শাহবাগ ২০১৩: জ্বলন্ত অগ্নির সহোদরা

উম্মে রায়হানাউম্মে রায়হানা
Published : 22 Feb 2013, 05:12 PM
Updated : 22 Feb 2013, 05:12 PM

শাহবাগ অভিজ্ঞতা ১

প্রাচ্যনাটের পথনাটক চলছিল। বন্ধু সাইফুল দর্শকদের দিকে লক্ষ্য করে শুরু করলেন- 'আমরা কী চাই? কাদেরের ফাঁসি। ফাঁসি দিতে হইলে কী লাগব? আপনাদের ঘাড়ে গামছা আছে না? চাদর আছে না? মা-বইনদের ওড়না আছে না?' বলতে বলতে থেমে গিয়ে 'সরি' বলতেই আমি আর আরেক নারী ওর দিকে গায়ের ওড়না ছুঁড়ে দিলাম। দর্শকদের মধ্যে থেকে জোগার করা হল দড়ি পাকানোর শ্রমিক অর্থাৎ ব্যাকগ্রাউন্ড আর্টিস্ট। তাদের মধ্যে আমিও একজন। ওড়না ছাড়াই পুরো সময় দাঁড়িয়ে দড়ি পাকাতে পাকাতে কোরাসে গলা মেলালাম- 'পাকা রে পাকা রে পাকা, দড়ি পাকা, কসাই কাদেরের ফাঁসি হবে, দড়ি পাকা কইষা।' এ গল্প বলার কারণ হল শাহবাগে এক অভূতপূর্ব নারীবান্ধব পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আপনার বয়স ১৫ হোক বা ৫৫, আপনার পোশাক হিজাব হোক বা লেগ ইনস– নারী হিসেবে আপনি কোনোরকম নিগ্রহের শিকার হবেন না। কারণ আপনিও যে একজন যোদ্ধা।

ঢাকার শাহবাগে দু'সপ্তাহ ধরে চলছে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের যথাযথ শাস্তির দাবিতে অবিরাম আন্দোলন। এতে সামিল হয়েছেন শহর ও শহরের বাইরের সর্বস্তরের নারী ও পুরুষ। যারা উপস্থিত হতে পারেননি তারা সংহতি জানিয়েছেন। একজন কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে এখন এ আন্দোলন সীমাবদ্ধ নেই। জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, জামায়াতি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবিসহ আন্দোলনের অর্জন অনেক। ব্লগার রাজীব হায়দারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড এ আন্দোলনের কারণে ঘটেছে। তার জামায়াত-বিরোধী, এমনকি নাস্তিক অবস্থান সত্ত্বেও শাহবাগ মোড় থেকে চারুকলা ইন্সটিটিউট পর্যন্ত দীর্ঘ হয়েছে তার জানাজায় সমবেত জনতার সারি।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী লাকী আক্তারসহ আরও কিছু ছাত্র সংগঠনের নারীকর্মীদের 'অগ্নিকন্যা' বলে ঘোষণা করে এদেশের প্রধান গণমাধ্যমগুলো। শাহবাগে তাদের লাগাতার অবস্থান ও শ্লোগান দেওয়া, মানুষকে একাত্ম হওয়ার আহবান জানানো ও সফল হওয়া এ ঘোষণার কারণ। অগ্নিকন্যাদের অবদান মনে রেখেও বলা যায়, তারা ছাড়াও শাহবাগে আছেন বিভিন্ন বয়স ও পেশার বিপুল সংখ্যক নারী। শ্রেণির দিক থেকে এরা প্রধানত মধ্যবিত্ত। পেশায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক, চাকুরিজীবী, গৃহিণী। এদের কারও উপস্থিতিই কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

নারীর এ অংশগ্রহণ ও অবস্থান সার্বিকভাবে এ দেশের নারীর অবস্থার সঙ্গে একদমই মেলে না। ইভটিজিং-এর নাম করে যৌন নিপীড়নকে লঘু করে তোলা পুরুষতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা যেখানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে লিখে রাখে 'হর্ন দেওয়া নিষেধ, ধূমপান নিষেধ, ইভটিজিং নিষেধ' অথবা গণমাধ্যম যখন পুরুষতান্ত্রিক বিষয়বস্তু সম্বলিত সংবাদ, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপন প্রচার করে বিনা বাধায়, সমাজের দোহাই দিয়ে- সেখানে এত বড় জমায়েতে নারীর এমন স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ বিস্ময় জাগায় বটে!

