ঐক্যবদ্ধ হয়েই জামায়াতকে মোকাবেলা

কামাল লোহানী
Published : 31 Jan 2013, 05:58 PM
Updated : 31 Jan 2013, 05:58 PM

জামায়াত ইদানিং যে ধরনের কাণ্ডকীর্তি করছে বা যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তা মোটেই সহ্য করার মতো নয়। হরতাল ডাকার পরপরই তারা নানা ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম শুরু করে দিয়েছে। এসব একেবারে অগ্রহণযোগ্য।

আমার কথা হল, জামায়াত তো এ দেশের দল নয়। আমরা ভুলে যাইনি একাত্তরের কথা। সে সময় ওরা আমাদের স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটি গঠিত হোক এটা ওরা চায়নি। তাই এদেশের সাধারণ মানুষের ওপর নৃশংস আচরণ করতে পাকিস্তানি বাহিনিকে সর্বাত্মক সহায়তা করেছিল ওরা। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে কোটি মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করেছিল। কী অধিকার আছে জামায়াতের যে তারা এ দেশের মানুষের জীবন আবারও বিপর্যস্ত করে নিজেদের দাবির পক্ষে কথা বলবে? ওদের তো এ দেশে বাস করার অধিকারই নেই। একাত্তরের অপরাধের জন্য আরও আগেই শাস্তি প্রাপ্য ছিল ওদের।

আমার মতে, বাহাত্তরেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা সম্পন্ন করা উচিত ছিল। তাহলে আজ তাদের যে ঔদ্ধত্য আমাদের সহ্য করতে হচ্ছে তা করতে হত না। এখন দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, প্রতিরোধ করতে হবে জামায়াতে ইসলামীকে।

যে সব রাজনৈতিক দল জামায়াতের রাজনীতি পছন্দ করেন না বা সমর্থন করেন না, রাজনীতির সে শক্তিগুলো একতাবদ্ধ হয়ে জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি প্রতিহত করতে পারে। অনেক রাজনৈতিক দল কৌশলে জামায়াত-বিরোধিতা করেন, সামনাসামনি জামায়াতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস করেন না, তাদের কথা বলছি না। যারা জামায়াতের সামনাসামনি বিরোধিতা করার সাহস রাখেন, তাদের একতাবদ্ধ হতে হবে। যারা রাজনৈতিকভাবে, আদর্শিকভাবে জামায়াতসহ সব ধরনের ধর্মান্ধতা ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বিরোধিতা করেন, তারা এখন এক হবেন- এছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।

সত্যিকার অর্থে বলতে গেলে, জামায়াতের রাজনীতিকে আমি রাজনীতি মনে করি না। এটা হল সন্ত্রাসনীতি, জঙ্গীনীতি, মানুষ-হত্যার নীতি। এটা কোনো সুস্থধারার রাজনীতি নয়। এটা দেশের জনগণের দুর্ভোগ বাড়ানোর রাজনীতি। তাই সম্প্রতি দেশজুড়ে জামায়াতের চালানো তাণ্ডবে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।

এ প্রসঙ্গে একটি কথা বলব। পুলিশ নানা সমযে জামায়াতিদের প্রতিহত করতে ব্যর্থ হচ্ছে। পুলিশের এ ব্যর্থতার কারণ আমি জানি না। অথচ অন্যা্ন্য রাজনৈতিক দল বা কোনো কোনো গ্রুপের আন্দোলনের সময় দেখেছি, পুলিশ বেশ শক্ত হাতে দমন করেছে তাদের, পিটিয়েছে। আর জামায়াতের বেলায় ঘটছে উল্টো ঘটনা। পুলিশ এখানে ব্যর্থতার সঙ্গে মার খাচ্ছে। এটা খুব আশ্চর্যজনক একটি বিষয় আমার কাছে। স্বস্তির বা শান্তির বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে জামায়াতকে শক্ত হাতেই প্রতিহত করতে হবে। কারণ এগুলো হচ্ছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি।

সম্প্রতি সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি জাতীয় সম্মেলন করেছি আমরা। এটা একটা বিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। এখন দরকার সম্মিলিত উদ্যোগ। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে একটি মঞ্চ তৈরি করে সারা দেশব্যাপী একটি অভিযাত্রা তৈরি করতে হবে। আমরা যারা ওই জাতীয় সম্মেলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, তাদের সঙ্গে সমাজের আরও অন্যান্য অংশ যদি যুক্ত হয়, তাহলে এর জোর অনেক বেশি হবে।

আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির তৎপরতা কিন্তু নতুন নয়। সবসময়ই এ শক্তি গণতন্ত্র, প্রগতিশীলতা ও মানবতার পক্ষের শক্তিকে পরাজিত করতে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থেকেছে। সময় পেলেই আঘাত করেছে সুস্থ ও আধুনিক চিন্তার মানুষকে। তাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করার চেষ্টা করেছে। তাই আসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার জন্য, সমাজতান্ত্রিক আদর্শে যদি আমরা সত্যিকারভাবেই আস্থা রাখি- তাহলে ওদের প্রতিহত করার বিকল্প নেই।

আমি মনে করি সব ধরনের ধর্মীয় বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা উচিত। তবে একসময় আমি মনে করতাম যে জামায়াত বা এ রকম কিছু দলের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করা উচিত। কিন্তু এখন আমার মনে হয়, এদের নিষিদ্ধ করা হলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে না। কারণ তখন এরা আত্মগোপন করে ভেতরে ভেতরে শক্তি সঞ্চয় করে সবল হয়ে উঠবে। তাই আমার মনে হয়, ওদের আপাতত নিষিদ্ধ করে নয়, রাজনীতি করতে দিয়েই প্রতিহত করতে হবে। ওদের যে সব গোপন আড্ডাখানা রয়েছে, সে সব জায়গায় প্রয়োজনে হানা দিয়ে ওদের গ্রেফতার করে দমন করতে হবে।

তবে শুধু সরকার কেন, সমাজের সব শক্তিকে এগিয়ে আসতে হবে। আজ সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী একটি মঞ্চ তৈরি হয়েছে, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কাজ করছে- সব ফোরাম থেকে একযোগে ওদের প্রতিহত করার জন্য কাজ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা, ২০০৮ সালের নির্বাচনে তরুণ ভোটাররা জামায়াতের বিরুদ্ধে তাদের ম্যান্ডেট দিয়েছিলেন। সেই ভোটাররা কিন্তু এ চার বছরে আরও ম্যাচ্যুরিটি অর্জন করেছেন। তাদের চিন্তাভাবনা আরও প্রখর হয়েছে। আরেকবার তাদের সঙ্গে নিয়ে ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে দমন করতে হবে।

আমি মনে করি না যে, এদেশের জনগণের কাছে এ শক্তির বিরুদ্ধে আহ্বান জানালে জনগণ তা গ্রহণ করবেন না। আজকে যে মঞ্চটি আমরা তৈরি করেছি তাকে আরও বড় করে কাজ শুরু করতে হবে। আসলে এখন আমাদের সমস্যা হচ্ছে ওভাবে আহ্বান জানানোর মতো লোক নেই, তাই জামায়াতের বিরুদ্ধে শক্ত প্লাটফর্ম তৈরি হচ্ছে না।

মনে রাখতে হবে যে, এখন জামায়াত রাজনীতি করছে নতুন রূপে, ক্যামোফ্লেজ তৈরি করে। এখন ওরা আর টুপি-দাঁড়ি পরে এ রাজনীতি করে না, আর সবার মতো্ই জিন্সের প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে তারা। এভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে তারা জনগণের মধ্যে ঢুকে পড়ার চেষ্টা করছে। তাই জনগণের মধ্যে যদি এ ব্যাপারে সচেতনতা থাকে, তার পাশের লোকটি কে বা কী তা জানবার চেষ্টা যদি থাকে, তাহলে তাদের চিহ্নিত করা যাবে। আজকে যদি পাড়ায়-মহল্লায় এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়, তাহলে মনে হয় না যে ওরা কোথাও গোপন আড্ডাখানা তৈরি করে কাজকর্ম চালাতে পারবে।

আমাদের তরুণ প্রজন্মের খুব বড় কোনো অংশ যে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এটা আমি মনে করি না। হ্যাঁ, ওরা কিছুটা এগুতে পারছে জনগণের মধ্যেকার ধর্মীয় চেতনা ব্যবহার করে। আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে যে ধর্মভীরুতা আছে, যে সরলতা আছে, সেটা ওদের জন্য একটি উর্বর ক্ষেত্র। আমরা তো সবসময় বলে এসেছি- ধর্মনিরপেক্ষতা মানে কিন্তু ধর্মহীনতা নয়। ধর্মীয় বিশ্বাস প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব সম্পদ। কিন্তু রাষ্ট্রের কোনো ধর্মীয় পরিচয় থাকতে পারে না। এটাই ধর্মনিরপেক্ষতার মূল কথা। কিন্তু ওরা অনেককে বিভ্রান্ত করছে এটা বলেই যে, জামাযাতে ইসলামীর রাজনীতিতে যুক্ত হলে ঐশীশক্তির প্রিয় হয়ে ওঠা যাবে ইত্যাদি ইত্যাদি।

