নারী নির্যাতনের ভাইরাস

Published : 30 Jan 2013, 10:36 AM
Updated : 30 Jan 2013, 10:36 AM

দেশ কি নারী নির্যাতনের ভাইরাসে আক্রান্ত? না হলে একের পর এ এ ধরনের ঘটনা ঘটছে কেন? ভারতের দিল্লিতে চলন্ত বাসে মেডিকেল ছাত্রীকে গণধর্ষণ ও তাকে গুরুতর প্রহার করে বাস থেকে ফেলা দেওয়া, পরবর্তীতে হাসপাতালে তার মৃত্যু। ঘটনাটি বিশ্ব বিবেককে আলোড়িত করলেও আমাদের দেশে ঘটেছে তার উল্টো ঘটনা। ঘটনাটি শুনে উৎসাহিত হয়ে যেন কতিপয় মানুষের অপরাধপ্রবণতা আরও উস্কে উঠেছে। তারা ভাবছে বাহ, বেশ তো এভাবেও তাহলে ধর্ষণ করা যায়! দিল্লিতে না হয় অপরাধীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হবে। আমাদের দেশে তো সে ভয় নেই, অতএব আর চিন্তা কী?

মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে পোশাকশ্রমিককে ধর্ষণের পরপরই আরেকটি ঘটনা, সিএনজিতে সহযাত্রীকে ধর্ষণ। আর শিশুধর্ষণ তো চলছেই। রাজধানীর মেহেরবা প্লাজায় শিশুকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় এলাকাবাসী প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল করেছে। পাঁচ বছরের শিশুও রেহাই পাচ্ছে না। শিশুকে ধর্ষণের চেষ্টার দায়ে গ্রেপ্তার, পরবর্তীতে জামিনে বের হয়ে এসে সেই শিশুকেই ধর্ষণ ও হত্যা- এমন নৃশংস ঘটনাও বাংলাদেশে ঘটেছে। ভাবতে লজ্জা হয় আমরা এমন এক দেশের নাগরিক যেখানে শিশুও নিরাপদ নয়। আর ইডেনের যে ছাত্রীকে ছুরিকাঘাত ও এসিডদগ্ধ করা হল তার একমাত্র অপরাধ ছিল তিনি 'বিয়েতে রাজি হননি।' ভাবখানা এমন যে, নারীর আবার মতামত কী? তাকে যে রাস্তাঘাটে ধর্ষণ না করে 'বিয়ের প্রস্তাব' দেওয়া হয়েছে, এতেই তো তার ধন্য হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ধন্য না হয়ে তিনি আবার রাজি হচ্ছেন না, এ বেয়াদবির শাস্তিস্বরূপ তাকে এসিডদগ্ধ করা হয়েছে।

পাঁচ বছরের যে শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে তার অপরাধও কম ছিল না। ধরা পড়ার পর অপরাধী সদর্পে বলেছে, 'ওকে ধর্ষণ চেষ্টার জন্যই তো আমাকে হাজতে যেতে হয়েছে, সে কারণে জামিনে ছাড়া পেয়েই ওকে ধর্ষণ ও হত্যা করেছি।' যেন ধর্ষণচেষ্টা কোনো অপরাধ নয়, এর বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করাই শিশুটির অভিভাবকের ঘোরতর অপরাধ! আর সে অপরাধে শিশুটিকে হত্যা করতে হবে।

সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, সারাদেশে চলতি জানুয়ারি মাসেই ৩শ'র বেশি নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। তাও তো এ সংখ্যা হল যেসব ক্ষেত্রে থানায় অভিযোগ করা হয়েছে সে সংখ্যা। আর চার দেয়ালের ভিতরে যে অপরাধগুলো ঘটছে তার কোনো হিসেবই নেই।

টাঙ্গাইলের ধর্ষণের ঘটনায় মানবাধিকার কর্মীরা সোচ্চার হয়েছেন। তার পরপরই নারায়ণগঞ্জে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষিত হয়েছেন পোশাকশ্রমিক। ধর্ষণের পাশাপাশি স্ত্রী-হত্যা ও অন্যান্য নির্যাতনের ঘটনাও কিন্ত ঘটে চলেছে সমান তালে। তার মানে নারী নির্যাতন একেবারে সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে সারা দেশে।

'নিপা ভাইরাস', 'অ্যানথ্রাক্স ভাইরাস' এর চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী 'নারী নির্যাতন ভাইরাস।' কারণ নিপা-দমনের কৌশল রয়েছে, 'নারী নির্যাতন ভাইরাস' দমনের কার্যকরী কৌশল এখনও আমাদের সমাজে নেই।

