ব্লগারদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার : যুদ্ধাপরাধীদের ঘৃণ্য কৌশল

কৌশিক আহমেদ
Published : 22 Feb 2013, 10:10 AM
Updated : 22 Feb 2013, 10:10 AM

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবিতে উত্তাল জনতাকে রাজপথে নামিয়েছিল ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা। যুদ্ধাপরাধীরা প্রতিশোধ নিতে চাইবে কাদের বিরুদ্ধে? লাখ লাখ জনতা বা রাজনীতিবিদদের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করার কোনো সুযোগ নেই। তাই ব্লগাররা এখন তাদের সহজ টার্গেট।

বেশিরভাগ ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট শাহবাগ আন্দোলনে শরীক হয়েছেন সাধারণ জনতার মতোই, ফেসবুক বা ব্লগ পড়ে, মিডিয়া দেখে। পুরো আন্দোলন চালিয়ে নিয়েছেন সাধারণ জনতা, তাদের দাবি নিয়ে। জাগ্রত জনতার পথ বন্ধ করতে না পেরে যুদ্ধাপরাধী-চক্র খুন করেছে একজন ব্লগারকে। এতেই থেমে থাকেনি তারা, ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টদের মুখ বন্ধ করার জন্য তাদের ব্যক্তিগত ব্লগগুলো পত্রিকায় ছাপিয়ে দিচ্ছে।

মেইনস্ট্রিম মিডিয়া ও সোশ্যাল মিডিয়ার মধ্যে যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে তা প্রত্যেক ব্লগারই জানেন। ওয়েবের বিস্তৃত পরিসরে মতপ্রকাশ নানা প্রযুক্তিগত কারণেই বন্ধ করা সম্ভব নয়। যদি সে চেষ্টা করাও হয়, সফলতা আসে সামান্যই। উদাহরণস্বরূপ ইউটিউবের কথা বলা যায়, কাগজে-কলমে বন্ধ করা হলেও যে কেউ চেষ্টা করলে একটু ভিন্নপথে ইউটিউবে প্রবেশ করতে পারেন।

ইন্টারনেট-ভিত্তিক আন্তর্জাতিক সামাজিক গণমাধ্যমে মূলত বাংলাদেশের বেশিরভাগ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সক্রিয়। ব্লগ-প্লাটফর্মগুলো সে তুলনায় অনেক ক্ষুদ্র পরিসরে ও স্থানীয়ভিত্তিক হলেও বন্ধ করা অসম্ভব। সোনার বাংলা ব্লগ বন্ধ করা হলেও বিডি টুডে নামে তারা ফিরে এসেছে, সেখানে সোনার বাংলা ব্লগের আইডি দিয়ে আগের সদস্যরা ব্লগিং করতে পারছে।

গুগল সার্চ করলে সারা বিশ্বের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা হাজারও ধর্মবিরোধী বক্তব্য পাওয়া যাবে। সমাজবিরোধী বক্তব্য, নৈরাজ্য-সৃষ্টির উস্কানি, এমনকি নির্বিচারে মানুষ খুন করার পক্ষে নির্লজ্জ ওকালতিও পাওয়া যাবে। ওয়েব থেকে ওগুলো মুছে ফেলা সম্ভব নয় এবং কারও আগ্রহ না থাকলে সেসব তাকে কেউ জোর করে পড়াতেও পারবে না। ফলে এখন উদ্দেশ্যমূলকভাবে এসব লেখা প্রচার করা যুদ্ধাপরাধী-চক্রের প্রধান হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আর এভাবে আপনাকে এসব পড়তে বাধ্য করা হচ্ছে।

উদ্দেশ্যমূলকে এসব প্রচারণার মাধ্যমে ব্লগ ও সোশ্যাল মিডিয়ার কোনো কনটেন্ট বাতিল করা সম্ভব নয়, প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণেই। প্রায়ই এসবের লেখককে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না তাদের ছদ্মনাম ও ছদ্ম-ঠিকানার কারণে। ফলে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এক সংঘাতময় প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ব্লগারদের বেশিরভাগই আস্তিক এবং তারা এসব পোস্ট বা লেখা এবং লেখককে সহজেই তার প্রোফাইল থেকে মুক্ত রাখতে পারেন, ব্লক বা ব্যান করতে পারেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় সেটাই বহুল-চর্চিত, ব্যক্তির উপযোগী করে তার ওয়েব স্পেসকে কাস্টমাইজ করে নেয়ার সুযোগ রাখা। প্রত্যেকটা প্লাটফর্ম সে সুবিধা প্রদান করে।

কিন্তু যুদ্ধাপরাধী-চক্র দেশের বেশিরভাগ মানুষ, যারা সোশ্যাল মিডিয়ার এসব চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে অবগত নন, তাদের কাছে উল্টোভাবে তুলে ধরছে ব্লগারদের পরিচয়। তারা খুব ভালো করেই জানে সোশ্যাল মিডিয়া কী জিনিস এবং একই সঙ্গে তারা জানে সাধারণ মানুষের এ বিষয়ে ধারণা নেই। এ গ্যাপটুকু কাজে লাগিয়ে ব্লগারদের মুখ বন্ধ করার জন্য সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে তাদের এ ঘৃণ্য প্রচারণা।

কিন্তু এভাবে ব্লগের লেখা ও বক্তব্য বন্ধ করা যায় না। রাজীবের মতো আরও কিছু ব্লগারকে হত্যা করে ওরা হয়তো কিছু মুখ বন্ধ করতে পারবে। যুদ্ধাপরাধী-চক্রের সরসারি টার্গেট হিসাবে ব্লগাররা থাকলেও এটা মূলত সারাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে একটা সতর্কবার্তা দেওয়ার চেষ্টা। সুতরাং রুখে দাঁড়াতে হবে দেশের মানুষকেই। একই সঙ্গে ব্লগারদেরও ঐক্যবদ্ধভাবে তুলে ধরতে হবে ব্লগের বহুমাত্রিকতা।

ব্লগার মাত্রই জানেন, সংখ্যাধিক্য মানুষ ধর্মীয় সংঘাতমূলক পোস্ট ও লেখালেখি পরিহার করে থাকেন। ধর্ম নিয়ে যুক্তিনির্ভর পোস্ট, তা যারই হোক না কেন, নাস্তিক অথবা আস্তিক, সেখানে জমে ওঠে জমজমাট বিতর্ক। এসব ব্লগ দেশ-বিদেশের তুলনামূলক ধর্মতাত্ত্বিক আলোচনার আর্কাইভে পরিণত হচ্ছে। আস্তিকদের জন্য তা যেমন প্রয়োজনীয় হিসাবে পরিগণিত হয়েছে, নাস্তিকদের জন্যও তেমনি। কেউ যদি গঠনমূলক যুক্তনির্ভর লেখা নিয়ে এখানে হাজির হন, তবে তার অনুসারী তৈরি হতে সময় লাগে না। কিন্তু নির্জলা অযৌক্তিক আস্ফালন দিনশেষে হারিয়ে যায় ওয়েবের গহবরে।

