুণরা যখন শাহবাগ মোড়ে আন্দোলনে উত্তাল, তখন এরকমই একটা ঘটনা ঘটল সাইবেরিয়ার আরেকটি অঞ্চলে। চেলিয়াবিনস্কের আকাশের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এক উল্কাপিণ্ড। সৌভাগ্যক্রমে এখন অনেক রুশ গাড়িচালকই তাদের ড্যাশবোর্ডে ভিডিও ক্যামেরা চালু রাখেন (এটা দুর্ঘটনাজনিত ইন্সুরেন্স ইত্যাদির জন্য)।

তাদের ধারণকৃত ভিডিওগুলো যদি দেখে থাকেন তবে উল্কাখণ্ডটির বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ মূহুর্তটি খেয়াল করবেন; আমি এটা যে কতবার দেখলাম; মনে হচ্ছিল যেন আকাশের দূত পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, উল্কাটি সেকেন্ডে ১৮ কিলোমিটার বেগে বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করেছে। এরপর অন্তত ২৫ সেকেন্ড ধরে জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডটি আকাশের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ভ্রমণ করল; এর মধ্যে উল্কাটি যখন বিস্ফোরিত হল সেটি সূর্যের চেয়ে উজ্জ্বল ছিল। সাইবেরিয়ার আধো অন্ধকার ভোরে সে বিস্ফোরণের চোখ-ধাঁধানো আলো বাড়ি, বাস, ট্রাম, গাড়ি ও মানুষের ছায়া তৈরি করল। আপনারা যখন ভিডিওগুলো দেখবেন, লক্ষ্য করবেন কেমন করে মাটিতে উজ্জ্বল লাল আলো প্রতিফলিত হচ্ছিল, মনে হচ্ছিল যেন গনগনে আগুনের ঝলকে সবকিছু গলে যাবে।

এখন মনে করা হচ্ছে যে, উল্কাপিণ্ডটির ভর ছিল প্রায় ১০,০০০ টন বা ১০ কিলোটন এবং ব্যাস প্রায় ১৭ মিটার। বায়ুমণ্ডলের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে কয়েক হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াসে উত্তপ্ত হয়ে এটির বিস্ফোরণ হয়। প্রথম বিস্ফোরণটি মাটি থেকে ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার ওপরে সংঘটিত হয়; সেটির শব্দ মাটিতে পৌঁছুতে এক মিনিটের ওপর সময় লেগে যায়। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করা মাত্রই বস্তুটির গতিবেগ হ্রাস পেতে থাকে যতক্ষণ না সেটি চূড়ান্ত গতিবেগ বা টার্মিনাল ভেলোসিটি অর্জন করে। চূড়ান্ত গতিবেগের সময় বস্তুটির ওপর মাধ্যাকর্ষণ বল ও বায়ুজনিত ঘর্ষণ বল বিপরীত দিকে কাজ করে ও তাদের মান সমান হয়।


বিস্ফোরণটি ৫০০ কিলোটন টিএনটির সমান শক্তির ছিল। শক্তির একক জুলের হিসেবে এটা হবে ২০০০ টেরা জুলস বা ২x১০১৫ জুল। হিরোশিমায় যে পারমাণবিক বোমা ফেলা হয়েছিল সেটির শক্তি ছিল ১৬ কিলোটন টিএনটি বা ৬৭ টেরা জুলস। দেখা যাচ্ছে, এ উল্কার বিস্ফোরণে হিরোশিমার চেয়ে ৩০ গুণ বেশি শক্তি নির্গত হয়েছে। কিন্তু হিরোশিমার মতো কোনো ধ্বংসযজ্ঞই তো চেলিয়াবিনস্কে হয়নি? এর মূল কারণ হচ্ছে যে, হিরোশিমার বোমাটি মাটি থেকে মাত্র ৬০০ মিটার ওপরে বিস্ফোরিত হয়। যদি উল্কাটি মাটি থেকে ২৫ কিলোমিটার ওপরে বিস্ফোরিত হত, তবে (৬০০/২৫,০০০)২ x ৩০ ~ হিরোশিমা বোমার ২% শক্তি মাটিতে পৌঁছুত যদি বায়ুমণ্ডল না থাকত। যেহেতু অনেকখানি শক্তি বায়ুতে শোষিত হয়েছে তাই শেষাবধি মাটিতে অনেক কম আঘাত অনুভূত হয়েছে। এ শক্তির অভিব্যক্তিই আমরা দেখেছি যখন একটা বিশাল জায়গা জুড়ে সবগুলো দালানের জানালার কাঁচ ভেঙ্গে গেছে। ১৯০৮ সনে সাইবেরিয়ার তুঙ্গুস্কায় যে উল্কাটি পড়েছিল, ধারণা করা হয় সেটির শক্তি ছিল ১৫ মেগাটন টিএনটি যা কিনা ১৫ ফেব্রুয়ারির ঘটনার ৩০ গুণ বেশি।

