গণজাগরণ মঞ্চ ঘিরে ৩টি প্রশ্ন ও আমার ভাবনা

আরিফ জেবতিক
Published : 4 March 2011, 03:53 AM
Updated : 20 Feb 2013, 11:27 AM

শাহবাগের প্রজন্ম চত্ত্বরে জমায়েত অজস্ত্র সাধারণ মানুষদের মধ্যে আমিও একজন। সেই সূত্রে গত কয়েকদিন ধরে আন্দোলনরত বন্ধুবান্ধব, ছোট ভাই-বোন এবং সংবাদ মাধ্যম থেকে বারবার কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ব্যক্তি পর্যায়ে এসব প্রশ্নের উত্তর বারবার দেয়ার চাইতে একেবারেই একটি লেখার মাধ্যমে জবাবগুলো যদি গুছিয়ে আনা যায়, তাহলে নিশ্চয়ই সকলের বুঝতে সুবিধা হবে। বিষয়গুলো একান্তই আমার ব্যক্তিগত মতামত হিসেবে গন্য করার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রথম প্রশ্ন : শাহবাগ থেকে বারবার নিরীহ কর্মসূচি কেন? কেন জঙ্গি কর্মসূচি নয়?
শাহবাগের গণজমায়েত যখন ফুঁসছে তখন বেলুন উড়িয়ে দেয়ার মতো একান্তই নিরীহ কর্মসূচি নেয়ার যৌক্তিকতা কী, সেটি নিয়ে অনেক জিজ্ঞাস্য তৈরি হয়েছে। এখানে স্পষ্ট করে বলে নেয়া উচিত যে এই আন্দোলনের মূল শক্তিই হচ্ছে এর অহিংস অবস্থান। কাদের মোল্লার রায় ঘোষণার পরেই যাঁরা ৫ তারিখ বিকেল বেলা শাহবাগ চত্ত্বর দখল করে বসে পড়েছিলেন, তাঁরা ক্ষোভে ফুসছিলেন, বেদনায় নীল হচ্ছিলেন, দ্রোহে ফেটে পড়েছিলেন। সেই দ্রোহ, ক্ষোভ ও বেদনায় হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে তাঁরা যদি শাহবাগে গাড়ি ভাংচুর শুরু করতেন, তাহলে কয়েকজন তরুণ হয়তো তাঁদের ক্ষোভ প্রশমনের সাময়িক তৃপ্তি পেতেন, কিন্তু এই যে বড় গণজাগরন, এই যে গণরায়, সেটি অর্জন করা সম্ভব হতো না। ৫ তারিখ বিকেলে নেমে ৫টি গাড়ি ভাংচুর করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার মাধ্যমেই এর বিনাশ ঘটত।

কিন্তু শান্তিপূর্ণ অবস্থানের মাধ্যমে শাহবাগের তারুণ্য তাঁদের ক্ষোভ ও বেদনার সঙ্গে গোটা দেশকে বেঁধে ফেলতে পেরেছে, এটাই হচ্ছে এই তারুণ্যের বড় অর্জন। এই বেঁধে ফেলার কাজটিই প্রতিদিন প্রতিমুহুর্তে শাহবাগ থেকে করা হচ্ছে।

একথা সত্যি যে মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে খুব দ্রুত কিছু সহিংস কর্মসূচি দিয়ে যুদ্ধাপরাধী ও তাঁদের দোসরদেরকে কোনঠাসা করে ফেলা সম্ভব। কিন্তু একথাও মনে রাখতে হবে যে যুদ্ধাপরাধী ও তাঁদের দোসরদের সঙ্গে লাঠি হাতে মারামারি করা সাধারণ জনগনের কাজ নয়। এই দায়িত্ব সরকারের।

জনসাধারণের দায়িত্ব সরকারকে তাঁর কাজ করতে সহায়তা করা, কাজ থেকে বিচ্যুত হলে সরকারকে সঠিক কাজে বাধ্য করা, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সরকারের কাজ নিজের হাতে তুলে নেয়া নয়। আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব সরকারের, আমরা জনগন সেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে সরকারকে তাঁর দায়িত্ব থেকে মুক্তি দিতে পারি না। রাস্তায় জামায়াত শিবিরের সহিংসতা মোকাবেলায় সরকারকেই তার বিচার ব্যবস্থা, তার আইনশৃংখলা বাহিনী এবং তার বাদবাকি সকল শক্তি নিয়ে কাজ করতে হবে।

গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে যে, শাহবাগের তরুণ প্রজন্ম কিন্তু দেশে অস্থিরতা ছড়াতে কাজ করছে না বরং অস্থিরতা দূর করতে সংগ্রাম করছে। গণজাগরন মঞ্চ সহিংস কর্মসূচির মাধ্যমে যদি মাঠে নেমে পড়ে তাহলে দেশজুড়ে যে অরাজকতা সৃষ্ঠি হবে, সেই অরাজকতার সুযোগে অনেক শক্তিই তাঁদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এগিয়ে আসতে পারে। গোটা দেশ এখন ঐক্যবদ্ধ এবং সাহসী, এই মুহুর্তে কোনো হঠকারিতার সুযোগ নেই।

দ্বিতীয় প্রশ্ন : জামায়াত-শিবির এবং তাঁদের পোষা মিডিয়া ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো গণজাগরন মঞ্চের বিরুদ্ধে ধর্মীয় বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে, এর বিপরীতে গণজাগরণ মঞ্চ কী ভাবছে?

