যার যা প্রাপ্য

আলী যাকের
Published : 23 June 2010, 05:19 PM
Updated : 23 June 2010, 05:19 PM

আমি রাজনীতি নিয়ে লিখি না। রাজনীতি বুঝি না, তা নয়। তবে এ বিষয়ে লিখি না। কারণ আমাদের দেশের ঘোলা জলকে আরও ঘোলা করার ইচ্ছে আমার নেই। আর তাছাড়া আমাদের অভ্যাসটাই এমন যে, আমি যে কোনো দলের মানুষের একটি ভালো কাজকে প্রশংসা করলে কিংবা খারাপ কাজকে নিন্দা করলে আমাকে কোনো না কোনো পার্টির সীল লাগিয়ে দেয়া হবে। তবুও আমি মনে করি যে, আমাদের নিজেদের কল্যাণের স্বার্থে মনের কথা খুলে বলা দরকার। বিশেষ করে তাদের যারা ক্ষমতার প্রতি প্রলুব্ধ নয়। প্রসঙ্গত বলে রাখি যে আমি রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত না হলেও আমার নিজস্ব একটি রাজনৈতিক বিশ্বাস আমার বোধের সাথেই সম্পৃক্ত আছে। তা না হলে আমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারতাম না। আমি বিশ্বাসী আমার ভাষায়, আমার সংস্কৃতিতে, আমার জাতিসত্ত্বায়, আমার স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং সর্বোপরি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। কোনো দ্বিধা নেই আমার এ কথা বলতে যে, তাঁরই আহ্বানে এবং আমার বিবেকের নির্দেশে আমি মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। আমি এ কথাও নির্দ্বিধায় বলতে চাই যে, আমার সুদীর্ঘ জীবনে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস ছিলো শ্রেষ্ঠ সময়। এ বিষয়ে আমি কোনো সময়, কোনো অজুহাতে আমার জীবন থাকতে আপোস করিনি এবং করবো না।

দিন কয়েক আগে একটি মহা হুলুস্থূল ঘটে গেল যার সম্বন্ধে আমরা সকলেই অল্প-বিস্তর অবহিত আছি। আমাদের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের দেশের আবাসন ব্যবসায়ীরা তুমুল বিতর্ক করলেন। এই বিতর্কের সময় কেউ-কেউ নাকি মাননীয় প্রতিমন্ত্রীকে তর্জনী তুলে শাসিয়েছেন। তর্জনী তোলায় আমি কোনো অন্যায় দেখি না। অনেক সময় অনেক কারণেই আমরা তর্জনী তুলে আঙ্গুলের ভাষায় আমাদের যুক্তির যথার্থতা মজবুত করার চেষ্টা করি। তবে সেই তর্জনী যদি হুমকি প্রদানের জন্য হয়ে থাকে তাহলে অবশ্যই তা গুরুতর অন্যায়। আমাদের গৃহায়ণ মন্ত্রী অত্যন্ত সাহসী মানুষ। তিনি কোনো সময় কোনো জনকল্যাণকর কাজ থেকে পিছিয়ে আসায় বিশ্বাস করেন না। আর এই ঋজু মনোভাব তাঁর বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে স্পষ্ট প্রতিভাত হয়। আমাদের এহেন আপোসহীন মন্ত্রীকে সমর্থন জানিয়েছেন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায়। তাঁকে অভিনন্দন।

"
আজকে প্রতিটি আবাসিক এলাকায় যেভাবে অপরিকল্পিভাবে নির্মাণ কাজ হচ্ছে তাতে করে কোনো একটি বিশাল বিপর্যয়ে এই শহরটি একদিন হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা এই নির্মাণের সঙ্গে জড়িত তারা হয়তো তখন এই শহরের ধারে-কাছেও আর থাকবে না। এই শহর থেকে অর্জিত অর্থে তাদের ভবিষ্যৎ নির্মিত হচ্ছে দেশের বাইরে। প্রকৃতির রুদ্র রোষ বড় সহজ কথা নয়। এই ক্রোধে অনেক বড়-বড় সভ্যতা নিমেষে ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে।
"

