আদালতে বাংলা ভাষা: যুক্তি-তক্কো-গপ্পো

Published : 4 Feb 2013, 04:53 PM
Updated : 4 Feb 2013, 04:53 PM

হে বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ রতন
তা সবে অবোধ আমি অবহেলা করি
পরধন লোভে মত্ত করিনু ভ্রমণ
পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

মেরুদণ্ডে যাদের আচার আর আনুষ্ঠানিকতা-সবর্স্বতার ঘুণপোকার আসন, তারাই শুধুমাত্র ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি এলে সর্বস্তরে বাংলা চালুর আবেগে উথলে ওঠেন। বাংলাকে আন্তজার্তিক মাতৃভাষায় পরিণত করা গেছে এটাই কি বড় পাওয়া? এতেই কি সব অর্জন শেষ? বাংলার চেয়ে ইংরেজিকে কি মোক্ষ-জ্ঞান করেন না আমাদের বিদ্বোৎসমাজ? দু'লাইন ইংরেজি বলতে পারলে এখানে বড় চাকরি মেলে। প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হওয়ার জন্য যে বিসিএস পরীক্ষা দিতে হয় সেখানে মৌখিকে ইংরেজিতে কথা বলতে পারলেই ভালো পদ পাওয়া যায়। যেখানে ইংরেজি সব মুশকিল আসান করে দেয় সেখানে বাংলার শক্তি কোথায়? ব্রিটিশ কলোনির সে সংস্কারের ভুষণ্ডী মাঠের ভূত তাড়াবার জাগরণের মন্ত্র কোথায়? আর আইন-আদালতে বাংলা? সে তো মূল্যহীন আমজনতার দিনগত পাপক্ষয় মাত্র!

আইন-আদালতের সাংবাদিকতা করতে গিয়ে দেখেছি, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিষ্ট্রেট এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের বাংলা যখন লিখি যথাক্রমে মুখ্য মহানগর হাকিম এবং মুখ্য বিচারিক হাকিম- তখন কোনো কোনো বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তা প্রতিবাদ করেন। কোনো কাজে তাঁদের খাসকামরায় গেলে তাঁরা এ বিষয়ে সাংবাদিকদের কাছে তাঁদের 'গোস্বা' প্রকাশ করেন। অথচ মহামান্য উচ্চ আদালত অর্থাৎ হাইকোর্ট থেকে আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য বিধান দেওয়া হয়েছে। সেটা এরকম এক ভাষা আন্দোলনের মাসেই। বেতার, দূরদর্শনে বাংলাকে বিকৃত করা যাবে না বলে অন্তবর্তীকালীন নির্দেশ দেওয়া আছে।

সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যখন হাইকোর্টের বিচারপতি ছিলেন সে সময় অর্থাৎ ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলায় মামলার রায় লেখা শুরু করেছিলেন। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, এর সংখ্যা ছিল প্রায় দুশো। প্রধান বিচারপতি হওয়ার পরও তিনি বাংলায় রায় লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু তারপরও উচ্চ আদালতে বাংলার আদর নেই। অনাদরে-অবহেলায় দুঃখিনী অশক্ত বর্ণমালা ফাঁপা রাষ্ট্রযন্ত্রের মিথ্যা স্তাবকতায় বিবর্ণ হতেই থাকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর। ভাষাকেও বাংলাদেশ নামের মাতৃভূমির মতোই বঞ্চনার মুকুটই শিরোধার্য করতে হয়।

আদালতে বাংলা বিষয়ে আমাদের সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে রয়েছে ছোট্ট একটি বাক্য। সেটি হচ্ছে 'প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা।' কিন্তু বেদনাদায়ক প্রহসন এটাই যে, এখনও পর্যন্ত সর্বস্তরে বাংলা চালু করা সম্ভব হয়নি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কারও অজানা নয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ঘটনা এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্থান পেয়েছে। ২১ ফেব্রুয়ারি সারা বিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করছে। অনেক দেশে রাষ্ট্রভাষা সেসব দেশের আদালতেও স্থান পেয়েছে। কোনো কোনো বিচারক মাতৃভাষায় বিচারকাজ চালাচ্ছেন। রায় দেওয়া হচ্ছে। অথচ ভাষা নিয়ে যে দেশে এত কিছু ঘটেছে, সে দেশের আদালতে বাংলা চালু করা যায়নি।

সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদের ওপর ভিত্তি করে ১৯৮৭ সালে বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ২ ও ৩ (১) ধারায় বলা আছে, কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন, তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। ৩ ধারায় বলা আছে, কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারি এ আইন অমান্য করলে তা সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে এবং এর বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। অসদাচরণের সর্বোচ্চ শাস্তি চাকরিচ্যুতি। এ আইনে কোনো ব্যক্তির শাস্তি হয়েছে এমনটি শোনা যায়নি। এ আইন মানতে বাধ্যও করা হয়নি কাউকে। প্রশাসনে ইংরেজির ব্যবহার চলছে। আদালতেও চলছে। কোনো বাধা নেই।

সবই তালগোল পাকানো। আদালতে ভাষার ব্যবহার চলছে যথেচ্ছভাবে। উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার বলা যায় বাধ্যতামূলক। তবে নিম্ন আদালতে ইচ্ছেমতো বাংলা-ইংরেজি ব্যবহৃত হয়। আইন বিশারদদের মতে, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা সংশোধন না হওয়ায় উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। ওই ধারায় বলা হয়েছে, ১৩৭ এর ১ উপধারায় "সরকার অন্যভাবে নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই আইন বলবৎ হওয়ার সময় যে ভাষা হাইকোর্ট ডিভিশনের অধীনস্থ আদালতের ভাষা হয় ওই ভাষাই অনুরুপ আদালতের ভাষা হিসাবে চলিতে থাকিবে।" ২ উপধারায় বলা হয়েছে,"অনুরূপ কোনো আদালতের ভাষা কী হইবে এবং অনুরূপ আদালতে কোন ধরনের দরখাস্ত এবং কার্যধারা লিখিত হইবে সরকার উহা ঘোষণা করিতে পারে।" ৩ উপধারায় বলা হয়েছে "যেক্ষেত্রে অনুরূপ আদালতে সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করা ব্যতীত কোনো বিষয় এ আইনে লিখিত হওয়ার প্রয়োজন বোধ হয় বা অনুমতি প্রদান করা হয় সে ক্ষেত্রে অনুরূপ লিখন ইংরেজিতে হইতে পারে; কিন্তু যদি কোনো পক্ষ অথবা তাহার উকিল ইংরেজির সহিত অপরিচিত হন তবে তাহার অনুরোধে আদালতের ভাষায় উহার অনুবাদ তাহাকে সরবরাহ করা হইবে; এবং আদালত ওই অনুবাদের খরচ প্রদান সম্পর্কে উপযুক্ত মনে করে এরূপ আদেশ প্রদান করিবে।"

বাংলা প্রচলনের ক্ষেত্রে সংবিধান ও আইনে বাধ্যবাধকতা থাকলেও আদালত এ বাধ্যবাধকতার বাইরে রয়েছেন। এ প্রশ্নে বেশ কিছু দেওয়ানি বিষয়ের আবেদনপত্র নিষ্পত্তি করতে গিয়ে ১৯৯১ সালের ৮ নভেম্বর হাইকোর্ট একটি রায় দেন। ওই রায়ে বলা হয়, দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারার ১ উপধারা মতে, আদালতে ইংরেজির ব্যবহার, যথা রায়, আরজি, সওয়াল-জবাব ইত্যাদি লেখা হলে তা বেআইনি হবে না। কাজেই বাংলা ভাষা প্রচলন আইন প্রণীত হওয়ার আগে আদালতে যেমন ইংরেজি ভাষায় আরজি, সওয়াল-জবাব, দরখাস্ত, রায় লেখা হত- তেমনটি চলতে পারে। ওই রায়ে ভাষার ব্যবহার সম্পর্কে ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়। বলা হয়, ভাষার তিনটি ব্যবহার। এগুলো হচ্ছে- রাষ্ট্রভাষা, সরকারের ভাষা ও আদালতের ভাষা। রাষ্ট্রভাষার অর্থ, যে ভাষা রাষ্ট্রের সব কাজে ব্যবহৃত হয়। সরকারের ভাষা হল নির্বাহী কার্যক্রমে ব্যবহৃত ভাষা। আদালতের ভাষা বিচারিক কার্যক্রমে ব্যবহৃত ভাষা।