এই প্রশ্নটির জবাব আমি ব্যক্তি পর্যায়ে কয়েকবারই দিতে চেষ্টা করেছি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে পরাজিত শক্তির শেষ অস্ত্র হচ্ছে ধর্মকে ব্যবহার করে জনগনকে বিভ্রান্ত করা। ১৯৫২ সালে ঊর্দুকে মুসলমানদের ভাষা আর বাংলাকে হিন্দুয়ানি ভাষা বলে প্রচার করে এরাই আমাদের ভাষা আন্দোলনকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। ১৯৭১ সালে এরাই 'হিন্দুস্থান প্ররোরচিত মুসলমান নামধারী কাফির' আখ্যা দিয়ে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছিল। ১০৯০ সালে যখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, তখন শেষ সময়ে এরশাদ সরকারের পালিত দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে উস্কানি দিয়ে এদেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধিয়ে আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে ১৯৫২ সাল থেকে কোনোবারই তাদের এসব চক্রান্ত হালে পানি পায়নি।
গত কয়েকদিন ধরে সাংবাদিকতার নূন্যতম এথিক্সকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে আবারও জামায়াত-শিবিরের পালিত সংবাদ মাধ্যমগুলো সেই একই কার্ড নিয়ে খেলা শুরু করেছে। এবারও সাধারণ মানুষ এসব চক্রান্তে কান দেবে না বলে আমি বিশ্বাস করি।

তৃতীয় প্রশ্ন : আর কতদূর, আর কতদিন?
বিশেষ করে গত রবিবারে সংসদে ট্রাইবুনাল আইন সংশোধন হওয়ার পরে এই প্রশ্নটি খুব জোরেশোরে উচ্চারিত হতে দেখেছি বিভিন্ন জায়গায়। দাবিতো বেশ কয়েকটি মোটামুটি মেনেই নিয়েছে সরকার। কাদের মোল্লার বিচারের রায় আপীলে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্ঠি হয়েছে এই আইন সংশোধনের মাধ্যমে। যুদ্ধাপরাধী সংগঠন হিসেবে জামায়াতের বিচারের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণজাগরণ মঞ্চের দাবি ছিল ৩ মাসের মধ্যে আপীলের সুরাহা করতে হবে, সংসদ একধাপ এগিয়ে একে ২ মাসে সীমাবদ্ধ করেছে। সুতরাং কিছু কিছু জায়গায় তো অর্জন অনেক বেশিই হয়েছে। গোটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হতে পেরেছে, তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়েছে-এই বেলা আর কী চাই? ৫ তারিখ থেকে ২১ তারিখ পর্যন্ত টানা অবস্থানের পর শক্তি ক্ষয় না করে আমাদের কি এখন কিছুদিনের জন্য ঘরে ফিরে যাওয়া উচিত নয়, এই উপদেশটি আমি বাইরে থেকে অনেকবারই পাচ্ছি।

এর বিপরীতে আমার বিনীত উত্তর, জ্বি, আমরা অনেক কিছুই অর্জন করেছি কিন্তু আবার অনেক কিছুই অর্জনের পথে রয়েছি। আমরা খুব সাধারণ মানুষ, অল্পে তুষ্ট হয়ে আমাদের অভ্যাস। সুতরাং আন্দোলনের সাময়িক বিজয় আমাদের তৃপ্ত করে ফেলে।

কিন্তু এভাবেই বারবার আমরা মাঠ ছেড়ে ঘরে ফিরে যাই বলেই পরাজিত শক্তিরা আবারও মাঠ দখল করে তান্ডব শুরু করে। আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে যে জাগরণ আমাদের ধমনীতে মিশে আছে, তাঁকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। আমি মানি যে অনেকেই দম হারিয়ে ফেলবে, অনেকেই এই অল্পপ্রাপ্তিতেই হয়তো তুষ্ট হয়ে যাবে; কিন্তু একথাও সত্যি যে অনেকেই সাধ্যের শেষ সীমা পর্যন্ত এই সংগ্রামে যুক্ত থাকবে। আমি হয়তো আজকে ক্ষান্ত দেব, কিন্তু আগামীকাল আমার জায়গায় হয়তো নতুন একজন মানুষ এসে দাঁড়াবে। যে এখনও আসেনি, সে হয়তো আরেকটা দিন পরে আসবে, যে ফিরে যাবে সে হয়তো বিশ্রাম নিয়ে আবারও এসে যুক্ত হবে।

আমরা কোনো খন্ডিত সমাধান চাচ্ছি না। আমরা কোনো সাময়িক ধামাচাপা দেয়া খতিয়ান চাচ্ছি না। আমরা চাচ্ছি যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিকে চিরতরে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিতে। এজন্য একটি পূর্ণ বিজয় না আসা পর্যন্ত গণমানুষকে সচেতন করার আন্দোলনকে নিরন্তর অব্যাহত রাখতে হবে । ৭১ সাল থেকে গত ৪২ বছর ধরে যে সংগ্রাম চলছে, সেই সংগ্রামকে আরো ছড়িয়ে দিতে, আরো এগিয়ে নিতে এইবেলা তাই আমরা ঘরে ফিরছি না। অনেক হয়েছে, আর না। আমরা এবার এই লড়াইটাকে শেষ করেই ঘরে ফিরব।

আরিফ জেবতিক: ব্লগার।