নারীর অধিকার: আইনে আছে সমাজে নেই

সালমা খান
Published : 3 Feb 2013, 02:25 PM
Updated : 3 Feb 2013, 02:25 PM

হঠাৎ করেই যেন মনে হচ্ছে আমাদের সমাজে নারীর নিরাপত্তা ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে। নারীধর্ষণ মহামারী আকারে দেখা দিয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করছেন। আসলে সমাজে পশ্চাদপদ অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের নারী চিরকালই হত্যা, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়। তবে এখন মিডিয়ার সক্রিয় ভূমিকার কারণে নারীর ওপর নানা ধরনের নিপীড়নের ঘটনাগুলো উঠে আসছে। মানুষ জানতে পারছে এগুলোর কথা।

পাশাপাশি আমি এটাও মনে করি, আমাদের নারী আন্দোলনের মধ্যে এমন কিছু উপাদান থাকা দরকার ছিল যাতে এ ধরনের ঘটনা কমানো যায়। আমাদের নারী আন্দোলনের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হল আমরা একে জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করতে পারিনি। রাজনৈতিকভাবে আমাদের দেশে এ নিয়ে বড় কোনো বিভাজনও নেই। বিশ্বের অনেক দেশেই যে রকম আছে। তা সত্ত্বেও আমরা কিন্তু একে জাতীয় কোনো ইস্যুতে পরিণত করতে পারিনি।

আমি নিজে এ সমস্যাটি অনুভব করছি। বিবিসিতে কদিন আগে এ নিয়ে একটি আলোচনা অনুষ্ঠানে কথা বলছিলাম। আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন আমাদের নারী আন্দোলনগুলোতে এ ব্যর্থতা রয়ে যাচ্ছে। আমি সেখানেও এর কারণ অনুসন্ধান করেছি। আমার কাছে মনে হয়েছে, আমাদের আন্দোলনগুলোতে সাধারণ মানুষের সমর্থন বা অংশগ্রহণ কম। যেকোনো ঘটনা ঘটলে আমরা প্রচুর মানববন্ধন করি, সভা-সেমিনার ডাকি, আলোচনা করি- কিন্তু নারী সংগঠনগুলোর কর্মীরাই হয়তো সেখানে থাকেন- সাধারণ মানুষদের তেমন দেখা যায় না। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে পড়ুয়া সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের আমরা এসব আন্দোলনে পাই না। আমার মনে হয় এটাই আমাদের বড় দুর্বলতা।

আমাদের দেশের নারীআন্দোলনে শিক্ষিত মানুষেরা, বিশেষ করে নারীরা অংশগ্রহণ করছেন না। দেখা যায়, তারা নিজেরা শিক্ষা পাচ্ছেন, স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছেন, তাই অন্যের অধিকার, বিশেষ করে সাধারণ দরিদ্র বা গ্রামীণ নারী বা কিশোরীর অধিকার লঙ্ঘন হলে তারা কিছু বলছেন না। এমনকি, যতক্ষণ না এই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোনো নারী নিজে আক্রান্ত হচ্ছেন ততক্ষণ পর্যন্ত নিরব থাকছেন তারা।

দুঃখের বিষয় এই শিক্ষিত মানুষেরা তাদের সহকর্মী বা প্রতিবেশি মেয়েটিও কোনো সহিংসতার শিকার হলে মাঠে নামছেন না। সেই একই আমরা, নারী সংগঠনগুলো এ ধরনের ঘটনার প্রতিবাদ করছি।

এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন এবং এ শতকের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপড়িনবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। ছাত্রীরা শুধু নয়, ছাত্ররাও এসব আন্দোলনে অংশ নিয়েছে।

ভারতের মতো দেশে যেখানে এক বিলিয়নের বেশি লোক, মানে পৃথিবীর এক-সপ্তমাংশ মানুষের বসবাস, সেখানে দিল্লিতে যে মেডিকেল ছাত্রীকে বাসে গণধর্ষণ করার ফলে তার মৃত্যু হওয়ার পর সরকার যেভাবে কথা বলছেন এর প্রভাব অনেক বেশি হচ্ছে। আজ মনমোহন সিং বলতে বাধ্য হচ্ছেন যে, 'আমাদের দেশে নারীর নিরাপত্তা একটি জাতীয় সমস্যা হয়ে উঠেছে।'

অথচ আমাদের দেশে গত বাইশ বছরে দুজন নারী রাষ্ট্র শাসন করেছেন। তাঁরা কোনোদিন বলেননি যে, নারীর নিরাপত্তা একটি জাতীয় ইস্যু। তাঁরা অনেক সময় নারীদের জন্য আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারী প্রসঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলেন, এর বাইরে কোথাও তাঁরা নারীদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন না। হ্যাঁ, তাঁরা দুয়েক সময় গর্ব করে কিছু জলো কথাবার্তা বলেন, 'আমাদের নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন, তারা প্লেন চালাচ্ছেন, ট্রেন চালাচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি।' কিন্তু এখন পর্যন্ত নারীর নিরাপত্তা একটি জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়নি। তাই আমাদের আন্দোলন এখনও সংগঠনভিত্তিক, সমাজভিত্তিক নয়।

আমরা আমাদের আন্দোলনের দুর্বলতা হিসেবে এটাকেই চিহ্নিত করতে চাই যে, মূলধারার জনগোষ্ঠীকে আমরা এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত করতে পারছি না। আমরা কিন্তু ভারতের চেয়ে অনেক বেশি আন্দোলন করছি। কথায় কথায় মানববন্ধন করছি। বিশ্বজিত হত্যার প্রতিবাদ হোক কি ইয়াসমিনকে ধর্ষণ ও হত্যা হোক কি রামুতে সাম্প্রদায়িক হামলা হোক- সবকিছুতেই আমরা আছি। কিন্তু কিছু কারণে মূল বা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ওপর আমাদের এসব প্রতিবাদের প্রভাব পড়ছে না।

প্রথমত, এদেশে একটা শ্রেণি আছে যারা একেবারেই বিত্তহীন, এরা এমনিতেই সমাজে কোনঠাসা, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার এরাই সবচেয়ে বেশি হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, শিক্ষিত যে জনগোষ্ঠী যারা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে, অর্থনৈতিকভাবে যে শ্রেণিটা একটু সবল- তারা হয়তো বড়জোর লেখালেখি করছে, কিন্তু আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে না। এদের যুক্ত করতে না পারা আমাদের আন্দোলনের একটি ব্যর্থতা। এটা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। দিল্লির ঘটনায় মনে আছে পত্রিকায় একটি প্ল্যাকার্ড হাতে একজনের ছবি দেখেছিলাম। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, 'হ্যাড ইট বিন ইওর ঔন ডটার।' আমাদের দেশেও এ প্রশ্ন এখন তুলতে হবে।

আমাদের দেশে নারীর ওপর নিপীড়নের ভয়াবহতা ভারতের চেযে কম নয়। এই রাজধানী ঢাকার বুকে সেগুনবাগিচার মতো জায়গায় একটি অফিসকক্ষে এগারো বছরের শিশুকে নিপীড়ন করে মেরে ফেলা হল। রাজধানী শহরেই প্রকাশ্য রাস্তায় অনেক মানুষের চোখের সামনে ইডেন কলেজের ছাত্রীকে এসিডে পুড়িয়ে ওর মুখ ঝলসে দেওয়া হল। টাঙ্গাইলের কলেজছাত্রীর ওপর যে নির্যাতন চালানো হযেছে এরও কোনো তুলনা নেই। ভারতের মতোই মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে এক গার্মেন্টসকর্মীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।

এসব ঘটনায় সারাদেশের মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ-হতাশা কিন্তু তৈরি হয়েছে। কিন্তু এটা আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়নি। গতানুগতিকভাবে নারী আন্দোলনকর্মীরা মানববন্ধন করেছেন। প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সেসব জায়গায় সাধারণ মানুষের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণ নেই। এত বড় বড় ঘটনা ঘটে যাচ্ছে- সাধারণ মানুষ আতঙ্কিতও হচ্ছে- তবু প্রতিবাদে মুখর হচ্ছে না।

গত মাসে এরকম একটি ভয়াবহ ঘটনার কথা পত্রিকায় পড়েছিলাম। ক্লাস সিক্স কি সেভেনে পড়া একটি মেয়েকে ধর্ষণ করার পর মেয়েটি আত্মহত্যা করে। তখন সমাজপতিরা ঘোষণা করেন যে, এ মেয়েকে কোথাও কবর দেওয়া যাবে না, কারণ সে আত্মহত্যা করেছে। তখন পরিবারের সদস্যরা বাড়ির আঙ্গিনায় মেয়েটিকে কবর দিলে অন্যান্য স্বজনরা বাধা দেন। এখানে ঘটনার ভয়াবহতা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। মেয়েটি তো ধর্ষণের শিকার হয়েছেই, আত্মহত্যার পরও তার লাশের জায়গা হল না কোথাও। যে স্বজনরা বাধা দিয়েছেন, বোঝা যায় যে, ওরাও সমাজের প্রভাবশালীদের ভয়ে কতটা তটস্থ বলে এ কাজ করেছেন। আর যে প্রভাবশালীরা মেয়েটিকে কবর দেওয়ার সুযোগ দিল না, তারা তো মেয়েটির ধর্ষকদের চেয়েও বড় অপরাধী। কোন ধর্মে, কোন আইনে, কোন সমাজে, কোন মানবতাবোধে বলা হয়েছে যে ধর্ষণের নির্মম শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছে বলে একটি ছোট্ট কিশোরীকে কবর দেওয়া যাবে না?

যেখানে এমনিতে এত কচি একটি মেয়েকে ধর্ষণের শিকার হতে হল, তারপর সে আত্মহত্যা করতেও বাধ্য হল, সমাজ তাকে নিরাপত্তা দিতে পারল না, অথচ মৃত্যুর পরও তার সঙ্গে এত নিষ্ঠুরতা! আজ ভারতের মেয়েরা প্রশ্ন তুলছে, এ সমাজ এবং রাষ্ট্র কেন আমার নিরাপত্তা দেবে না। প্রশ্নটা আমাদেরও তুলতে হবে। কে দেবে নারীর নিরাপত্তা? সমাজ দেবে, রাষ্ট্র দেবে, প্রধানমন্ত্রী দেবেন, দেবেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্রের কর্ণধাররা শুধু রাজনীতিই করেন না, তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী। দেশের সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় তারা চলেন। তাই সব মানুষের নিরাপত্তা বিধান করা তাদের দায়িত্ব।

একইভাবে নারায়ণগঞ্জ চারুকলার ছাত্রী সিমির ঘটনার কথা বলা যায়। বেশ কয়েক বছর আগে সিমির আত্মহনন নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়েছিল। সিমিকে উত্ত্যক্তকারীদের ভয়ে ওর মা-বাবা ওকে অভিযুক্ত করায় সিমি আত্মহত্যা করে। এরপর উত্ত্যক্তকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন সিমির পরিবার। জেল থেকে বের হয়ে এসে আসামীরা ওই পরিবারটিকে গত কয়েক বছর ধরে নানাভাবে নিপীড়ন করছে। সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকছে পরিবারটি। তার মানে, এদেশে নিপীড়নের শিকার কোনো মেয়ে আত্মহনন করলেও তার পরিবারও নিপীড়ন থেকে রেহাই পায়না। ভয়াবহতার দিক থেকে এগুলোও কম নয়।

ভারতের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য এখানেই যে, ভারতে গণতন্ত্র সুদৃঢ় হয়েছে। সেখানকার রাজনীতিবিদরা জানেন, জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে হবে। তাই সেখানে নারীর নিরাপত্তা একটি ইস্যু হয়ে উঠতে পারে। আমাদের রাজনীতিবিদদের কাছে জনগণের নিরাপত্তা কোনো ইস্যুই নয়। তারা ভাবেন, কিছু একটা ঘটলে পত্রপত্রিকায় কিছুদিন লেখালেখি হবে, তারপর অন্য খবরের ভিড়ে সব আড়াল হযে যাবে। নারী সংগঠনগুলো না হয় একটু চিল্লাচিল্লি করবে, প্রেসক্লাবের সামনে একটু যানজট হবে। তারপর সব ঠিক হযে যাবে।

নারীর ওপর পুরুষের যৌন-সহিংসতা দূর করার জন্য নারী সম্পর্কে সনাতন ধ্যান-ধারণা পরিবর্তনের কথা ভাবাটা্ও খুব জরুরী। এখনও অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের ওপর নিপীড়নের জন্য মেয়েদেরই দায়ী করা হয়। বলা হয়, মেয়েদের পোশাক-আশাক বা চলাফেরার জন্যই তারা ধর্ষণের শিকার হয়। এ ধরনের ভয়াবহ সব তত্ত্বের বিরুদ্ধেও আমাদের লড়তে হবে।

পাশ্চাত্যের সঙ্গে যদিও আমাদের তুলনা করা ঠিক হবে না, তবু এখানে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। মুষ্টিযোদ্ধা মাইক টাইসন যখন পৃথিবীজুড়ে খ্যাতি লাভ করেন, তখন এক তরুণী জোর করে তার হোটেলের রুমে প্রবশ করেন। সেখানে মেয়েটি তাকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করলে তিনি তাকে ধর্ষণ করেন। তরুণীটি পরে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করলে বিচারক এ্ মর্মে টাইসনের বিরুদ্ধে রায় দেন যে, 'কোনো নারী বিবসনা হলেই তাকে ধর্ষণ করার অধিকার তাকে দেওয়া হয়নি। মেয়েটি তার হোটেল রুমে জোর করে প্রবেশ করেছিল বা তাকে উত্ত্যক্ত করেছিল বলে সে-ও অপরাধী। এজন্য কোর্ট তাকে সাজা দেবে, কিন্তু টাইসন তাকে এজন্য ধর্ষণ করতে পারেন না।'

মার্কিন আদালতের এ রায় বা বক্তব্যের কথা এ কারণেই উল্লেখ করা যে, আমাদের দেশে হরহামেশাই নারীর বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতার জন্য নারীকেই দায়ী করা হয়। একুশ শতকের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের রাজধানী শহরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বাঁধন নামের এক তরুণীর ওপর নৃশংস হামলা হয়েছিল। প্রকাশ্য রাজপথে, হাজার হাজার মানুষের সামনে ওকে বিবস্ত্র করে নিপীড়নের চেষ্টা করা হয়েছিল, সেটা আমরা ভুলে যাইনি। তখন একশ্রেণির মানুষ এ ঘটনার জন্য বাঁধনের দিকেই আঙুল তুলেছিলেন, বলেছিলেন, ওই রাত-বিরাতে সে কেন ওখানে গেল? যেন গিয়েছে বলেই ওকে ধর্ষণ করা বা ধর্ষণের চেষ্টা করা 'বৈধ' হয়ে গেল।

আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় এখনও নারী-পুরুষের সমতার ধারণাটি পরিপুষ্ট হয়নি এটা ঠিক, তবে আমাদের সংবিধানে এ সমতার ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কথাবার্তা আছে। আমাদের রাষ্ট্রীয় আইনেও নারীর জন্য যথেষ্ট সুরক্ষার বিধান রয়েছে। তাই আজ নারী-পুরুষের সমতার ব্যাপারটি অস্বীকার করলে তা হবে বেআইনি বা সংবিধান-বহির্ভূত।

সালমা খান: নারীনেত্রী এবং জাতিসংঘের সিডও(CEDAW) কমিটির সাবেক চেয়ারপারসন।