হাইকোর্টের এ রায়ের পর আর নিম্ন আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়নি। শুধু ফেব্রুয়ারি এলেই সরকারের পক্ষ থেকে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রশ্ন সামনে আসে, বাংলা প্রচলনের অঙ্গীকার করা হয়। অথচ আদালতে মাতৃভাষা প্রচলনের বাধা দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা সংশোধনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয় না। কথার ফুলঝুড়িতে ময়দান গরম হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক কর্তাব্যক্তিদের ভাষাপ্রেম, তাদের দেশপ্রেমের মতোই আন্তরিকতাহীন কিছু বুলি হয়ে ওঠে।

আদালতে বাংলা ভাষা প্রচলনে আইন কমিশনের সুপারিশ রয়েছে। ওই সুপারিশের প্রতি সরকার কোনো নজরই দেয়নি। সুপারিশে বলা হয়েছে, সাংবিধানিক রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আইন করে বাংলা চালু করা উচিত। ইংরেজিতে লেখা বিদ্যমান আইনগুলো বাংলায় অনুবাদ করা অত্যন্ত জরুরি। পাশাপাশি উচ্চতর আদালতেও বাংলায় বিচারকার্য পরিচালনা ও রায় লেখা দরকার। সুপারিশে বলা হয়, যদিও ১৯৮৭ সনে আদালতে বিচারিক কাজসহ অন্যান্য আইনি কাজকর্মে বাধ্যতামূলক বাংলা ব্যবহারের জন্য "বাংলা ভাষা প্রচলন আইন" করা হয়, তারপরও বিশেষত উচ্চ আদালতে ইংরেজির ব্যবহার নির্বিবাদে চলছে। আরও বলা হয়, রায় ইংরেজিতে লেখা হলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বৈষ্যমের শিকার হন। তারা ইংরেজি না বোঝার কারণে খুব বিপদের মধ্যে পড়েন। আদালতের ভাষা তাই গণমানুষের ভাষাকে অনুসরণ করা উচিত।

আইন কমিশনের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ৩ নম্বর অনুচ্ছেদ এবং এবং বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ ইনট্রোডকশন অ্যাক্ট ১৯৮৭ অনুযায়ী, প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী, আইন ও বিচার বিভাগের সব কাজ বাংলায় করতে হবে। কিন্তু "হাসমতউল্লাহ বনাম আজমেরী বিবি ও অন্যান্য" মামলার রায়ে হাইকোর্ট বলেন, দেওয়ানী কার্যবিধির ১৩৭ (২) ধারা অনুযায়ী সরকার আদালতে বাংলা ব্যহারের বিষয়ে কোনো ঘোষণা দেবেন না। সুপারিশে বলা হয়, ফৌজদারি কার্যবিধির দুটি এবং দেওয়ানী কার্যবিধির একটি ধারার কারণে আদালতের কাজে বাংলা ব্যবহারের প্রতিবন্ধকতা থেকে যায়। বাধা না থাকলেও উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার প্রচলন নেই।

সাম্প্রতিক ইতিহাসে আমরা দেখতে পাই, বিচারপতিদের মধ্যে প্রয়াত আমীরুল ইসলাম চৌধুরী বাংলা ভাষায় আদেশ দান ও রায় লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু সেগুলো আইন সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়নি। ১৯৯৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিচারপতি কাজী এবাদুল হক ও বিচারপতি হামিদুল হক সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ নজরুল ইসলাম বনাম রাষ্ট্র মামলায় বাংলায় রায় দেন। রায়টি আইন সাময়িকী ঢাকা ল' রিপোর্টস-এ ৫০ ডিএলআর ১০৩ পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে। একই দিনে বিচারপতি হামিদুল হক অপর একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায় বাংলায় রায় প্রদান করেন। আবদুল আজীজ বনাম সেকান্দর আলী নামক সে রায় ৫০ ডিএলআর পৃষ্ঠা ১১১ তে ছাপা হয়। হাবিবুর রহমান বনাম সেরাজুল ইসলাম নামক একটি ফৌজদারি রিভিশন মামলায় বিচারপতি কাজী এবাদুল হক বাংলায় রায় লিখেন যেটি ৫১ ডিএলআর ১৪৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়।

এরপর সবুর আলী বনাম রাষ্ট্র নামক একটি ফৌজদারি মামলা বিচারে যুক্তিসঙ্গত সন্দেহের সুবিধা কখন আসামি লাভ করতে পারে, সে সংক্রান্ত নজির সৃষ্টিকারী একটি রায় দেন বিচারপতি কাজী এবাদুল হক। এটি ৫১ ডিএলআর পৃষ্ঠা ১৬ তে প্রকাশিত হয়। ফৌজদারি মামলায় পুলিশের সাক্ষ্য কখন বিশ্বাসযোগ্য বলে গ্রহণ করা যাবে, তা ব্যাখ্যা করা হয় আবদুর রেজ্জাক বনাম রাষ্ট্র নামক মামলায়। ৫১ ডিএলআর পৃষ্ঠা ৮৩ তে রায়টি প্রকাশিত হয়।

এছাড়া বিচারপতি হামিদুল হক ও বিচারপতি আবদুল কুদ্দুছ বাংলায় বেশ কয়েকটি নজির সৃষ্টিকারী রায় প্রদান করেছেন। সম্প্রতি যে বিচারপতিরা সুপ্রিম কোর্টে কর্মরত রয়েছেন তাঁদের মধ্যে বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বাংলায় বেশ কয়েকটি মামলার রায় প্রদান করেছেন। ২০০৭ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মতিউর রহমান মিয়া বনাম আছিয়া খাতুন ও অন্যান্য মামলায় তিনি বাংলায় রায় দিয়েছিলেন। আইনজ্ঞরা বলছেন, এ রায়ের মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হল উচ্চ আদালতে বাংলা ব্যবহারে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।

উচ্চ আদালতে বিচারপতিরা বাংলায় রায় লিখেন না বললেই চলে। ২০০৭ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলায় লেখা একটি জামিন আবেদন তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মো. আবদুল মতিন ও বিচারপতি মো. আবদুল হাই সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে এ ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি একই বেঞ্চে বাংলায় আবেদন করায় ওই আবেদন ফিরিয়ে দেওয়া হয়। ওই আবেদনের পক্ষে আইনজীবী আবু ইয়াহিয়া দুলাল জানান, একটি ফৌজদারি জামিন আবেদন তিনি বাংলায় নিয়ে যান। বাংলায় শুনানি শুরু করলে আদালত প্রশ্ন তোলেন, বাংলা ভাষায় আবেদন কেন? তখন আইনজীবী বলেন, বিচারপতি হওয়ার সময় আপনি বাংলায় শপথ নিয়েছেন, এখন বাংলায় আবেদন শুনবেন না কেন? আদালত জানায়, এটা আমাদের ট্রাডিশন নয়। আইনজীবী বলেন, ট্রাডিশন জাতীয় ও বিজাতীয় দুই রকমের হয়। ইংরেজিতে আবেদন করা ও আদালতে ইংরেজি ভাষার প্রয়োগ একটি বিজাতীয় কালচার। শুনানি শেষে আদালত আবেদনটি তালিকা থেকে বাদ দেয়।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করছি, ১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজির সঙ্গে বাংলাকেও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিল। তখন থেকে আইন মহাবিদ্যালয়ে বাংলায় আইন শিক্ষা দেওয়া শুরু হয়। এরপর অধস্তন আদালতে বাংলার ব্যবহার বাড়তে থাকে। ১৯৭৫ সালের পর আবার আদালত অঙ্গনে ইংরেজি ভাষার প্রচলন বেড়ে যায়।

এ অপচেষ্টা রোধ করার জন্য ১৯৮৭ সালে প্রণীত হয় বাংলা ভাষা প্রচলন আইন। এ আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে ৩ (১) আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে। (২) (১) উপধারায় উল্লেখিত কোনো কর্মস্থলে যদি কোনো ব্যক্তি বাংলা ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহলে তা বেআইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হইবে। (৩) যদি কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারি এ আইন অমান্য করেন, তাহা হইলে ওই কার্যের জন্য তিনি সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করিয়াছেন বলে গণ্য হবেন এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারি শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে। দেওয়ানি কার্যবিধির ১৩৭ ধারা মোতাবেক আদালতে ইংরেজি ভাষার বাধ্যবাধকতা কিংবা ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৫৮ ধারা মতে যেকোনো ভাষা ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে।

সংবিধানের ১৫৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'বিধানের বাংলা ও ইংরেজি পাঠের মধ্যে কোনো বিরোধ দেখা দিলে সেক্ষেত্রে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।' অষ্টম সংশোধনী মামলার রায়ে বলা হয়েছে, আদালত তার ইচ্ছামতো ভাষা ব্যবহার নির্ধারণ করতে পারবে, এতে কোনো বাধা নেই। এ অর্থে আদালতে বাংলা ও ইংরেজি দুটি ভাষারই ব্যবহার করা যায়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষার ব্যবহার নেই বললেই চলে। হাসমতুল্লাহ মামলার রায়ে বলা হয়েছিল, রাষ্ট্রভাষার অর্থ হবে তিনটি। রাষ্ট্রভাষা, অফিসের ভাষা আর আদালতের ভাষা। দেশের বিশিষ্টজনরা বলছেন, এ মামলার রায়ের অন্তর্নিহিত অর্থ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, বাংলা ভাষার ব্যবহার উচ্চ আদালতে নিষিদ্ধ করা হয়নি। বিচারপতি হাবিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি থাকাকালে কয়েকজন বিচারপতিকে নিয়ে উচ্চ আদালতে বাংলা প্রচলন বিষয়ে একটি সমীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু ওই সময় বিচারকদের একটি অংশ বাংলা ভাষায় শুনানি ও রায় ঘোষণার বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। পরে এ প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন করা যায়নি।

অ্যাডভোকেট সামছুদ্দিন ও ভাষাসৈনিক অ্যাডভোকেট গাজীউল হক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় আরজি, জবাব বিষয়াদি দাখিলের ক্ষেত্রে জোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অন্য আইনজীবীদের অসহযোগিতা এবং আদালতের অনাগ্রহের কারণে তা আর রেওয়াজে পরিণত হতে পারেনি। আদালতে যারা বাংলা ভাষার বিরোধিতা করেন তাদের মত হচ্ছে, মামলা রুজু করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন নজির নিতে হলে ইংরেজি বই থেকে নিতে হয়। তাছাড়া ইংরেজি ভাষার বাংলা প্রতিশব্দের অভাব, বাংলা সাঁটলিপিকার ও মুদ্রণ সহকারীর অভাব রয়েছে। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের অনেক রায় বিদেশের আদালতগুলোতে নজির হিসেবেও নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বাংলায় লেখা থাকলে তা আর সম্ভবপর হয়ে উঠবে না।

অন্যদিকে যারা আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে পক্ষে তাদের মত হচ্ছে, আদালত সাধারণ জনগণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তির জায়গা। সেখানে ভাষা হবে জনসাধারণের ভাষা যাতে বিচারপ্রার্থীরাই বেশি উপকৃত হন। আদালতে ইংরেজি ব্যবহারের ফলে বিচারপ্রার্থীরা তাদের তথ্য জানার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, মামলার রায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারছেন না। অনেক আইনজীবী বলছেন, উচ্চ আদালতে শুনানির সময় কোনোভাবেই বাংলা ব্যবহার করা যায় না। কারণ উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা বাংলা শুনতে চান না। কিন্তু এ প্রথা দূর করা প্রয়োজন বলে মনে করছেন দেশের বিশিষ্টজনরা। উচ্চ আদালতে বর্তমানে বাংলা প্রচলনে যেটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা হল, দৈনন্দিন কার্যতালিকাটুকু বাংলায় ছাপা হচ্ছে।

আমাদের উচ্চ আদালতে যেহেতু কয়েকজন বিচারপতি অনেক মামলায় বাংলায় রায় দিয়েছেন তাতে বোঝা যায়, বাংলায় রায় দেওয়ায় নিষেধ নেই। তবুও বাংলায় রায় দেওয়াতে কেউ উৎসাহবোধ করেন না। বাংলায় রায় দেওয়াটা মানসিক বিষয়। যেসব রায় বাংলায় দেওয়া হয়েছে তা কি আইনগতভাবে মূল্যহীন? তাহলে অন্যরা কেন বাংলায় বিচারকাজ করেন না? এ প্রশ্নের উত্তর মেলে না।