এ অংশগ্রহণ ও অবস্থানের কারণ অনুসন্ধান করলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে আসে। শাহবাগে উল্লেখযোগ্য কোনো যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেনি। রাজাকারের ফাঁসির দাবিতে একত্রিত হওয়া মানুষদের মধ্যে কি ধর্ষক-নিপীড়ক নেই? তারা কি শাহবাগের অগ্নিকন্যাদের ভয়ে এখান থেকে শতহস্ত দূরে আছে? মনে রাখতে হবে, ধর্ষক বা যৌন নিপীড়ক বলে আলাদা কোনো জাতি বা দল নেই বলেই তাদের রাতারাতি উধাও হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ধর্ষক-নিপীড়করা অগ্নিকন্যাদেরই বাবা, ভাই, বন্ধু, প্রেমিক ও স্বামী। তাহলে তাদের নিষ্ক্রিয়তার কারণ কী?

শাহবাগে যে শ্লোগানগুলো মুহুর্মুহু শোনা যাচ্ছে, যেসব দেশাত্মবোধক গান বেজে চলেছে- সেসবে নারীর স্থান উপস্থিত নারীজাতির প্রতিনিধির চেয়েও ব্যাপক। ধর্ষণ একটি যুদ্ধাপরাধ। এদেশে সেটা কখনও উচ্চারণ করা হয় না। বলা হয়, '৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে এবং ৩ লাখ মা-বোনের ইজ্জত/সম্ভ্রম/সর্বোচ্চ ত্যাগ/আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীনতা।' ধর্ষিত বোনের শাড়ি দিয়ে আমরা পতাকা বানিয়ে ফেলতেও রাজি আছি। কিন্তু ধর্ষিত নারী মাত্রই আমাদের বোন নন। বরং সমাজে ধর্ষিতার স্থান নিম্নতম স্তরে। আবার আমাদের কাছেই যুদ্ধে ধর্ষিতা বোনের 'সম্মান' পেয়েছেন। দেশ যে আমাদের মায়ের সমান এ কথা সবসময় এত বেশি বলা হয়েছে যে এ সম্পর্কে নতুন করে আলোচনা অর্থহীন। তবে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ধর্ষিত বোনের মতো ধর্ষিত মা কিন্তু এতটা উচারিত নয়- যেমন যুদ্ধশিশু প্রসঙ্গও নয়।

'মা-বোন' বিষয়ক গান বা শ্লোগানের সঙ্গে যৌন নিপীড়ন না ঘটার সম্পর্ক খুব পরিষ্কার। ঐতিহাসিকভাবেই এ দুটো সম্পর্ক দিয়ে নারীর 'অযৌন' ইমেজ নির্মাণ করা হয়। নারীকে আলাদাভাবে 'অযৌন' করে তোলার প্রয়োজন পড়ে। কারণ সমাজের মূল স্রোতে নারীর প্রধান ইমেজ আদতে 'যৌন' ইমেজ। সেটা বিলবোর্ডে পণ্য নারী থেকে শুরু করে ড্রইংরুমে নিজ কন্যাকে (যে একজন নারী) পাত্রপক্ষের সামনে প্রদর্শন পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে।

এ 'অযৌন' নির্মাণের পেছনের কারণগুলোও ইতিহাস বলে দিতে পারে। প্রথমত, এ ভূখণ্ডের মানুষের প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসে আদ্যাশক্তির (দেবী) উপাসনার ফলাফল। দ্বিতীয়ত, এ ভূখণ্ডে জাতিরাষ্ট্র উদ্ভবের সময় থেকে 'জাতি' ধারণা নির্মাণে সহায়ক শক্তি হিসেবে 'মা' ধারণা অন্যান্য সব কমন ফ্যাক্টরের (ধর্ম ,বর্ণ, ভাষা) চেয়ে বেশি শক্তিশালী হওয়ায় এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করার ধারাবাহিকতা রয়েছে।

প্রয়োজনমতো নারীকে যৌন/অযৌন করে তোলা, পণ্য/বস্তু/কর্মী/পবিত্র/মা/বোন ইত্যাদি বানিয়ে তোলা, ঘরের বাইরে বের করা ও ঘরে বন্দী করে রাখা, শিক্ষিত করে তোলা ও অশিক্ষিত করে ফেলে রাখা- এসবই পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থার বহুব্যবহৃত কৌশল। ফলে দেশমাতৃকা একটি উদ্দেশ্যমূলক ধারণা বললে ভুল বলা হয় না। ধর্ষিত বোনের শাড়ি দিয়ে তৈরি পতাকাও একটি অতি আবেগপ্রসূত প্রতারণামূলক বয়ান। যুদ্ধপরবর্তী সময়ে ধর্ষিতা পুনর্বাসন থেকে শুরু করে এ সময় পর্যন্ত ধর্ষিতা শব্দের বদলে 'বীরাঙ্গনা' শব্দের (এটাও নারীর 'অযৌন' ইমেজ) নির্মাণ ও প্রয়োগ সে সাক্ষ্যই দেয়। ফলে এ সব বিশেষণ ও আবেগ সার্বিকভাবে নারী ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

কিন্তু শাহবাগের গণজাগরণ একভাবে এ নির্মাণের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা দেয়। কারণ এর ফলে নারীরা ঘরের বাইরে এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সামিল হতে পারেন। শাহবাগের নারীবান্ধব পরিস্থিতির পেছনে এ 'অযৌন' নির্মাণের ভূমিকা কিছুটা হলেও আছে। এছাড়া এখন আন্দোলনের প্রধান ও প্রথম দাবি যুদ্ধাপরাধের বিচার, জামায়াতে ইসলামীর বিনাশ, রাজীবের হত্যাকারীদের বিচার। এ সময় জাতীয়তার চেতনা নির্মাণে নারী কতটা বলি হল বা ব্যবহৃত হল তা হিসেব করার সময় নয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে যে, এর পক্ষে দাঁড়ানো, অর্থাৎ মা-মাটি-দেশ/ মা-মক্কা-মদীনা/ মা–পবিত্রতা ইত্যাদি ধারণা আদতে ক্ষতিকর ও বিভ্রান্তিমূলক। এসব ধারণা একই সঙ্গে নারীকে 'অযৌন' করে 'মা' করে তোলে, উল্টোদিকে দেশকে মা বানিয়ে (সম্পদ ও সম্মান প্রশ্নে) বহিরাগত লুঠেরা শ্রেণিকে ধর্ষক বানিয়ে পুরুষাধিপত্যবাদী ধারণাকেই সমৃদ্ধ করে।

শাহবাগের গণজাগরণে কেবল নারীর 'অযৌন' নির্মাণই ক্রিয়াশীল থেকে নারীকে রক্ষা করছে– এ কথা মনে করলে ভুল ভাবা হবে। আমাদের অগ্নিকন্যারা আমাদের মধ্যে সবসময় ছিলেন। প্রতিটি আন্দোলনে-সংগ্রামে নারীর অবদান ও অংশগ্রহণ সব যুগেই অবহেলিত ও অস্বীকৃত হয়ে আসছে বলে আমরা অনেক কষ্টে প্রীতিলতাকে স্মরণ করি, তা-ও সবসময় নয়। আমরা ভুলে যাই কল্পনা দত্ত, শান্তি ঘোষ, সুনীতি চৌধুরী, বীণা দাস, লীলা রায়, ননীবালা দেবী, দু'কড়িবালা দেবী, মাতঙ্গিনী হাজরা এবং আরও অনেক বিপ্লবী নারীর নাম যারা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। শ্রমিকনেত্রী সন্তোষকুমারী দেবী, দুখুমত বিবির অবদান আমরা মনে রাখি না। নাচোলের সাঁওতাল বিদ্রোহের কিংবদন্তী নেত্রী ইলা মিত্রের নাম কখনও-সখনও সামনে এলেও ভাষা আন্দোলনে সক্রিয় তৎকালীন মহিলা মুসলিম লীগের নারীদেরও আমরা স্মরণ করি না।