ধর্ষণের অপরাধে যে শাস্তির বিধান রয়েছে তা যথেষ্ট কঠোর হলেও আইনের প্রয়োগ ও ধর্ষণকারীর শাস্তির বাস্তবায়ন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটে না। সাধারণত, ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর প্রান্তিক অবস্থানের কারণে বিচারের বাণী নিরবে-নিভৃতেই কাঁদে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনকারী তার শিকারের তুলনায় আর্থিক ও সামাজিকভাবে থাকে শক্তিশালী। তার ওপর কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় থাকায় অপরাধী অপরাধ ঘটিয়ে আবার শিকারকে বা তার পরিবারকে হুমকি দেয়। ধর্ষণের বিচার চাইতে গিয়ে তখন অভিযোগকারীকে হারাতে হয় জীবন। কিংবা হত্যার বিচার চাইতে গিয়ে শিকারের আত্মীয়দের জীবনও পড়ে হুমকির মুখে। এসব ভয়-ভীতি অতিক্রম করেও যদি বিচার চাইতে যায় কেউ- তাহলে তাকে বহন করতে হয় আইনগত দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যয়ভার। পুলিশের কাছে, ডাক্তারের কাছে, উকিলের কাছে- দ্বার থেকে দ্বারে ঘুরে বেড়াতে হয় তাকে।

এর পাশাপাশি থাকে গ্রাম্য শালিশে ধর্ষণকারীকে 'জুতাপেটা'র মতো মৃদু শাস্তি দিয়ে ধর্ষণের শিকার নারীকে 'চরিত্রহীন' সাব্যস্ত করার তৎপরতা। আমাদের সমাজ এখনও ধর্ষণের শিকার নারীর প্রতি ইতিবাচক নয়। কোনো না কোনোভাবে শিকার নারীর চরিত্রহনন, তাকে সমাজে ব্রাত্য করার প্রবণতা থাকেই। ধর্ষণের শিকার কোনো নারীর যদি মৃত্যু হয় তাহলে তার প্রতি কিছুটা সহানুভূতি থাকলেও শিকার নারী যদি প্রাণে বেঁচে যান তাহলে তাকে সমাজচ্যূত করার প্রবণতা থাকে প্রবল। সে কারণেই সামাজিক সম্মানহানির ভয়ে অনেক নারী বা তার পরিবার ধর্ষণের ঘটনা প্রকাশ করে না। সে কারণে অপরাধীও পার পেয়ে যায় সহজেই।

'নারী নির্যাতন ভাইরাসে' আক্রান্ত সমাজকে রোগমুক্ত করার প্রথম পদক্ষেপ হল কড়া ওষুধ প্রয়োগ। ধর্ষণকারীর দ্রুত বিচার ও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা হলেই সম্ভাব্য ধর্ষকরা সাবধান হবে। 'একজন নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করলে তেমন কিছুই হয় না' এ ধারণা থেকে সমাজকে মুক্ত করা প্রয়োজন। ধর্ষণ যে একটি মামুলি বিষয় নয় বরং গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ যার শাস্তি কঠোর তা জনমনে প্রোথিত করে দেওয়া প্রয়োজন। ধর্ষণ করে কোনোভাবেই রেহাই পাওয়া যাবে না বরং কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে এ কথা যেন জানা থাকে প্রতিটি নাগরিকের।

পাশাপাশি, খুন, ধর্ষণের মতো গুরুতর অপরাধের শাস্তি কী তা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করাও প্রয়োজন। খুব দ্রুত ধর্ষণকারীদের কঠোর শাস্তি বিধান করে গণমাধ্যমে শাস্তিপ্রাপ্তির সংবাদ প্রচার করা প্রয়োজন। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলেই অন্যরা এ ধরনের অপরাধ করার আগে সংযত হবে।

আর নারীর প্রতি, শিশুর প্রতি সমাজকে ইতিবাচক হতে হবে। একটি সমাজ যত বেশি উন্নত ও সভ্য- ততবেশি নারী ও শিশুবান্ধব। যতদিন এ দেশে নারী ও শিশুর আর্তনাদ শোনা যাবে ততদিন নিজেদের সভ্য দাবি করার অধিকার আমাদের নেই। যে সমাজে ধর্ষকরা বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় সে সমাজের প্রতিটি সদস্যরই লজ্জিত হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশ ধর্ষকের দেশ- এ লজ্জা মুছে ফেলার দায় নারীর একার নয়, সমাজের সবার।

শান্তা মারিয়া : কবি ও সাংবাদিক।