কেউ নির্দলীয় নিরপেক্ষ হতে পারে না

সালাহউদ্দীন আহমদ
Published : 10 Jan 2013, 09:12 AM
Updated : 10 Jan 2013, 09:12 AM

দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্বাভাস যারা দিচ্ছেন তাদের অনেকেই বলছেন, ২০১৩ সালটি সংঘাতময় হয়ে উঠবে। দুদলের রশি-টানাটানিতে বিপর্যস্ত হবে জনজীবন। বছরের প্রথম সপ্তাহে একটি হরতালও হয়ে গেছে। এটি ডেকেছিল বিএনপি। আগামীতে আরও হরতাল বা বিক্ষোভ-সংঘর্ষে দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে বলা সত্যিই মুশকিল।

রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়ার জন্য আমি অবশ্যই বিএনপিকে দায়ী করব। কারণ এ মুহুর্তে যেটা হওয়ার কথা ছিল, দুটি দল ঘর গোছাবে, দল বা সংগঠনগুলোকে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করবে সেটাই তো স্বাভাবিক। নির্বাচনের বছরে পুরো গণতান্ত্রিক বিশ্বে এভাবেই সবকিছু চলে। অথচ আমাদের দেশে এখন কী হচ্ছে? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো অগণতান্ত্রিক একটি দাবি নিয়ে বিএনপি দেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে।

বিএনপি বলছে, তারা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। তাদের কথা হল- ফর্মূলা একটাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার। আমি মনে করি, বিএনপির এ দাবির পেছনে কোনো যৌক্তিকতা নেই। আমার এ বক্তব্যের কারণ, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অস্তিত্বের অনুপস্থিতি। তাই বিশ্বের কোনো দেশে এটা নেই। একটি অস্বাভাবিক অবস্থায় এই অস্বাভাবিক সরকার তৈরি করা হয়েছিল। তাই বলে এখন স্বাভাবিক অবস্থায় এটা কেন চালু রাখতে হবে?

কয়েকটি কারণে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ ধরনের সরকার ব্যবস্থা চালু করা যায় না। প্রথমত, এ ব্যবস্থার পেছনে রয়েছে একটি ধারণা- সরকারটি হবে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ। বিএনপিকে যদি বলা হয় 'নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার' বিষয়টি কী তা ব্যাখ্যা করতে, ওরা পারবে না। কারণ সত্যিকারের নির্দলীয় কেউ হতে পারেন না। প্রত্যেক ব্যক্তিরই নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকে। রাজনীতি সবাই করেন না, তাই বলে মতাদর্শ থাকবে না এমন তো হয় না। ফলে কেউই আসলে নির্দলীয় বা নিরপেক্ষ থাকেন না।

দ্বিতীয়ত, একটি সংসদীয় গণতন্ত্রে সরকার নির্বাচন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এখানে অরাজনৈতিক সরকার বলে কিছু থাকতে পারে না।

তৃতীয়ত, কোনো গণতান্ত্রিক দেশে অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে কোনো সরকার নির্বাচিত হতে ও প্রশাসন চালাতে পারে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা একটি অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তাই গণতন্ত্রে এর গ্রহণযোগ্যতা নেই।

চতুর্থত, আমাদের দেশের আইন ও সংবিধান দ্বারা এ ব্যবস্থা এখন আর স্বীকৃত নয়। সে কারণেও এ ব্যবস্থার দাবি তোলা অযৌক্তিক।

পঞ্চমত, অনেকে বলছেন যে, গণভোটের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বৈধতা যাচাই করতে। আমি এর কোনো প্রয়োজনীয়তা দেখি না। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের জরুরি ইস্যুগুলো নিয়েই শুধু গণভোট হতে পারে, কোনো অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পক্ষে-বিপক্ষে ভোটের উদাহরণ বিশ্বে নেই।

বিএনপির মতো একটি রাজনৈতিক দল আজ জেদের বশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলছে বলেই সেটা মেনে নিতে হবে এমন কোনো কথা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই সুস্পষ্টভাবেই বলেছেন যে, অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো আওয়ামী লীগের সরকারের অধীনেই বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে।

আমার প্রশ্ন হল, বিএনপি দলটি কীসের জোরে এসব বলছে? গত নির্বাচনে জনগণ ওদের প্রত্যাখ্যান করেছে। খুব অল্পসংখ্যক আসন নিয়ে ওরা সংসদে এসেছে। এখন সরকারের একটি মাইনর অংশ মেজর অংশের ওপর জোর করে একটি দাবি চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। তারা জ্বালাও-পোড়াও আর ধ্বংসাত্মক কাজকর্ম করে এ দাবি আদায় করতে চাচ্ছে। দেশকে নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিতে চাচ্ছে। তারা উদাহরণ দিক বিশ্বের কোন দেশে এ ধরনের ব্যবস্থা আছে।

একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ একটি ব্যবস্থা হিসেবে চালু হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে কেন টিকিয়ে রাখতে হবে এটাই আমার ভাবতে অবাক লাগে। গণতন্ত্রকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে হলে আমাদের দলীয় সরকারে অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচনের অভিজ্ঞতা নিতে হবে, চিরকাল 'অস্বাভাবিক' ব্যবস্থার মধ্যে থাকা ঠিক হবে না।

আমি মনে করি যেটি করা জরুরি তা হল, নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করে তোলা। এ ব্যাপারে আমাদের পাশের দেশ ভারত চমৎকারভাবে সফল হয়েছে। সেখানে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা হয়েছে, পরিপূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। ফলে সেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ হয়েছে।

আমাদের কাছেই এতবড় একটি উদাহরণ রয়েছে, আমরা এটি অনুসরণ করছি না কেন? ভারতে কীভাবে এ কাজ করা হয়েছে তো দেখে আমরাও একইভাবে কমিশনকে শক্তিশালী করার পদক্ষেপ নিতে পারি। এ ব্যাপারে সবাই মিলে আলোচনা করে কীভাবে এগুতে হবে তা নিয়ে ভাবাটা এখন জরুরি।

এ পরিস্থিতিতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার কী করতে পারে তা নিয়ে বলছি। সরকারের প্রথম কাজ হবে জনমত গঠন করে তথাকথিত নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থা সম্পর্কে ভুল ধারণাটি দূর করা। এ ব্যাপারে জনগণকে তাদেরই সচেতন করতে হবে। আস্থায় নিতে হবে। তাহলে বিএনপির মতো রাজনৈতিক দলের অগণতান্ত্রিক দাবির গ্রহণযোগ্যতা তৈরির সুযোগই থাকবে না।

দ্বিতীয়ত, নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা যায় কীভাবে এ নিয়ে সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে। এ কমিশন সম্পূর্ণ স্বাধীন এ ঘোষণা সরকারকেই দিতে হবে।। জনগণের মনে কমিশন সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে হবে। শুধু বর্তমানে নয়, ভবিষ্যতেও যাতে কোনো সরকার কমিশনের কাজে হস্তক্ষেপ করতে না পারে সেজন্য কমিশনকে উপযুক্তভাবে গড়ে তুলতে হবে।

তৃতীয়ত, নিজেদের সমম্যাগুলো খুঁজে বের করতে হবে। দলের যে অংশ বা সদস্যদের কাজকর্ম গণবিরোধী হবে সেসব ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। এখনও যেমন ছাত্রলীগের নামে যেসব সন্ত্রাসী কাজকর্ম হচ্ছে সে সম্পর্কে সরকারের সুস্পষ্ট চিন্তাভাবনা থাকা দরকার। সরকার ঘোষণা দিক না যে এ ছাত্রলীগের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। তাহলে জনগণের মনে আস্থা তৈরি হবে।

চতুর্থত, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকাজটি দ্রুততার সঙ্গে শেষ করা দরকার। জনগণ এর বিচার চায় এতে কোনো সন্দেহ নেই। একে ফেলে রাখলে চলবে না। কারণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ক্ষমতার পালাবদল হয়ই। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলে তো নিঃসন্দেহে এ বিচার হতে দেবে না। তাই আওয়ামী লীগ সরকারের এ কাজ শেষ করে যাওয়া উচিত।

পঞ্চমত, দুর্নীতির ঘটনাগুলোর আরও যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার। এ ব্যাপারে সরকারকে 'জিরো টলারেন্স' দেখাতে হবে। তার মানে, অপরাধীদের কোনোরকম ছাড় না দেওয়া। এটা হলে জনগণের আস্থা হারানোর ভয় থাকবে না।

সবশেষে বলব, গত চার বছরে সরকারের সাফল্য অনেক। কিছু ব্যর্থতা তো অবশ্যই আছে। এরই মাঝে আমাদের অর্থনীতি বিরাট শক্তিশালী হয়ে উঠতে যাচ্ছে। ভিনদেশি কাগজগুলো এ প্রসঙ্গে আমাদের প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, এখানে আত্মতুষ্টির কোনো সুযোগ নেই। সাফল্য আসবে। সাফল্যের সম্ভাবনায়, প্রাপ্তিতে উদ্বেলতা থাকবে। কিন্তু আমাদের দেশটির সম্ভাবনা যে আরও বেশি। তাই সবসময় সজাগ-সতর্ক থেকে, গণতন্ত্রকে সমুন্নত রেখে এগিয়ে যেতে হবে। রাজনৈতিক হানাহানি যেন কোনোভাবেই দেশকে পিছিয়ে না দেয়।

সালাউদ্দীন আহমদ: জাতীয় অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক।