বহির্বিশ্বে ‘বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ডের অবস্থা

এইচ এম মহসীন
Published : 18 Jan 2013, 06:49 AM
Updated : 18 Jan 2013, 06:49 AM

সম্প্রতি বেশ কিছু ঘটনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় খবরের শিরোনাম হয়েছে। অস্বীকার করার জো নেই যে, গত কয়েকমাসের আলোচিত এ ঘটনাগুলোর অধিকাংশই বাংলাদেশের জন্য নেতিবাচক। ২৪ নভেম্বর ঢাকার অদূরে তাজরীন ফ্যাশন লিমিটেডে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের নির্মম ট্র্যাজিডি, অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রে নাফিস নামের বাংলাদেশি যুবকের হামলা-পরিকল্পনা এবং পদ্মাসেতু-দুর্নীতি নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের চলমান দরকষাকষি এসবের মধ্যে অন্যতম। ঘটনাগুলো নিয়ে কেউ কেউ ষড়যন্ত্র-তত্ত্ব খুঁজছেন, কেউবা আবার উঁদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। এসব ঘটনার ক্ষেত্রে দোষ যারই হোক, বাস্তবতা হল- বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক বার্তা পৌঁছে গেছে এবং কান্ট্রি ব্র্যান্ড হিসেবে 'বাংলাদেশ' এর অভাবনীয় ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

ব্র্যান্ডিং কনসেপ্টটি যেহেতু মার্কেটিং-এর একটি শাখা (আসলে মার্কেটিং-এর প্রাণ হচ্ছে ব্র্যান্ড), তাই মার্কেটিং-এর আধুনিক কিছু পরিমাপকের (measures) আলোকেই বহির্বিশ্বে 'বাংলাদেশ' ব্র্যান্ডের বর্তমান অবস্থা বোঝার চেষ্টা করে দেখা যাক। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কনস্যুমার প্রোডাক্ট কোম্পানিগুলো তাদের ব্র্যান্ডিং-এর সফলতা নির্ণয় করার জন্য বেশ কিছু নির্দেশক (Key Performance Indicator) নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে, ব্র্যান্ড-পরিচিতি ও ব্র্যান্ড-অ্যাসোসিয়েশন (ব্র্যান্ডটিকে ভোক্তারা কীভাবে দেখে), ব্র্যান্ড-কনসিডারেশন (ভোক্তারা ব্র্যান্ডটি ব্যবহারের জন্য বিবেচনা করে কিনা) এবং ব্র্যান্ড-ফেবারিবিলিটি (ভোক্তারা ব্র্যান্ডকে প্রিয় ব্র্যান্ড হিসেবে গণ্য করে কিনা)। ভোক্তাদের মনোভাব নিয়মিত গবেষণা করে এ নির্দেশকগুলোকে পরিমাপ করা হয়। যদিও কান্ট্রি ব্র্যান্ডিং-এর ক্ষেত্রে 'বাংলাদেশ' এর চেষ্টার সফলতা নির্ণয়ের জন্য কোনো গবেষণা/জরিপের পরিসংখ্যান আমার কাছে নেই, তবে গুণগতভাবে ব্র্যান্ড মার্কেটিং-এর এ ক'টি বিষয়ের ভিত্তিতে 'বাংলাদেশ' ব্র্যান্ডের অবস্থান বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি।

প্রথমত, সফল ব্র্যান্ডিং-এর অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে, ব্র্যান্ড-পরিচিতি (brand awareness)। একটি ব্র্যান্ড যদি তার টার্গেট ভোক্তারা না চেনে, তাহলে ব্র্যান্ডিং-এর বাকি সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ। পছন্দ করুন আর না করুন, উপমহাদেশের বাইরে বাংলাদেশের পরিচিতি খুব একটি বেশি নেই। যারা উপমহাদেশের বাইরে (ইউরোপ, আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায়) গিয়েছেন, তারা এ ব্যপারে একমত হবেন। আমাদের দেশের অনেকেই মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস অথবা ক্রিকেট বিশ্বকাপ খেলার সুবাদে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে অত্যন্ত পরিচিত। তবে বাস্তবতা হল, উপমহাদেশের বাইরে ক্রিকেট খেলা নিয়ে যেমন খুব মাতামাতি নেই, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বা ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারেও মানুষের অত জ্ঞান বা আগ্রহ নেই।

দ্বিতীয়ত, সফল ব্র্যান্ডিং-এর জন্য শুধু পরিচিতিই যথেষ্ট নয়, ব্র্যান্ড-অ্যাসোসিয়েশন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটি ব্র্যান্ড তার টার্গেট ভোক্তারা কীভাবে চেনে, এ ব্র্যান্ডের প্রসঙ্গ উঠলে তাদের মনে কী ছবি ভেসে ওঠে বা কী কথা মনে আসে সেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। ডেসটিনি নামের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশের প্রায় সবাই চেনে, অর্থাৎ এদের ব্র্যান্ড-পরিচিতি অত্যন্ত ব্যাপক। কিন্তু ডেসটিনির কথা মনে হলে বেশিরভাগ মানুষের মনেই ভেসে ওঠে একটি প্রতারক প্রতিষ্ঠানের কথা, যারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া ব্যাংকিং ব্যবসায় জড়িত হয়ে দেশের অসংখ্য মানুষের বিনিয়োগ হুমকির মুখে ফেলেছে। তাই শুধু পরিচিতি নয়, বরং ইতিবাচক পরিচিতি একটি ব্র্যান্ডের সফলতার জন্য অপরিহার্য। এবার দেখা যাক, এ ইতিবাচক পরিচিতির মাপকাঠিতে বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়।

বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে যারা চেনেন, তাদের বেশিরভাগই বাংলাদেশকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কবলিত দেশ হিসেবে জানেন। তবে দু'দশক ধরে তৈরি পোশাক উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে এবং ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে সফলতার কারণেও বাংলাদেশ অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে পরিচিতি পায়। ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশে সফল হয়েছে কিনা সে ব্যপারে ইতোমধ্যেই অনেক বিতর্ক হয়েছে এবং সে ব্যপারে আলোচনা করা এ লেখার উদ্দেশ্য নয়। তবে, ব্র্যান্ডিং করার প্রেক্ষিতে বিবেচনা করলে বলতে হবে, ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতার যে পারসেপশন (ধারণা বা বিশ্বাস) বহির্বিশ্বে তৈরি হয়েছে, সেটি বাংলাদেশকে ইতিবাচক ব্র্যান্ড হিসেবে উপস্থাপিত করেছে। অন্যদিকে, বিশ্বে বাংলাদেশ যে একটি অসাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসবিরোধী, মডারেট দেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল, তাতে কালিমা লেপন করেছে গত অক্টোবরে নাফিস নামের বাংলাদেশি যুবকের নিউইয়র্ক ফেডারেল ব্যাংকে হামলা-পরিকল্পনার খবর।

সর্বশেষ, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডের খবর তো সারা বিশ্বের নজর কেড়েছে। যদিও এটি একটি দুর্ঘটনা ছিল, কিন্তু একথা সত্যি যে, ফায়ার কোড মেনে ফ্যাক্টরি তৈরি করা নিশ্চিত করতে পারলে এ দুর্ঘটনার ভয়াবহতা অনেক কম হতে পারত। আর ফায়ার-স্কেইপ গেইটে তালা দিয়ে শ্রমিকদের ফ্যাক্টরি থেকে বের হতে না দেওয়া যে বর্বর হত্যাকাণ্ড সেটি অস্বীকার করার কি খুব সুযোগ আছে? মূলত, এ ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের গার্মেন্টসে শ্রমিকদের মানবেতর জীবনের চিত্র অত্যন্ত নগ্নভাবে ফুটে উঠেছে। এসব ঘটনার কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে বহির্বিশ্বে নেতিবাচক ভাবমূর্তি ফুটে উঠেছে এবং এর ফলে নেতিবাচক ব্র্যান্ড-অ্যাসোসিয়েশনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তৃতীয়ত, একটি ব্র্যান্ড প্রতিষ্ঠিত করে সেটিকে ভোক্তাদের প্রিয় ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার পূর্বশর্ত হচ্ছে, ওই ব্র্যান্ডকে ভোক্তাদের কনসিডারেশন সেটে উন্নীত করা। সাধারণত, একটি পণ্যের ব্র্যান্ডিং সফল হলে, ক্রেতাদের মধ্যে ওই পণ্য সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয় এবং পরবর্তী ক্রয়ের সিদ্ধান্তের সময় ওরা ওই ব্র্যান্ড বিবেচনা করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একজন ক্রেতা টিভি কিনতে গেলে হয়তো, স্যামসাং, সনি, এলজি ইত্যাদি ব্র্যান্ড বিবেচনা করে। এর অর্থ হচ্ছে, এ ব্র্যান্ডগুলো সফলভাবে ওই ক্রেতার কনসিডারেশন সেটে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। তাই একটি ব্র্যান্ডকে যত বেশি ভোক্তারা বিবেচনা করবে, ওই ব্র্যান্ডের সফলতার সম্ভাবনা তত বেশি।

'বাংলাদেশ' ব্র্যান্ডিং-এর প্রচেষ্টার প্রাথমিক টার্গেট ভোক্তা হিসেবে বিদেশি বিনিয়োগকারী এবং পর্যটকদের বিবেচনা করে বলা যায়, সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর কারণে 'বাংলাদেশ' এর ব্র্যান্ড-কনসিডারেশন কমেছে। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও নিরাপত্তার মান সন্তোষজনক না হওয়ায়, বাংলাদেশে ব্যবসায় জড়িত হলে পরবর্তীতে তাদের ব্র্যান্ডের উপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার, পদ্মাসেতু-দুর্নীতি নিয়ে উত্থাপিত অভিযোগের ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি তৈরি হওয়া খুবই স্বাভাবিক। দুর্নীতির কারণে বিনিয়োগের অপটিমাল ব্যবহার না হওয়ার শঙ্কায় তারা বাংলাদেশকে বিনিয়োগের উপযোগী হিসেবে বিবেচনা করতে নিশ্চয়ই দ্বিধান্বিত হবেন। এরই মধ্যে পর্যাপ্ত বৈদেশিক বিনিয়োগ না আসায় আমরা অর্থমন্ত্রীকে হতাশা প্রকাশ করতে দেখেছি।

চতুর্থত, একটি ব্র্যান্ড যত বেশি ভোক্তাপ্রিয় ব্র্যান্ড হিসেবে বিবেচনা হবে, ওই ব্র্যান্ড তত বেশি সফল। শতকরা হিসেবে এ শ্রেণির ভোক্তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি, ওই ব্র্যান্ডের ক্রমাগত উন্নতিই নির্দেশ করে। বিশ্বমিডিয়ায় সাম্প্রতিক নেতিবাচক ঘটনাবলীর উপর আলোকপাত যে 'বাংলাদেশ'কে বিদেশি বিনিয়োগকারী ও পর্যটকদের প্রিয় ব্র্যান্ডে পরিণত করেনি সেটি বুঝতে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। বরং এ ধরনের নেতিবাচক ঘটনা তাদের অনুকূল মনোভাবে চিড় ধরতে সাহায্য করে সেটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ড ও পদ্মাসেতু-দুর্নীতির অভিযোগ যেমন বিনিয়োগকারীদের নিরুৎসাহিত করে, তেমনি দেশব্যপী লাগাতার হরতাল ও সহিংসতা বিদেশি পর্যটকদের মধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রতিকূল মনোভাব তৈরি করে।

আগেই বলেছি, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর জন্য দায়ী যে বা যারাই হোক না কেন, দেশ হিসেবে 'বাংলাদেশ' ব্র্যান্ডের উপর কিন্তু এগুলো অত্যন্ত নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এ ঘটনাবলীর প্রভাব কাটিয়ে ওঠা খুবই সম্ভব এবং বাংলাদেশকে একটি উন্নয়নশীল, অসাম্প্রদায়িক, নির্ভরযোগ্য ব্যবসা-সহযোগী ও আকর্ষণীয় পর্যটনের কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।

এ আশাবাদের ভিত্তি হচ্ছে, গত কয়েক দশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যবসাক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্যগাথা। অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ক্রমাগত রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভিন্ন দলীয় সরকারের সীমাহীন দুর্নীতির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও ৬-৭ শতাংশ হারে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। শিক্ষা, জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করার ক্ষেত্রেও রয়েছে ঈর্ষণীয় সাফল্য। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের এসব সাফল্যের স্বীকৃতিও দিয়েছে।

গার্মেন্টস শিল্পে আমাদের শ্রমিকদের নিষ্ঠা, দক্ষতা ও তুলনামূলক কম পারিশ্রমিকের কারণে বিশ্বখ্যাত কনসালটিং প্রতিষ্ঠান ম্যাকেন্সি বাংলাদেশকে অ্যাপারেল আউটসোর্সিং-এর জন্য 'নেক্সট হট স্পট' হিসেবে অভিহিত করেছে। ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক গার্ডিয়ানের একটি প্রতিবেদনে অর্থনীতিবিদরা ভবিষ্যদ্ববাণী করেছেন যে, ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের অর্থনীতি পশ্চিমা দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাবে।

তবে এ ধরনের আশাজাগানিয়া খবর নিয়ে আত্নতুষ্টিতে ভোগার অবকাশ নেই। বরং ইতিবাচক খবর পুঁজি করে 'বাংলাদেশ'কে রিব্র্যান্ডিং করতে হবে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী ভিশনের আলোকে ব্র্যান্ডিং-কৌশল ঠিক করতে হবে এবং এসব কৌশল বাস্তবায়নে ফলো-থ্রু করতে হবে। তাহলেই সাফল্য আসবে।