ভাষার লড়াই দেশে দেশে

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান
Published : 20 Feb 2013, 06:21 PM
Updated : 20 Feb 2013, 06:21 PM

রাজার ধর্ম প্রজার ধর্ম। রাজার ভাষা প্রজার ভাষা। এমন কথা রাজতন্ত্রে সহজেই মেনে নেওয়া হয়। সেই কথা উচ্চারিত হয় উপনিবেশ প্রভুদের প্রাধান্য বিস্তারের তত্ত্বে। দেশে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে প্রশ্ন ওঠে প্রজাতন্ত্রের প্রজার ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হবে না? বাদ যাবে ঐক্যবাদ গণতন্ত্রের দাবি। এক দেশ এক ভাষা। সেই বাচনভঙ্গি কোনো কোনো সময় বিকৃত হয়ে আস্ফালন করে এক দেশ, এক জাতি, এক ধর্ম, এক নেতা। এই দৃষ্টিভঙ্গীর মাঝে অক্টোপাশের নিপীড়ন ক্ষুধা নিহিত রয়েছে। এই দৃষ্টি মানুষের মনে এক অপরাধ বোধের সৃষ্টি করে, আবার ক্ষোভেরও সৃষ্টি করে, লোকে যখন নিজের ভাষা বলতে লজ্জা পায়, বা লোকে যখন নিজের ভাষা ব্যবহার করতে বাধা পায়।

পৃথিবী এক ভাষা হলে ভাষার লড়াই হতো না। ভাষা নিয়ে লড়াই হয়েছে দেশে দেশে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সংখ্যালঘিষ্ঠদের ঝুঁকি ওপর একটি ডেটাসেট তৈরি হয় প্রফেসর টেড কার-এর পরিচালনায়। ওই ডেটাসেট-এর ওপর ভিত্তি আরো গবেষণা করেন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জেমস ডি. ফেয়ার অন ও ডেভিড ডি লেইটিন। ওই সব গবেষণা লব্ধ তথ্যাদি থেকে জানা যাচ্ছে গত পাঁচ-ছয় দশকে ১২৭টি গৃহযুদ্ধ হয়েছে এবং এক কোটি ৭০ লক্ষ লোক মারা গেছে। প্রায় প্রত্যেক বছর ২৩১টি নতুন গৃহযুদ্ধ সূচিত হয়েছে। যে গতিতে গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটে তার চেয়ে অধিকতর গতিমাত্রায় তা বৃদ্ধি পায়। দেশের সংখ্যা ও নতুন স্বাধীন দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ওই সব গৃহযুদ্ধের কারণে। ১৯৬০ সালের পর ১৭টি দেশে ২৩টি সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠী অধিকতর সরকারি স্বীকৃতি লাভ করেছে। মাত্র চারটি দেশে কেবল নয়টি গোষ্ঠীর স্থানীয় ভিত্তিতে স্বীকৃত ভাষার স্বীকৃতি কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক প্রত্যাহার করা হয়েছে। ১৯৪৫ সাল থেকে দশটি দেশে যেখানে সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীর ভাষা সমূহকে আগে স্বীকার করা হতো না সেখানে তাদেরকে সীমিতভাবে সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে দুটি রাষ্ট্র ওই আঞ্চলিক স্বীকৃতি প্রত্যাহার করেছে। ১৯৪৫ সালের পর থেকে চারটি দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে গ্রহণ করে এবং একই সময় পাঁচটি দেশ প্রধান গোষ্ঠীর ভাষার বাইরে অন্যান্য ভাষা সমূহকে উদার দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে গ্রহণ করেছে।

সাংস্কৃতিক ক্ষোভের থেকে গৃহযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে রাষ্ট্রশক্তির হেরফেরের জন্য। অনেক সময় সংখ্যালঘুদের স্বার্থ সুনজরে দেখা হয়েছে যেখানে দুর্বল রাষ্ট্র তার প্রাধান্য সকলের প্রতি সমভাবে আরোপ করতে পারেনি।

গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে দেখা গেছে। অধিকতর গণতান্ত্রিক দেশের দৃষ্টিভঙ্গী সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্ঠীদের প্রতি তেমন অনুকূল নয়, বরং নিম্নমানের গণতান্ত্রিক দেশ সংখ্যালঘু ভাষা গোষ্ঠীদের প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল। গণতান্ত্রিক দেশে প্রতিকারের সুযোগ তুলনামূলকভাবে বেশি মনে হলেও, নির্দিষ্ট ভাষা গোষ্ঠীরা তাদের ভাষার অধিকারের স্বীকৃতি পায় না। যেসব দেশে ভাষার অধিকার স্বীকৃতি লাভ করেছে সেখানে বিদ্রোহ বা বিছিন্নতাবাদ বেশি দেখা গেছে। সেসব দেশ থেকে স্বীকৃতিলাভের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ।

যেখানে রাষ্ট শক্ত, ভাষাগোষ্ঠীর দুর্বল সেখানে গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা কম। যেখানে রাষ্ট্র দুর্বল, সেখানে স্বীকৃতি ও গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনা তুলনামূলকভাবে বেশি। শিল্পোন্নত দেশে ভাষার স্বীকৃতি আপাতদৃষ্টিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতা হ্রাস করলেও বিদ্রোহের সম্ভাবনা তেমন কমেনি। বিগত পাঁচ-ছয় দশকে একাধিক দেশে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর ভাষার অধিকারকে স্বীকৃতি দান করা হয়েছে এবং ভাষা নিয়ে সেসব দেশে ক্ষোভও কিছু মাত্রায় কমেছে। যেমন অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, বলিভিয়া, ইথিওপিয়া, গুয়াটেমালা, মৌরিটানিয়া, নিউজিল্যান্ড, নিজেইর, পাকিস্তান, পানামা, পেরু, প্যারাগুয়ে, শ্রীলঙ্কা, সুদান ও স্পেন। ওই সব দেশে এখন ভাষা নিয়ে কোনো সংকট নেই, আবার ভাষার অধিকার প্রত্যাহারও করা হয়েছে কোনো কোনো দেশে। বার্মায় কাচিন, কারেন, জোমি, মন, রোহিঙ্গা, শানদের। স্লোভাকিয়া হাঙ্গেরিয়ানদের এবং সুদানে দক্ষিণীদের এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্প্যানিষ ভাষীদের ভাষার কিছু অধিকার প্রত্যাহার করা হয়েছে। নতুন করে ভাষা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে স্লোভাকিয়া ও সুদানে। যুক্তিসহকরণের ফলে কিরাগিজস্তান, কানাডা, বলিভিয়া, সোমালিয়া ও সুদানে প্রত্যেকটি দেশের প্রধান ভাষা আর একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে গণ্য হয় না। আবার, পরে লাওস, সোমালিয়া, সুদান ও শ্রীলঙ্কায় কেবল প্রধান ভাষাকে একমাত্র সরকারি ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দান করা হয়।

পৃথিবীতে গৃহযুদ্ধের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে সংখ্যালঘু ভাষাগোষ্টীদের স্বীকৃতিলাভ। গৃহযুদ্ধের সঙ্গে ভাষার অধিকারের স্বীকৃতিদানের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। বরং গত পঞ্চাশ বছরে বহু দুর্বল রাষ্ট্রের জন্মের কারণে বিদ্রোহের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভাষার অধিকার স্বীকৃতির কারণে ন্যায় দৃষ্টিভঙ্গীর জয় হচ্ছে না, রাষ্ট্রের দুর্বলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে –এ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েই গেছে। যে সব রাষ্ট্র দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত সেখানে বৈচিত্রকে গ্রহণ করার পরও সেসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের শক্তি সংহত হয়েছে।

মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা।