বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে

খালেদা জিয়া
Published : 1 Feb 2013, 06:24 PM
Updated : 1 Feb 2013, 06:24 PM

২০১৩ সালে কি বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের বরফ গলবে? আমার দেশ পনেরো কোটি মানুষের দেশ। ভারত ও মিয়ানমারের মাঝখানে এর অবস্থান। উনিশশো একাত্তরে স্বাধীনতা লাভকারী দেশটিকে অভ্যুদয়ের শুরুতেই যেসব দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্র সেগুলোর অন্যতম। কিন্তু গত ক'বছরে একটি কারণে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কে চিড় ধরেছে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের চর্চা বাধাগ্রস্ত করা হলেও এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্র চুপচাপ রয়েছে, এবং বাংলাদেশের প্রাপ্ত অর্থনৈতিক সুবিধাবলী অন্যান্য বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তির হাতে চলে যাচ্ছে- এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রকে অভিযুক্ত করা যেতে পারে।

এর মানে এ নয় যে, মার্কিন সরকার, কংগ্রেস এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত এজেন্সিগুলো কিছুই করছে না। ছ'মাস আগে, বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতি ও তহবিলের অপব্যবহারের অভিযোগে বাংলাদেশের একটি প্রকল্পে অর্থায়ন প্রক্রিয়া বাতিল করেছে। পদ্মানদীর ওপর প্রায় চার মাইল দীর্ঘ একটি সেতু নির্মাণের জন্য এ ব্যাংকের বাংলাদেশকে দু'বিলিয়ন ডলার দেওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশের গত চল্লিশ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প এটি। বিশ্ব ব্যাংক এ ব্যাপারে একটি যথাযথ তদন্তের দাবি জানিয়েছে।

তাছাড়া, মার্কিন কংগ্রেসের বাংলাদেশ-সংক্রান্ত ককাসের সদস্যরা শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আচরণের সমালোচনা করেছে। ড. ইউনূস প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক বাংলাদেশের কোটি মানুষকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিয়েছে। এ ব্যাংক ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের জন্য পুরষ্কার পেয়েছে। অথচ সরকার ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ড. ইউনূসকে সরিয়ে দিয়েছে। কেন তাকে সরানো হল? অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন যে, পুরষ্কারটি ভুল ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে: ''বাংলাদেশের কেউ যদি নোবেল পুরষ্কার পাওয়ার যোগ্য হয়ে থাকেন তবে তিনি হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।''

বেশিরভাগ বাংলাদেশিই এটা মানবেন না যে শেখ হাসিনা পুরষ্কার পাওয়ার মতো কিছু করেছেন। ২০০৯ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত কাগজে-কলমে প্রায় তিনশ লোক নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে, যার জন্য দায়ী প্রধানমন্ত্রীর র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন- পুলিশের একটি প্যারামিলিটারি শাখা। ওই ব্যক্তিদের পরিবারের কাছে শেখ হাসিনার নোবেলপ্রাপ্তির উপযুক্ততার কথা জিজ্ঞেস করে দেখুন। এ সরকারের সময় খুন হয়েছেন শ্রমিক-অধিকার নেতা আমিনুল ইসলাম, যে জন্য এএফএল-সিআইও মার্কিন-বাংলাদেশ বাণিজ্য সম্পর্কে বাংলাদেশ যেসব সুবিধা পাচ্ছে তা ফিরিয়ে নিতে ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে। আমিনুলের পরিবারের কাছে প্রধানমন্ত্রীর নোবেল পাওয়ার যোগ্যতা নিয়ে কথা বলে দেখতে পারেন। বাংলাদেশের স্থানীয় অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যে রাজনৈতিক নেতাদের বিচার চলছে, তাদের বিরুদ্ধে একাত্তরে গণহত্যায় যুক্ত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে- সে নেতারা ও তাদের সমর্থকরা প্রধানমন্ত্রীর নোবেল পুরষ্কারপ্রাপ্তির যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন।

শেখ হাসিনা সরকার শুধুমাত্র তাঁর শাসনের বিরোধিতাকারীদের যুদ্ধাপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেছেন বলে যুদ্ধাপরাধ-সংক্রান্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত সমালোচনা করেছেন। গত ডিসেম্বরে ইকোনমিস্ট পত্রিকায় ফাঁস হয়ে যাওয়া ট্রায়াল-সম্পর্কিত কিছু ই-মেইল ও ফোন কল প্রকাশিত হয়েছে। তাতে দেখা গেছে যে, শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার জন্য কীভাবে তাঁর সরকার ট্রায়ালের বিচারকদের ব্যবহার করছেন।