মাতৃভাষায় রায় দেওয়া হলে দেশের মানুষের বুঝতে সুবিধা হয়। মামলার বাদী-বিবাদীকে অন্যের কাছে রায় বুঝে নিতে যেতে হয় না। এটা সহজ সমীকরণ। অনেক রায় নিয়ে এ দেশের রাজনীতিকরাও তর্কে জড়িয়ে পড়েন। সাধারণ মানুষকে তাঁরা নিজেদের মতো করে বুঝিয়ে থাকেন। বাংলা ভাষার প্রচলন ঘটলে সর্বোচ্চ আদালতে বিচারকাজ পরিচালনা সহজ, স্বচ্ছ ও স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হবে জেনেও এ কাজটি কেউ করেন না। সংখ্যায় নগণ্য হলেও বেশ কয়েকজন বিচারক ইংরেজিতে শুধু আদেশ এবং রায় দেন, এর বাইরে সাক্ষীদের জবানবন্দী, জেরা বাংলায় নেন। কিন্তু অনেক হাকিম ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও ইংরেজিতে রের্কড করেন। কারণ তাঁরা ইংরেজিতে লেখাকে সন্মানজনক ও অভিজাত কাজ বলে মনে করেন।

অথচ উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত রয়েছে, সাক্ষীর নিজের ভাষা সেটি আঞ্চলিক অথবা প্রমিত যাই হোক না কেন ঠিক সে ভাষাতেই তার জবানবন্দী রেকর্ড করতে হবে। যারা ইংরেজিতে লিখেন তাঁরা মনে করেন, তাঁরা নিজেরা ইংরেজি ভাষাভাষীদের মতোই ইংরেজি জানেন। ইংরেজিই তাদের ধ্যান-জ্ঞান। অবশ্য এদের সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে।

একজন ফৌজদারি বিষয়ক প্রবীণ আইনজীবীর মুখ থেকে শোনা তাঁর পেশাগত জীবনের কাহিনী উল্লেখ না করে পারা গেল না।। ঢাকার আদালতে মানিকগঞ্জের একজন লোক মাছ চুরির মামলায় বাদী হিসাবে জবানবন্দী দিচ্ছেন। "তখন বিয়ান বেলা। ঘুম থিকা উইঠা অব্যাস মতো চকের দিকে আটতে থাকি। পরেই ডাঙ্গার চালা। ডাঙ্গার পারে খারায়া দেহি কি দূরে কয়েকজন দবুড় দিয়া পলাইয়া যাইতেছে। আমার রেইঞ্জের মইদ্যে তারা ছিল না। ডাঙ্গার পাড়ের চ্যারদিকে পানি থিকা জালে ওঠা তোলা ক্যাদা আর ক্যাদা। পাড়ে পানি ভেজা ক্যাদা মাখা একটি মাছ দরার জাল পাই। " জজ সাহেব তার জবানবন্দী ইংরেজিতে লিখতে গিয়ে 'দবুড়' শব্দটির ইংরেজি লিখলেন chasing, অর্থাৎ ধাওয়া করা। বাদীকে তার দেওয়া জবানবন্দী ব্যাখ্যা করা হল। বাদি বললেন, এ কথা তো আমি বলি নাই। তার আইনজীবীর আবেদনক্রমে লাইনগুলোই বিচারক কেটে দিলেন। সময় নষ্ট হল। আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা বিরক্ত হলেন।

তাহলে প্রেসক্রিপশনটি কী? আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে দেওয়ানি কার্যবিধি সংশোধন করা যেমন জরুরি, তেমনি উচ্চ আদালতে বাংলা ভাষা ব্যবহারে নতুন আইন প্রণয়ন করা দরকার। অনেক আইনজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন হলেও পাশাপাশি ইংরেজি ভাষায় ব্যবহার থাকলে রায় বুঝতে সাধারণ মানুষের যেমন সুবিধা হবে, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে এ রায় সিদ্ধান্ত হিসেবে স্বীকৃতিও পাবে।

আজকাল কত কিছুই বাংলায় হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর আহবানে মুঠোফোন কোম্পানিগুলো এগিয়ে এসে কি-বোর্ড বাংলায় তৈরি করছে। কিন্তু ইন্টারনেটের ডোমেইন, হোষ্টিং বাংলায় কি সম্ভব নয়? সম্ভব করা না গেলে একটি গর্বিত জাতি হিসেবে আমাদের পক্ষে সামনে এগুনো সম্ভব নয়। আর তাহলে আদালতসহ সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের স্বপ্ন আকাশকুসুমই থেকে যাবে।

প্রকাশ বিশ্বাস : আইনজীবী ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক।