আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনোকিছুই নিষিদ্ধ করার পক্ষপাতী নই। সরকার অতিসম্প্রতি শিশুদের জন্য অনুষ্ঠান বানায় এমন ক'টি বিদেশি চ্যানেল নিষিদ্ধ করেছেন। এসব চ্যানেলের একটিতে প্রচারিত হয় 'ডোরেমন' নামের একটি কার্টুন সিরিজ। আমি এটির কথা শুনেছি। শিশুরা এটি খুব পছন্দ করে সেকথাও জেনেছি। মূলত জাপানি ভাষায় নির্মিত সিরিজটি ডিজনি ইন্ডিয়াতে প্রচারিত হচ্ছে। ফলে ভারতে এটির সংলাপগুলো হিন্দি ভাষায় অনুবাদ করে ডাবিং করে প্রচার করা হচ্ছে। আমাদের দেশের শিশুরা ডিজনি ইন্ডিয়ায় প্রচারিত 'ডোরেমন' কার্টুনটি যেমন খুবই পছন্দ করছে, তেমন তারা হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শিখছে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ অভিভাবকই মূলত এ জন্য উদ্বিগ্ন। আমি শুনেছি, যেসব শিশু সদ্যই কথা বলতে শিখছে, তারা পর্যন্ত বাংলার চেয়ে হিন্দি বলতে বেশি পছন্দ করছে- সে ওই 'ডোরেমন' সিরিজের কল্যাণে। অভিভাবকরা বিষযটি খুবই উদ্বেগের দৃষ্টিতে দেখেছেন বলে 'ডোরেমন' বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে একটি আবেদন সবসময়ই ছিল।
আমি অবশ্য নির্দিষ্ট কোনো কার্টুন বা অনুষ্ঠান প্রচারের ইতিবাচক বা নেতিবাচক দিক নিয়ে বলতে পারব না। আমি কার্টুনটি নিজে দেখিনি। আগেই বলেছি, ব্যক্তিগতভাবে আমি যেকোনো কিছু বন্ধ করে দেওয়ার বিরোধী। আন্তর্জাতিকতার এ যুগে অনেক কিছুই আমরা ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তবে কয়েকটি চ্যানেল বন্ধের সরকারি সিদ্ধান্তের পেছনের কারণটি আমি স্পষ্ট বুঝতে পারি।
প্রথমত, ভাষার সঙ্গে সংস্কৃতির গভীর যোগ রয়েছে। একটি ভাষার মাধ্যমে একটি সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয়। আমাদের শিশুরা বাংলা না বলে হিন্দি বলতে বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠলে আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কেও ওদের মনে অস্পষ্টতা থাকবে। তাই শিশুরা কী দেখবে আর কী দেখবে না এ নিয়ে যথেষ্ট ভাবনা-চিন্তা করার কারণ রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, আমাদের শিশুদের অবশ্যই বাংলার বাইরে প্রয়োজনীয় অন্যান্য ভাষা শেখাতে হবে। তবে এখানে প্রাধান্য পাবে ইংরেজি। কারণ এটি আন্তর্জাতিক ভাষা। অন্যদিকে আমাদের দেশের কোনো শিশুর জন্য হিন্দি ভাষা শেখা জরুরি নয়। কারণ এটি ভারতের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। ওখানকার শিশুদের জন্য এ ভাষা শেখা জরুরি হতে পারে। আমাদের শিশুরা ইংরেজি ভালোভাবে শিখলেই পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারবে। তাই 'ডোরেমন' দেখে দেখে শিশুরা আরেকটি ভাষা শিখছে, তাতে ক্ষতি কী- এটি যারা বলেন তারা আসলে ভুল বলেন। উচ্চশিক্ষার পর্যায়ে আমাদের দেশের যে কেউ হিন্দি ভাষা ও সাহিত্য নিযে পড়াশোনা বা গবেষণা করতে পারেন, তাতে কোনো বাধা নেই। একাডেমিক ইন্টারেস্ট থেকে অন্য ভাষা শেখা বা অন্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা বা গবেষণা করা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সাধারণভাবে আমরা কেবল সে সব ভাষাই শিখব যেগুলো দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজনীয় বা যেগুলো আন্তর্জাতিক ভাষা।
তৃতীয়ত, শিশুদের উপযোগী বিনোদনের জোগান নিয়ে আমাদের নিজেদেরও ভাবতে হবে। বিদেশি যে চ্যানেলগুলো এসব কার্টুন দেখাচ্ছে তার মধ্যে বাণিজ্যিক চিন্তা্টাই প্রাধান্য পায়, শিশুদের শিক্ষা নয়। এরা এসব অনুষ্ঠানের ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে উপার্জন করে। তাই আমরা কীভাবে শিশুদের জন্য শিক্ষামূলক ও বিনোদননির্ভর অনুষ্ঠান তৈরি করতে পারি সেদিকে নজর দিতে হবে। পাশাপাশি, বাইরের বিশ্বের সেরা অনুষ্ঠানগুলো নিজেদের মতো করে শিশুদের দেখানোর ব্যবস্থা করতে পারি।
এ প্রসঙ্গে আমি সরকার তথা তথ্য মন্ত্রণালয়কে একটি পরামর্শ দেব। কোনো এক বা একাধিক বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দেওয়াই আসলে সমাধান নয়। সবচেয়ে ভালো হয় আমাদের শিশুদের বিনোদনমুলক অনুষ্ঠান উপহার দিতে আমরা নিজেরাই এগিয়ে এলে। 'ডোরেমন' সিরিজের কথাই বলব। শিশুরা যখন কার্টুনটি খুব পছন্দ করেছে, তাহলে ওদের এটি দেখানোর ব্যবস্থা করা উচিত। তাছাড়া জাপানে নির্মিত এ কার্টুনের কিছু বিষয় বেশ শিক্ষামূলক। তাই এর সংলাপগুলো মূল জাপানি বা অন্য কোনো ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ করে প্রচারের উদ্যোগ নিলে খুব ভালো হয়।
শুধু 'ডোরেমন' কেন, অন্যান্য ভাষায় নির্মিত আরও অসংখ্য কার্টুন বা বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান আমরা নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে দেখানোর উদ্যোগ নিতে পারি। বাংলাদেশে যে এ ধরনের কাজ করার মতো লোক নেই তা তো নয়। মনে রাখতে হবে যে, শিশুদের যথাযথ বিকাশের জন্য ওদের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের জোগান দেওয়া খুবই জরুরি। কিন্তু এখন যেসব টেলিভিশন চ্যানেল চালু হচ্ছে এরা শুধু বড়দের অনুষ্ঠান তৈরির কথাই ভাবছে। খুবই স্বাভাবিক। কারণ বাণিজ্যিক চিন্তা থেকেই মালিকরা চ্যানেল খুলছেন।
তাই এক্ষেত্রে সরকার একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। সংসদ নিয়ে চ্যানেল খোলা যতটা না জরুরি, তার চেয়ে অনেক বেশি দরকারি ছিল শিশুদের জন্য চ্যানেল। শিশুদের জন্য চব্বিশ ঘণ্টা অনুষ্ঠান প্রচারেরও কোনো প্রয়োজন নেই। সকালে একটা নির্দিষ্ট সময়ে শুরু করে রাত ন'টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচার করা যেতে পারে। সপ্তাহের ছুটির দিনগুলোতে থাকতে পারে বিশেষ আয়োজন। এ চ্যানেলের জন্য দেশীয়ভাবে যেমন ভালো ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান তৈরি করে প্রচার করা উচিত, তেমন বিদেশি জনপ্রিয় কার্টুন ও অনুষ্ঠানগুলো সেখানে দেখানো যেতে পারে। আমরা যদি এভাবে আমাদের নিজস্ব চ্যানেলের মাধ্যমে শিশুদের বিনোদন দিতে পারি, তাহলে বিদেশি চ্যানেলগুলো শিশুরা আর দেখতে চাইবে না। 'ডোরেমন' কার্টুনের মতো জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো বাংলায় দেখতে পারলে স্বাভাবিকভাবেই হিন্দি ভাষায় প্রচারিত অনুষ্ঠান দেখার প্রয়োজন থাকবে না। আমাদের দেশে এ ধরনের চ্যানেলের বাণিজ্যিক সম্ভাবনাও একেবারে কম নেই।
আমাদের শিশুদের মাঝে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকার ছড়িয়ে দিতে হলে, এবং একই সঙ্গে শিশুদের শিক্ষা ও আনন্দ দিতে চাইলে এভাবেই এগুতে হবে।
ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম : কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।