কাকতালীয়ভাবে সে সময়ই সারা পৃথিবী ৫০ মিটার ব্যাসের '২০১২ ডিএ১৪' নামের একটি গ্রহাণুর পৃথিবীর নিকট দিয়ে উড়ে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিল। অনেকেই ভেবেছিল, সাইবেরিয়ার গ্রহাণু বোধহয় এর সঙ্গে কোনোভাবে যুক্ত। নাসা থেকে পাওয়া এ ছবিতে সূর্যের চারদিকে '২০১২ ডিএ১৪' ও চেলিয়াবিনস্কের উল্কার কক্ষপথের পার্থকটা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। '২০১২ ডিএ১৪' ও এর কক্ষপথটি ছোট, এবং উল্কার কক্ষপথটি বড়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সাইবেরিয়ার উল্কাটি যখন পূর্ব থেকে পশ্চিমে ছুটে যাচ্ছিল, '২০১২ ডিএ১৪' তখন ভ্রমণ করছিল দক্ষিণ থেকে উত্তরে। কাজেই এ দুটি গ্রহাণু একে অন্যের সঙ্গে কোনোভাবেই যুক্ত নয়।


বিজ্ঞানীরা বলছেন, চেলিয়াবিনস্কের উল্কার ব্যাস হচ্ছে ১৭ মিটারের মতো। এ ধরনের গ্রহাণুখণ্ড কি আগেই আবিষ্কার করা সম্ভব নয়? আমাদের কি অন্তত ২৪ ঘন্টা আগে কোনো সতর্কবাণী দেওয়া যায় না? আমরা জানি, ওই একই সময়ে ৫০ মিটার ব্যাসের '২০১২ ডিএ১৪'কে বিজ্ঞানীরা অবলোকন করছিলেন। এক বছর আগে জ্যোতির্বিদরা এটি আবিষ্কার করেন। তাহলে ১৭ মিটারের গ্রহাণুকে আবিষ্কার করা কি বর্তমান পর্যবেক্ষণ দিয়ে সম্ভব নয়?

সম্ভব। এখানে '২০০৮ টিসি৩' উল্কাপিণ্ডের কাহিনিটি খুব ইন্টারেস্টিং। ২০০৮ সালের এ উল্কার ব্যাস ছিল মাত্র ৪.১ মিটার। আর সেটাকে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের মাত্র ২০ ঘন্টা আগে আবিষ্কার করা গিয়েছিল। আরিজোনার ক্যাটালিনা স্কাই সার্ভের ১.৫ মিটার দুরবিন দিয়ে গ্রহাণুখণ্ডটি দেখা গিয়েছিল। পরবর্তী ২০ ঘন্টায় '২০০৮ টিসি৩'-এর ৫৮৬টি পর্যবেক্ষণ হয় ও বিজ্ঞানীরা এর গতিপথও নির্ধারণ করেন। শেষ পর্যন্ত উল্কাখণ্ডটি সুদানের নুবিয়া মরুভূমিতে পতিত হয়, সেটা বিজ্ঞানীরা অনুসরণ করতে পেরেছিলেন। কাজেই ছোট উল্কাখণ্ড আবিষ্কার করা সম্ভব। যেটা দরকার সেটা হল, কাজটির জন্য যথেষ্ট পরিমাণ পর্যবেক্ষণ। আশা করা যাচ্ছে যে, চেলিয়াবিনস্কের উল্কা আমাদের ছোট গ্রহাণুগুলোকে আগেই আবিষ্কার করতে উদ্বুদ্ধ করবে।

রুশ বিজ্ঞানীরা সাইবেরিয়ার উল্কাপিণ্ডের অবশিষ্ট কিছু ছোট ১ সেন্টিমিটার ব্যাসের খণ্ড উদ্ধার করেছেন। তারা বলছেন, খণ্ডগুলো মূলত পাথুরে, অর্থাৎ লোহার নয়। এবার চিন্তা করুন তো, আজ থেকে প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বা চার হাজার ছ'শো কোটি বছর আগে একটি বড় তারা সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হল। সে তারার অভ্যন্তরে সৃষ্ট পুরো অক্সিজেন, সিলিকন ও লোহা ছড়িয়ে পড়ল সুপারনোভার চারদিকে গ্যাস আকারে। সে গ্যাস মিশে গেল একটা বিরাট হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামের মেঘে। অবশেষে সে মেঘ থেকে যখন সৌরজগতের সৃষ্টি হল- কিছু অক্সিজেন, সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা মিলে তৈরি করল গ্রহাণুদের, অথবা বরফ নিয়ে গড়ে উঠল ধূমকেতু। সেগুলো বড় কোনো গ্রহ হল না, হয়তো কোনো কোনো গ্রহাণু অন্য গ্রহাণুর সঙ্গে সংঘর্ষে ভেঙ্গে গেল। ভাঙ্গা টুকরোগুলোর একটি অংশ সাড়ে চার বিলিয়ন বছর ধরে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে ঘুরতে, পৃথিবীকে এড়িয়ে যেতে যেতে অবশেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ সালে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করল। পৃথিবীতে বাস করে সচেতন মানুষেরা যাদের শরীরের অক্সিজেন, সিলিকন আর ম্যাগনেসিয়াম হয়তো সে একই তারায় সৃষ্টি হয়েছিল যা কিনা ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে সুপারনোভা হয়ে বিস্ফোরিত হয়েছিল।


সৌরমণ্ডলের একদম প্রথমদিকে সৃষ্ট এরকমই একটি ছোট গ্রহাণুর টুকরো নেমে এসেছিল ২০০৬ সালের ৩১শে জানুয়ারি, ঠাকুরগাঁয়ের সিংপাড়া গ্রামে। তবে টুকরোটা ছিল মাত্র ২.৫ কিলোগ্রাম ভরের। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ প্রথম হয়তো কোনো উল্কাপিণ্ড নথিভুক্ত হল। অনুসন্ধিৎসু চক্র বিজ্ঞান সংগঠনের একটি দল ৩রা ফেব্রুয়ারি ওই গ্রামে পৌঁছে প্রাথমিকভাবে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে উল্কাপতনের সাক্ষ্য নেয়। দলটি উল্কাখণ্ডটিকে ঢাকায় বিজ্ঞান যাদুঘরে প্রেরণের ব্যবস্থা করে ও পরবর্তীকালে উল্কার একটি অংশ ভারতের আহমেদাবাদে ফিজিকাল রিসার্চ ল্যাবে গবেষণার জন্য নিয়ে যায়।

গত ১০০ বছরের সবচেয়ে বড় উল্কাপাত ঘটিয়ে চেলিয়াবিনস্কের গ্রহাণু আমাদের জানিয়ে দিল, মহাশূন্যে তাদের মতো অনেকেই ঘুরছে। আজ হোক, কাল হোক তারা উল্কা রেখা হয়ে বায়ুমণ্ডলে আবারও বিশাল শক্তি নিয়ে বিস্ফোরিত হবে। এমনই একটি বিরাট গ্রহাণু, প্রায় ১০ কিলোমিটার ব্যাসের, সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আছড়ে পড়েছিল। তাতে ডাইনোসরসহ পৃথিবীর ৭৫ শতাংশ প্রাণি ও উদ্ভিদ প্রজাতির বিলুপ্তি হয়। আশা করা যাচ্ছে যে, বর্তমান সভ্যতার উন্নত কারিগরি অবস্থা আমাদের সম্ভাব্য গ্রহাণু-আগমনের আগাম সংকেত দেবে।

মহাবিশ্ব নিশ্চয়ই এক বিস্ময়কর জিনিস! তবে শুধুমাত্র অল্প ক'জন জ্যেতির্বিদই সুযোগ পান এর অসীমতার গভীরে দূরবিন তাক করতে? কিন্তু সাইবেরিয়ার উল্কাপাত যেন সাধারণ মানুষের জন্য। সে গ্রহাণু বায়ুমণ্ডলে যে মেঘরেখা এঁকে যায়, যে বিস্ফোরণে গর্জে ওঠে- সেটা যেন সবার জন্য। আর এটাই হচ্ছে মহাবিশ্বের গান। মহাবিশ্বের ছোট্ট এ প্রদর্শনীতে আমরা চমৎকৃত।

দীপেন ভট্টাচার্য : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী জ্যোতির্বিদ।