আমি এর আগেও বিভিন্ন সময়ে আজকের বিষয়ে লিখেছি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর নিরিখে আবারও লিখতে হচ্ছে। আমরা এমন একটা জাতি যারা ভাষার জন্য আন্দোলন করে প্রাণ দিয়েছি। আমাদের ভাষা শহীদ দিবস আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৪৮ সনে আমাদের এই উপলব্ধি হয় যে, পাকিস্তানের সাথে আমরা বেশিদিন পথ চলতে পারবো না। বাঙালী হিসেবে আমাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং জাতিসত্ত্বা নিয়ে আমাদের হয়তো বা একটি ভিন্ন দেশের প্রয়োজন আছে। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। ১৯৬৬-তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ঘোষণা করেন যা বস্তুতপক্ষে আমাদের স্বাধীনতার প্রথম সনদ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। ১৯৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানকে স্পষ্ট ভাষায় বুঝিয়ে দেই যে, আমরা একসাথে পথ চলতে রাজি নই। আর ১৯৭১-এ এসে অজস্র প্রাণের বিনিময়ে, অনেক মানুষের সম্ভ্রমহানির মধ্য দিয়ে আমাদের এই দেশ অর্জন করে তার স্বাধীনতা। এরপর একটি সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত জনপদে, মহাশক্তিধর দেশগুলোর সক্রিয় বিরোধিতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু যখন আস্তে, আস্তে দেশটিকে অর্থনৈতিক মুক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তির দ্বারা তিনি সপরিবারে নিহত হন। এই জঘন্য হত্যাকাণ্ডের পরে যারা ক্ষমতাগ্রহণ করে তারা আর যাই হোক না কেন বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মঙ্গল কামনা করেনি কখনোই। তারা সবর্দাই নিজেদের ব্যক্তিগত বা পরিবারগত সমৃদ্ধির কথা চিন্তা করেছে। ফলে যে চেতনা, রাজনৈতিক উপলব্ধি এবং সর্বোপরি আবেগ নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিলো, সেই সব মূল্যবোধকে জলাঞ্জলি দিয়ে এক নব্য পাকিস্তানী সংস্কৃতি পুনর্বাসিত হয়।

এই সংস্কৃতি বিগত সাড়ে তিন দশক ধরে আমাদেরকে শিখিয়েছে অবলীলায় দেশের সাধারণ মানুষকে এক অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষেপ করে কেবল নিজেদের স্বার্থে শঠতা, চৌর্য্যবৃত্তি, মিথ্যাচার এবং দুর্নীতির চোরাগলি পথে পথ চলতে। কেবল এই দুষ্কৃতি করতেই যে আমাদেরকে উৎসাহ দেয়া হয়েছে তা নয়। এই সকল অপকর্মের কথা অশিষ্টভাবে বলার দুঃসাহস জুগিয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে আজকের বাংলাদেশের একটি অদ্ভুত মেরুকরণ ঘটছে। একদিকে সাধারণ জনগণ আর অন্যদিকে স্বার্থান্বেষী, অর্থলোভী, নীতি বিবর্জিত একটি ক্ষুদ্র অথচ প্রচণ্ড শক্তিধর জনগোষ্ঠী, যারা অবলীলায় যা খুশি তা-ই করে বেড়াচ্ছে। এদেরকে সংযত করার জন্য যে বুদ্ধিমান, বিবেকশাসিত, সুস্থ চিন্তাধারা-সমৃদ্ধ মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর দরকার সেই জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। অতএব, অসৎ মানুষেরই এখন জয়জয়কার।

যে কোনো দেশের নগর পরিকল্পনায় কতগুলো বিষয়ে লক্ষ্য রাখা একান্ত প্রয়োজনীয়। এই বিষয়গুলো প্রাকৃতিক ভারসাম্য বা ইকোলজিক্যাল ব্যালেন্স রক্ষা করে নিমতলীর মতো কিংবা বেগুনবাড়ির মতো বিপদ থেকে আমাদেরকে রক্ষা করতে পারে। আমি প্রাচুর্যময় বিভিন্ন দেশের বড় শহরগুলোর কথা না-ই বা বললাম। আমাদের প্রতিবেশী শহর কলকাতার দিকেই যদি লক্ষ্য করি, তাহলে দেখতে পাবো যে, ঐ শহরটি যেমন পরিকল্পিতভাবে আজ থেকে প্রায় তিনশ' বছর আগে নির্মিত হয়েছিলো, ঠিক সেভাবেই প্রসারিত হচ্ছে চারপাশে। সকল এলাকায়, তা আবাসিক কি অনাবাসিক যা-ই হোক না কেন, নিদেনপক্ষে একটি পার্ক/খেলার মাঠ সেখানে আছে। একটি জলাভূমি (পুকুর, দীঘি কিংবা লেক) সেখানে আছে। রাস্তাগুলো পরিকল্পিতভাবে যথেষ্ট প্রশস্ত করে তৈরি করা হয়েছে।

আমি বাল্যকাল থেকে নিয়মিতভাবে কলকাতায় যাই। কলকাতা আমার নানাবাড়ি। অতএব সেখানকার প্রতিটি এলাকা মোটামুটি আমার চেনা। কলকাতার টালা থেকে টালিগঞ্জ পর্যন্ত প্রত্যেকটি এলাকা মানুষের ন্যূনতম চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে নির্মাণ করা হয়েছে। আর আমাদের এই শহর একেবারেই তার উল্টো। অর্থাভাবের জন্য সব এলাকায় খানা, খন্দ, ডোবা, পুকুর ভরাট করে বাচ্চাদের খেলার মাঠ দখল করে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ইমারত অবলীলায়। ঢাকার চারপাশে নদী অথবা জলাভূমি সবসময় ছিলো এবং এখনো কিছু অবশিষ্ট আছে। ঢাকার ভেতর দিয়ে দোলাইখাল, বেগুনবাড়ির খাল, মতিঝিলের ঝিল ইত্যাদি আমরা আমাদের তারুণ্যেও দেখেছি। অথচ এর সবই এখন অর্ধগৃধ্নু ব্যবসায়ীদের লোভের শিকার। এই কারণে অতি বৃষ্টিতে বন্যায় এই শহর ভাসছে আর খরায় মরুভূমির তাপে আমাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত হচ্ছে। কলকাতার চৌরঙ্গী, রেড রোড, এবং গঙ্গাপাড়ের রাস্তা সংলগ্ন যে বিশাল ময়দান সবুজ বৃক্ষরাজি বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, যাকে আমরা গড়ের মাঠ বলে জানতাম আমাদের বাল্যকালে, আমি নিশ্চিত যে, আমাদের গৃহনির্মাতারা ঐ ময়দান দেখলে তাদের চোখ দুটো চক চক করে উঠবে। তারা হয়তো ভাববে এই শহরের লোকগুলো কী বোকা! এত বড় একটা জায়গা খালি ফেলে রেখেছে?

আমি একেক সময় অবাক হয়ে ভাবি যে, আজকে প্রতিটি আবাসিক এলাকায় যেভাবে অপরিকল্পিভাবে নির্মাণ কাজ হচ্ছে তাতে করে কোনো একটি বিশাল বিপর্যয়ে এই শহরটি একদিন হয়তো ধ্বংস হয়ে যাবে। যারা এই নির্মাণের সঙ্গে জড়িত তারা হয়তো তখন এই শহরের ধারে-কাছেও আর থাকবে না। এই শহর থেকে অর্জিত অর্থে তাদের ভবিষ্যৎ নির্মিত হচ্ছে দেশের বাইরে। প্রকৃতির রুদ্র রোষ বড় সহজ কথা নয়। এই ক্রোধে অনেক বড়-বড় সভ্যতা নিমেষে ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে। আমরা যদি প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা করতে ব্যর্থ হই তাহলে প্রকৃতি অবশ্যই একদিন প্রতিশোধ নেবে। বস্তুতপক্ষে নিয়েই চলেছে প্রতিনিয়ত।

আমরা যত বেশি গ্রাম, গঞ্জ, মাঠ, জনপদ, নদী এবং জলাভূমি উজাড় করছি তত ভয়াবহ হয়ে উঠছে বন্যা, খরা, ঝড় কিংবা ভূমিকম্প। উচিত ছিলো আমাদের বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষের, এ বিষয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সামনে এগিয়ে আসা, যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমরা তা করতে পারিনি। কিন্তু আমাদের সরকার এই প্রথমবারের মতো আপোসহীনভাবে এগিয়ে এসেছে।

যার যা প্রাপ্য, তাকে তা দিতেই হবে। সাধুবাদ জানাতেই হবে আমাদের গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীকে। অভিবাদন জানাতে হবে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এহেন একটি জনহিতকর পদক্ষেপে প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।

আশা করি ক্ষমতাসীন দলে যারা গৃহায়ণ ব্যবসার সাথে সংশিষ্ট তারা নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থকে ভুলে গিয়ে গণ মানুষের স্বার্থে তাদের নিজেদের সরকারকে সমর্থন দেবেন। আগত দিনের রবির রশ্মি ছড়িয়ে পড়ুক দিক-দিগন্তে আর তারই ছন্দে-আনন্দে আসুন, আমরা এগিয়ে চলি কর্তব্যসিদ্ধির পথে।