হরতাল কি আসলে অলসতার সমার্থক নয়?

মোহীত উল আলম
Published : 28 June 2010, 05:19 PM
Updated : 28 June 2010, 05:19 PM

ধর্মীয় ও সাধারণ সাহিত্যে অলসতা নিয়ে বহু গল্প আছে। "কুঁড়ের বাদশা" কথাটা চালু হয়েছে ভীষণ অলস লোকদের নিয়ে। ২৭ জুনের দিনব্যাপী হরতাল চলার সময় একটি টিভি চ্যানেলে সরকারি দলের কোন একজনের একটি ভাষ্য কানে পৌঁছালো যে হরতাল দিবানিদ্রার সুখটা ছাড়া আর কিছু দেয় না।

আমার লেখা কলাম যাঁরা পড়েন তাঁরা জানেন, যে বিরোধী দলই হরতাল ডাকুক না কেন, আমি কোনদিন হরতাল কর্মসূচী সমর্থন করি নি। এবারও যে করছি না সেটা নিঃসন্দেহে বলার জন্য আগের ইতিহাসটা বললাম। কাজ না করে সময় কাটানোতে আমি বিশ্বাসী নই।

প্রতিরক্ষা-সংস্থাগুলোতে 'মেন আওয়ার' বলে একটা কথা চালু আছে, যেটাকে বেসামরিক সংস্থায় ওয়ার্কিং আওয়ার বলা হয়। একটা ঐকিক অংকের হিসেবে 'মেন আওয়ার' জিনিষটা বোঝানো যায়। অর্থাৎ, একজন শ্রমিক একদিনে আট ঘন্টা কাজ করলে, দশজন শ্রমিক বা দশ লক্ষ শ্রমিক এক দিনে কত ঘন্টা কাজ করবে? সেটাকে টাকার ভাষায় প্রকাশ করলে কত টাকা লোকসান হয় একদিনের হরতালে সেটা বের করা যায়। হরতালের ফলে এ শ্রমিকগুলো কাজ না করে অলস বসে থাকে।

শ্রমিকদের জগতে ক্ষতিটা প্রত্যক্ষ, এর সঙ্গে তাদের ডাল-ভাতের প্রশ্নও জড়িত। কিন্তু শ্রমিকেরা যে সব উৎপাদনে নিয়োজিত থাকে, সে উৎপাদনের মালিকদের শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিটা দেশের মূল উৎপাদনের ওপর পড়ে। এ প্রতিষ্ঠানগুলো অলস বসে থাকে। জাতীয় প্রবৃদ্ধি কমে যায়। তা হলে বাংলাদেশ কেন আগাবে?

হরতাল থেকে সৃষ্ট ঝামেলা শ্রমিকের জীবনে অন্যভাবেও আসতে পারে। যদি সে মাস্টার রোলের চাকুরিধারী হয়, তা হলে একদিন কাজ বন্ধ থাকলে সে একদিনের বেতন পাবে না। হরতাল যে শ্রমিকের পেটে লাথিও মারে না, তা সত্য নয়। কোটিপতিরা সুখে থেকে শ্রমিককে কাজ করা থেকে বন্ধ রাখলে ফায়দাটা কার?

আমার কিছু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় ভালো না করলে এসে প্রতিশ্রুতি দেয়, স্যার, এবার ভালো করব। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ লেখাপড়ার জন্য আর খাটে না এবং আবারও রেজাল্ট খারাপ করে। তাদের সঙ্গে হরতাল-ডাকনেওয়ালা রাজনীতিবিদদের মানসিকতার একটা মিল আছে। তারা বাংলাদেশকে উন্নত, আধুনিক ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে দেখতে চান, কিন্তু হরতাল ডেকে সে প্রগতির চাকাকে থামিয়ে দিতে তারা দ্বিধাগ্রস্ত হন না। গাছের মগডালে উঠে সেই ডালটার গিঁট কাটার যে ছবি বোকামির উদাহরণ হিসেবে আমরা শিশুতোষ বইয়ে দেখি, হরতালের কান্ড দেখলে আমার সে ছবিটার কথা মনে হয়।

হরতাল সবচেয়ে বেশি অলস করে তোলে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানকে। আমি আগেও এ বিষয়ের ওপর কলামে মত দিয়েছি যে পড়ুয়া যুবসমাজকে রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় বিনা খরচায় খাটাতে পারে। বাবা-মা তাদের কষ্টার্জিত আয়ে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠান ছেলে শিক্ষিত হয়ে মানুষ হবে বলে। কিন্তু সে ছেলে ফেরে লাশ হয়ে। হিসাব করে দেখলে বোঝা যায় দলীয় রাজনীতির নামে যুবসমাজের একটি বিরাট অংশ (অধিকাংশই ছাত্র) আসলে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়াচ্ছে। সেখানেও হয়তো আপত্তি বেশি নাই, আপত্তি হলো জ্ঞানার্জন নামক একটি যে অতি জরুরি বিষয় আছে জাতীয় জীবনের উন্নতির ক্ষেত্রে সেখানে ছেদ পড়ে যায় রাজনৈতিক দলীয় কর্মসূচী যখন শিক্ষার্থীদের জন্য ক্লাস-বর্জন, পরীক্ষা-বর্জন এবং হরতালে পরিণত হয়। একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান যখন উৎপাদন করতে পারে না হরতাল বা অন্যান্য কারণে তখন যে ক্ষতিটা হয় সেটা হয়তো টাকার অংকে নিরূপণ করা সম্ভব। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন ক্লাসে আসা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হয়, তখন ক্ষতিটা হয় অপরিমেয়। আমরা যদি দেশকে ভালোবাসি, যদি চাই যে দেশ আধুনিকতার পথে এগিয়ে যাক, তা হলে কোন বিবেকের সায় থেকে এমনতর কর্মসূচী দেব যে যাতে দেশের তরুণসমাজ শিক্ষাগ্রহণের পথে বাধাপ্রাপ্ত হয়? এ চিত্রকল্পটা যদি ঘরোয়াভাবে চিন্তা করি তা হলে এরকম হবে যে বাপ ছেলেকে সন্ধ্যাবেলায় পড়ার টেবিলে বসতে দেখে বলছেন, না, খবরদার পড়তে পারবি না। কর্মসূচী দিয়ে দিয়ে দিনক্ষণ ঠিক করে রাজনৈতিক এজেন্ডা এগোনো যায়, কিন্তু রবিবার, সোমবার দেখে শিক্ষাগ্রহণের পথকে দাড়ি কমা দিয়ে নির্দিষ্ট করা যায় না। এটি অবিরত চালু থাকতে হবে এরকম একটি পথ।

আমার এক আবাল্য বন্ধু আমাকে ফোনে জানালেন যে তিনি সম্প্রতি মালয়েশিয়া ঘুরে এসেছেন। কেন? জিজ্ঞেস করলে বললেন, একমাত্র ছেলেকে সেখানকার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে।

তখন একটি চিত্রপট আমার মনে ভেসে উঠল (যে বিষয়টা হয়তো আমি নিশ্চিত আগেও উল্লেখ করেছি) যে ৮১-৮৩ সালে আমি যখন কানাডায় পড়াশুনা করছিলাম তখন দেখেছিলাম যে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্ডারগ্র্যাজুয়েট সেকশনে প্রচুর মালয়েশিয়ান ছেলেমেয়ে পড়ছে। মেয়েদের মাথায় নেকাব আছে, কিন্তু ওরা পড়ছে। খোঁজ নিয়ে জানলাম যে সারা কানাডায় তখন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মালয়েশিয়ার ছাত্রছাত্রীতে ভরপুর। শুনলাম, মহাথেরো কানাডার সরকারের সঙ্গে এ বিষয়ে একটি চুক্তি সম্পাদন করার পর তার কার্যকারিতা তখন শুরু হয়েছে। শর্ত ছিল এরা সবাই আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দেশে ফিরে দেশ সেবায় আত্মনিয়োগ করবে।

শুনেছি অনেকদিন ধরে মালয়েশিয়া এখন এ অঞ্চলে খুব উন্নত একটা দেশ। অন্তত বাংলাদেশের চেয়ে বহুগুণে উন্নত একটি দেশ। যে কারণে আমার বন্ধুর ছেলে সেখানে পড়তে যাচ্ছে। তাই আগে আমরা মালয়েশিয়ায় শুধু বৈধ এবং অবৈধ শ্রমিক পাঠালেও এখন ছাত্রও পাঠাতে শুরু করেছি।

ওপরের তুলনাটা দিয়ে আমি বলতে চাইছি না যে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদেরকেও সরকার চুক্তি করে কানাডা বা সেরকম উন্নত কোন দেশে পাঠিয়ে দিক, আমি বলতে চাইছি, মালয়েশিয়া যে আজকে বাংলাদেশ থেকে এগিয়ে গেল তার পেছনে সেখানকার সরকার এবং রাজনীতিবিদদের সুদূরপ্রসারী একটি পরিকল্পনা ছিল। সে পরিকল্পনার মধ্যে নিশ্চয় কোন তরফ থেকে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ করতে পারে সেরকম হরতালধর্মী আত্ম-বিনাশী কোন কর্মসূচী ছিল না।

আমরা হরতালের মতো কর্মসূচী ঘোষণা করার অর্থ বিশ্ব-আঙ্গিকের আলোকে এই হবে যে আমরা মেনে নিতে চাই যে মালয়েশিয়া আমাদের চেয়ে এগিয়ে যাক।

কিন্তু বহু বাস্তব কারণে (ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে) বাংলাদেশই বরঞ্চ মালয়েশিয়াকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যাবার কথা। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ও শিক্ষাগত চেতনায় দেশপ্রেম নিয়ে একটি ফাঁপা আবেগ আছে সত্য, কিন্তু নেই বস্তুনিষ্ঠ দলীয়-উচ্চাকাঙক্ষা-নিরপেক্ষ সৎ ও উদার দৃষ্টি নির্ভর একটি দেশ-ভিত্তিক বাস্তব পরিকল্পনা।

আরেকটা কথা আমার মনে হয়, অবশ্য এ মনে হওয়াটার পেছনে তেমন যে তথ্য বা পরিসংখ্যান আছে তা নয়, কেবল যা দেখছি বা পড়ছি তার থেকে জমা হওয়া ভাবনার ওপর নির্ভর করে বলছি কথাটা যে বাংলাদেশের যুব-প্রজন্ম (যাদেরকে আমি নতুন প্রজন্ম বলতে পছন্দ করি), যারা এর মধ্যেই নানা দিক থেকে গৎবাঁধা জীবনের বাইরে আসার আভাস দেখাচ্ছে, তারা যে হরতাল-ধর্মী রাজনীতি পছন্দ করবে সেটা আমার মনে হয় না। ভবিষ্যতে যুবসমাজের সৃষ্টিশীল ও উদ্যমী এ অংশটিই নেতৃত্বে আসবে বলে আমার ধারণা।

একটা কথা রাজনীতিবিদদের বুঝতে হবে যে একটি কর্মসূচী যা এক কালে মোক্ষম অস্ত্র ছিল, সেটি কখন তার ধার ক্ষয়ে ফেলেছে যুগের পরিবর্তনের চাপে সেটি বোঝার জন্য তাদের মধ্যে যথেষ্ট সচেতনতা থাকতে হবে।

আদর্শ কখন অলীক লক্ষ্যে পরিণত হয় সেটা বুঝতে না পারা রাজনীতিকদের বিষয় হতে পারে না।

সবশেষে বলি, জনগণের ভোটে নির্বাচিত সংসদকে কার্যকর করার দিকে সবাই মনোনিবেশ করলে দেশের সমস্যার সমাধানের রাস্তাগুলো পাওয়া যাবে।