সুস্থ-স্বাভাবিক এ তার্কিক অবস্থানের ভেতরে কেবলমাত্র যুদ্ধাপরাধী-চক্র সবসময় ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। ব্লগে যেখানে উভয়মুখী মতপ্রকাশের সুযোগ থাকে সেখানে যুক্তির বদলে পাল্টা যুক্তি প্রদান করা যায়। বেশিরভাগ ব্লগার সেটা করে থাকেন। এর ভেতরে কিছু অপতৎপরতাও লক্ষ্য করা যায়। ব্যক্তি-আক্রমণের ঘটনা ঘটে, যা সংশ্লিষ্ট ব্লগ-প্লাটফর্মকে রিপোর্ট করা হলে সেসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়। কিন্তু ব্লগের বাইরে রয়েছে হাজার হাজার পেইড/ফ্রি সাইট– যা এককভাবে পরিচালিত হয়। একটা ডোমেইন কিনে, ওয়ার্ড প্রেস ইনস্টল করে এমন ওয়েবে ব্লগিং করার জন্য খুব বেশি প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকার দরকার নেই। সার্চ করে পাওয়া গেলেও এসব মূলত বিচ্ছিন্ন ও সাধারণের মধ্যে প্রভাব ফেলতে সক্ষম নয়। কিন্তু যুদ্ধাপরাধী-অপশক্তি ধর্মবিষয়ক নানামুখী চিন্তা, যার মধ্যে ধর্মহীনতা অবশ্যম্ভাবী হিসেবে রয়েছে, সেসব যুক্তি দিয়ে মোকাবেলা করে না। তাদের অপরাজনীতির জন্য এসব লেখা লাভজনক হিসেবে বিবেচিত হয়। তাই তারা এসব পত্রপত্রিকায় ছাপিয়ে দিয়ে জনসাধারণের মধ্যে ভুল ধারণা পৌঁছে দিচ্ছে।

যেসব ধর্মবিরোধী পোস্টের কথা বলা হয়, তার মন্তব্যাংশে অন্যান্যদের যুক্তির ফলে পোস্টদাতা কখনও কখনও ভুল প্রমাণিত হন। আবার ধর্মের নামে যুদ্ধাপরাধী চক্রের কোনো উদ্দেশ্যমূলক পোস্টের মোটিভ সচেতন ব্লগাররা সহজেই চিহ্নিত করে ফেলতে পারেন। এ মন্তব্য-প্রতিমন্তব্য কোনোভাবেই একপক্ষীয় নয় এবং এর খণ্ডিত অংশ প্রকাশ করে কখনওই আসল চিত্র অনুধাবন করা সম্ভব নয়। পত্রিকায় এর প্রকাশ ব্লগ ও ব্লগার সম্পর্কে উল্টো ধারণা ছড়াতে সক্ষম। আর এটাই মূলত এ চক্রের লক্ষ্য।

সব ব্লগার ও ব্লগ-প্লাটফর্মকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, ব্লগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার রুখে দিতে হবে। বোঝাতে হবে ব্লগে এসে এর উত্তর দেওয়ার জন্য। সেটাই সঠিক প্রতিরোধ হতে পারে। বাইরে থেকে যেমন দেখছেন, আসলে এটা তেমন একপক্ষীয় কোনো কৌণিক অবস্থানের জায়গা নয়। বাংলাদেশের সব ব্লগ-প্লাটফর্মই সবার স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য উন্মুক্ত, একমাত্র যুদ্ধাপরাধী-চক্র ছাড়া। তাদের সব ব্লগেই প্রতিরোধ করা হয় ঐক্যবদ্ধভাবে। এজন্য তাদের সব আক্রোশ এসব জনপ্রিয় ব্লগ ও ব্লগারদের বিরুদ্ধে। শাহবাগের গণজাগরণ যুদ্ধাপরাধী চক্রকে পুরো বাংলাদেশেই অবরুদ্ধ করে ফেলেছে, যার সূচনা ঘটেছিল ব্লগে।

ব্লগ ও ব্লগারদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার যদিও ব্লগ লেখার ধারা ও পদ্ধতি বিন্দুমাত্র পাল্টাতে পারবে না, অপপ্রচারকারীরা পরিণত হবে ব্লগারদের নির্দয় সমালোচনার পাত্রে, তারপরও আশঙ্কা থেকে যায় যে, অপপ্রচারের ফলে কিছু ব্লগার হয়তো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবেন। সেজন্য অপপ্রচার রুখে দিতে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে– নইলে শাহবাগের উদাহারণ তো চোখের সামনেই রইল। একজন ব্লগারের জীবন যদি নিরাপত্তাহীন হয় তবে ব্লগাররা এরপর যা করবেন তাতে শাহবাগের গণজাগরণে বিস্ফোরণ ঘটবে, শতগুণ তীব্রতার সঙ্গে।

কৌশিক আহমেদ : ব্লগার ও গল্পলেখক।