সোজা সরল ভাষায়, গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশ এশিয়ার অন্যতম সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার দিক থেকে সরে এসেছে, খুব দ্রুত এটি একটি পরিবারের ক্ষমতালিপ্সা পূরণের হাতিয়ার হয়ে উঠছে। প্রধানমন্ত্রী এখন চেষ্টা করছেন সংবিধান থেকে নির্বাচনের ছ'মাস আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা বাতিল করে দিতে। বস্তুত, তিনি নিজেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করতে সহায়তা করেছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হল একটি অরাজনৈতিক সরকার যেটি জাতীয় নির্বাচনের আগে ক্ষমতা গ্রহণ করে এবং কোনো ধরনের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই নির্বাচন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে।

নির্বাচনের সময় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা থাকা মানে এর নিশ্চয়তা দেওয়া যে, নির্বাচন হবে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ। ভোটাররা নতুন সরকারকে নির্বাচিত করার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার এ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এ বছর অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করার সরকারি পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লাখো জনতা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করেছে। তবু শেখ হাসিনা তাঁর সিদ্ধান্তে অটল, তিনি মনে করছেন যে এভাবে তিনি পুননির্বাচিত হবেন, যদিও জনগণ তাঁকে চায় না।

বাংলাদেশের প্রতিবেশি রাষ্ট্র বার্মা নির্বাসন থেকে মুক্ত হয়ে নতুন পথে হাঁটতে শুরু করেছে, পুননির্বাচিত হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথম সফরেই সে দেশে গিয়েছেন। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারত এর অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। সেখানে বাংলাদেশ যদি কোনো পরিবারের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে, তাহলে পুরো অঞ্চলটিই অনেক পিছিয়ে যাবে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময় এলাকা, কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে মুক্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে সাহায্য করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশের জনগণও ব্যালট বাক্সে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং এর মিত্র রাষ্ট্রগুলো, যেমন গ্রেট ব্রিটেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করতে পারে যাতে নির্বাচনে জনগণের মত প্রতিফলিত হয়। বাংলাদেশকে গণতন্ত্রায়নের পথ থেকে সরে না আসার জন্য এ দেশগুলোকে অবশ্যই আরও কঠোর ভাষা ব্যবহার ও কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। কংগ্রেস ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ড. ইউনূসের মতো মানুষকে আরও সম্মান দিতে পারে- দারিদ্র্য দূরীকরণে তিনি যে অবদান রেখেছেন সে কথা শেখ হাসিনার মতো মানুষেরা যেখানে স্বীকার করছেন না।

তারা শেখ হাসিনাকে এটাও বোঝাতে পারেন যে, বাণিজ্য থেকে যে সাধারণ সুবিধাগুলো বাংলাদেশ পেয়ে থাকে, সেগুলো তুলে নেয়া হবে যদি শ্রমিক অধিকারের পক্ষে যারা লড়াই করছেন বা প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে যাদের অমিল রয়েছে তাদের মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়া না হয়। বাংলাদেশে গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিপক্ষে যারা কাজ করছেন তাদের ভ্রমণ ও অন্যান্য মঞ্জুরির ব্যাপারে পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিশেষ বিবেচনা রাখা উচিত। এসব ভূমিকা তাদের খোলাখুলি রাখতে হবে, বলতে হবে এ নিয়ে- তাতে এ দেশের জনগণ তা দেখতে ও শুনতে পাবে। আর এভাবেই যুক্তরাষ্ট্র গোটা বিশ্বে গণতন্ত্রায়নের প্রক্রিয়া চালু রাখতে পারে।

বলা হয়, ''ন্যায়বিচারের আদালতের চেয়েও উচ্চতর আদালত রয়েছে, আর তা হল নৈতিকতার আদালত।'' শেখ হাসিনার অধীনে বাংলাদেশে গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও দারিদ্র্য দূরীকরণের মতো উচ্চ নৈতিকতার বিষয়গুলো নিরাপদ থাকবে এটা অসম্ভব। বস্তুত, এ সময়ে সবকিছুই চরম বিপদের মুখোমুখি। মার্কিন নেতৃত্বে পুরো বিশ্বকে এখন বাংলাদেশে গণতন্ত্র-রক্ষার জন্য কাজ করতে ও নিশ্চয়তা দিতে হবে।

[দ্য ওয়াশিংটন টাইমস-এ ৩০ জানুয়ারি ২০১৩ সালে প্রকাশিত  The thankless role in saving democracy in Bangladesh  নিবন্ধের বাংলা অনুবাদ করেছেন ফারহানা মিলি ]