তাছাড়া তরুণদের সামান্য একটি অংশকে ওরা দলে টানতে পারছে কিছু বৈষয়িক সুবিধা দিযেও। ওদের লেখাপড়ার খরচ দেওয়া, ভালো চাকরির প্রলোভন দেওয়া, এমনকি বাসস্থান ইত্যাদির ব্যবস্থা করেও ওরা কিছু কিছু তরুণকে আকৃষ্ট করছে। ধর্মান্ধ রাজনীতি যারা করে তাদের তো পয়সার অভাব নেই। এন্তার টাকাপয়সা দিয়ে ওরা লোকজনকে পুষতেও পারে। এভাবে টাকাপয়সা আর ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে ওরা কাজ করছে।

আমার ব্যক্তিগত মত হল যে, আমাদের জনগণের মধ্যে জামায়াতের খুব শক্ত শেকড় আছে এটা একেবারে ভুল একটি ধারণা। ২০০৮ সালের নির্বাচনের ফলাফল এর একটি বড় প্রমাণ। জামায়াতে ইসলামীকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। তা না হলে মতিউর রহমান নিযামীর মতো লোক নির্বাচনে প্রত্যাখ্যাত হয় কীভাবে? দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর মতো লোকের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলায় মানুষ সাক্ষ্য দেয় কীভাবে?

রাজনৈতিক দলগুলোর কিছু ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে ওরা এগুতে চাচ্ছে। প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও জাতীয়তাবাদী- সব ধরনের রাজনৈতিক দলই সত্যিকার অর্থে জনগণের কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসছে না। আজকে বিরোধী দল সংসদে যায় না। আবার ওরা সংসদে গেলে সরকারি দল কথা বলতে দেয় না। অথচ আমাদের দেশেই একসময় পূর্ব পাকিস্তান অ্যাসেম্বলিতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে চেয়ার-ছোঁড়াছুড়িতে একজন ডেপুটি স্পিকার খুন পর্যন্ত হযেছেন। আমি বলছি না সংসদে তেমন নৃশংস কিছু হতে হবে। সংসদে দু'দল আলোচনা করবে, বিতর্ক করবে, সংসদ প্রাণবন্ত থাকবে এটাই তো গণতন্ত্রের নিয়ম। আমাকে সংসদে কথা বলতে দেওয়া হবে না বলে যে আমি ওখানে যাব না এটা তো হয় না। বিরোধী দল মনে রাখতে চায় না যে ওরাও সরকারের অংশ। সংসদে না গেলে এটা জনগণের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়ে জনগণকে প্রতারিত করার শামিল। অথচ জনগণের টাকায় সব সুযোগ-সুবিধা ঠিকই নেয়া হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর এসব পারস্পরিক হানাহানির সুযোগ নিয়েও জামায়াত বেশিদূর এগুতে পারেনি। তবে আমাদের সতর্ক হতে হবে।

আজকে জামায়াত শিবিরকে দমনের জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলনকেও বড় একটি ভূমিকা পালন করা উচিত। এ আন্দোলনটা কেমন যেন নিস্পৃহ ও দায়সারা গোছের হয়ে গেছে। একে এখন জোরেশোরে চালাতে হবে। একবারে গ্রামেগঞ্জে গিয়ে জনগণকে সব রকম অপশক্তির বিরুদ্ধে সজাগ করতে হবে। আমাদের নিজস্ব সংগ্রামের গানগুলো, গণসঙ্গীতগুলো দিয়ে জনগণের চেতনা নাড়া দেওয়া যায়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন করে পুরনো গানগুলো বাঁধতে হবে। যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তান ও সৌদি আরবের নানা চক্রান্ত রয়েছে। পাশাপাশি দেশীয় চক্রান্তকারীরা এখনও সক্রিয় রয়েছে। এগুলোর ওপর গান তৈরি করা দরকার।

মনে রাখতে হবে, রাজনৈতিক সংগ্রামের আগে সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। সাংস্কৃতিক সংগ্রামই রাজনৈতিক সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করে, একে এগিয়ে দেয়। তাই এ সংগ্রাম শক্তিশালী হলে সব ধরনের ধর্মভিত্তিক শক্তি চিরতরে নির্মূল হবে।

কামাল লোহানী : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।