তবু মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রচলিত বয়ানে নারী সর্বদাই 'ধর্ষিত' মা-বোন বা দয়ার পাত্রী হিসেবে হাজির হয়েছেন, শুধু 'আক্রান্ত' ইমেজে আটকে গেছেন, বীরাঙ্গনা নাম বহন করেছেন। সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধা রোজিনা আনছারী, আলমতাজ বেগম, নাজিয়া ওসমান চৌধুরী, স্বপ্না দত্ত চৌধুরী, সখিনা বেগম, রশেনারা বেগম, আশালতা বৈদ্য, জিন্নাত আরা, করুণা বেগম, মিরাসি বেগম, আমেনা আজাদ, জয়গুন বিবি, মোহসেনা বেগম- এমন আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার নাম আমরা নিই না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যেসব গান-কথিকা-কবিতা পাঠে উদ্বুদ্ধ হয়ে এ দেশের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছেন, সে অনুষ্ঠানে যে নারীরা নির্ভীকভাবে অংশ নিয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন বুলবুল মহলানবিশ, নাজনীন নীনা, রুপা ফরহাদ, ফ্লোরা আহমেদ, মঞ্জুলা দাশগুপ্ত, আইভি রহমান, কুলসুম আসাদ, দীপ্তি লোহানী, শওকত আরা আজিজ, বাসনা গুণ, পারভীন আখতার, রত্না ঘোষাল প্রমুখ। যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে মুক্তির গান গেয়ে বেরিয়েছেন লুবনা মরিয়ম, নাশিদ কামালসহ আরও অনেকে।

মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে নব্বই-এর গণঅভ্যুত্থান, সাতানব্বইয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, ২০০১ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন্নাহার হলের আন্দোলন– সব ক্ষেত্রেই নারীর অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য ছিল। ফলে এটা দাবি করা যায় যে, এদেশের নারীর বিপ্লবী ভূমিকা নতুন বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।


শাহবাগ অভিজ্ঞতা ২

আমি নিজে কোনো বিশেষ ধর্মে বিশ্বাস করি না। তাই বলে অন্যের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করি না। নাস্তিক-আস্তিকের বদলে বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী শব্দ দুটো ব্যবহার করি। অর্থ এক হলেও পরিবেশনের দিক দিয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে হওয়ায় এ সচেতন নির্বাচন। ব্লগার রাজীব হায়দারের জানাজা পড়া ঠিক না ভুল, এতে তাকে সম্মান জানানো হয় না অসম্মানিত করা হয়, এ দোটানায় না থেকে হাজির হয়েছিলাম জানাজার জামায়াতে। যদিও আন্দোলনকারীদের সবাই ইসলামে বিশ্বাসী হবেন সেটাও বলা যায় না। দুয়েক জায়গায় তাড়া খেতে হল– 'ওই দিক দিয়ে যান, এখানে জানাজা চলছে।' পাত্তা না দিয়ে ফাঁক-ফোকর গলে একটা দলের সঙ্গে গিয়ে জুটলাম যেখানে প্রত্যেকেই নারী। দলের পুরুষেরা জানাজায় শামিল হতে গেছেন বলেই এ নারী-প্রাধান্য। জানাজার সময় আমরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম। জানাজা শেষে বন্ধু রেবেকা নীলার তিক্ত অভিজ্ঞতা শুনলাম। তিনি মারমুখী পুরুষদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে তর্কে যাননি কিন্তু দাঁড়িয়েই ছিলেন। ওর যুক্তি ছিল– ''আমরা তো এতদিন ধরে এখানেই আছি। এখন হঠাৎ করে 'নাই' হয়ে যেতে পারি না।''

ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, বেশিরভাগ ধর্ম প্রথম গ্রহণ করেছেন নারীরাই। ইসলাম আর বৌদ্ধ ধর্মমতের গল্প সবাই জানেন। নারীরা প্রচলিত ধর্মে নিপীড়িত হন বলেই নতুন ধর্ম গ্রহণে তাদের মধ্যে আগ্রহ দেখা যায়– এমন অনুমান অসঙ্গত নয়। আবার প্রচলিত সব ধর্মেই দেখা যায়, ধর্মীয় রীতিনীতিগুলো পালন করেন নারীরাই। তারাই বেশি ধর্মপ্রাণ বলে পরিচিত। আবার ধর্মের শৃঙ্খল ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে বা ধর্মের নতুন ব্যখ্যা বিশ্লেষণ করে সমাজকে এগিয়ে নিতেও তারা সবসময় অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন। সমাজে ধর্মের নামে নিপীড়ন রোধে নারীর এ ভূমিকা বহাল রেখেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় নারীকর্মীরা।

শাহবাগের নারীকর্মীরাও ব্যতিক্রম নন। ধর্মের নামে লুঠতরাজ-খুন-ধর্ষণের পক্ষে কোনো নারীকে পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না, তা তিনি বিশ্বাসী হোন আর অবিশ্বাসীই হোন। শাহবাগে আন্দোলনরত নারীদের নিয়ে ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে কুৎসা রটনার প্রক্রিয়া। সাম্প্রদায়িক শক্তি তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে যেসব ঘৃণ্য কথাবার্তা প্রচার করছে তার মধ্যে সত্যতার লেশমাত্র নেই। নারীকে অপমান করা, আঘাত করা, কলুষিত ও কলঙ্কিত করার পুরানো পদ্ধতি ব্যবহার করছে ধর্মান্ধ গোষ্ঠী। এসব প্রচারের বিরুদ্ধে মুক্তবুদ্ধির মানুষ কতটা সোচ্চার তার প্রমাণ মেলে শাহবাগে নারীদের অবিরাম উপস্থিতি দেখে।

শুক্রবার দুপুর থেকে সারাদেশে জামায়াত-শিবিরের ব্যাপক নাশকতামুলক কর্মকাণ্ডের পর শাহবাগ পুনরায় জেগে উঠেছে। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে নারীর উপস্থিতি ব্যাপক। ভাঙচুর, গোলাগুলি, জঙ্গি মিছিল, দা, চাপাতি কোনো কিছুকেই ভয় না পেয়ে পুরুষদের সঙ্গে আবারও রাজপথে নেমে এসেছেন আমাদের নারীরা, আমাদের অগ্নিকন্যারা। এ সময়ে সার্বিকভাবে নারীর নিরাপত্তা এত দুর্লভ একটি বস্তু যে শাহবাগ কেবল বিস্ময়ই জাগায়।

শাহবাগে আন্দোলনে সক্রিয় এবং সংহতি জানাতে আসা নারীর মধ্যে অমিত সম্ভাবনা রয়েছে দেশজুড়ে একটি শক্ত অবস্থান নিয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার। একজন কাদের মোল্লার ফাঁসি যেমন কোনো সমাধান নয় বলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক অবস্থানকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে শাহবাগ- তেমনি একজন বিচ্ছিন্ন ধর্ষকের বিচার বা শাস্তি নয়, ধর্ষক তৈরির কারখানা ধর্ষকামী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকেও প্রশ্নবিদ্ধ করা ও পুনর্নির্মাণ করা সম্ভব শাহবাগ থেকেই।

শুরু হোক যাত্রা। এ পথচলা আরও কঠিন। দেশমাতৃকার 'অযৌন' নির্মাণ, দেবীত্ব আরোপ ইত্যাদি উপাদান সঙ্গে থাকবে না। নারী শরীর প্রদর্শনকারী বিলবোর্ড কখনওই ঢেকে যাবে না ধর্ষকের ফাঁসির দাবিতে। গণমাধ্যম এভাবে কভারেজ দেবে না। পুরুষতন্ত্র যুগে যুগে প্রয়োজনমতো নারীকে ঘর থেকে টেনে বের করেছে, কাজ ফুরালে ঠেলে ঘরে ঢুকিয়েছে। এবার যেন আমরা আর ঘরে ঢুকে না যাই।

নারীর জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার সংগ্রাম চলতে থাকুক ।

উম্মে রায়হানা: স্নাতকোত্তর, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।