সীমান্তে হত্যা, ভারতের আশ্বাস ও বন্ধুত্ব

আকমল হোসেন
Published : 15 June 2016, 04:14 AM
Updated : 8 Jan 2013, 01:37 PM

কিশোরী ফেলানীর লাশ অনেক দিন ধরে সীমান্তে স্থাপিত কাঁটাতারের বেড়ার উপর পড়ে ছিল। পড়ে থেকে মৃত ফেলানী শুধু মানবিকতাবোধের অন্ত:সার শূণ্যতার দিকটি তুলে ধরেনি- সেই সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছিল। তার দোষ ছিল সে অবৈধ পথে নিজ দেশে ফিরে আসার জন্য কাঁটাতারের বেড়া পার হওয়ার চেষ্টা করছিল। প্রতিবেশি ভারত রাষ্ট্রের জন্য সে কোনো হুমকি ছিল বলে কি ধরা যাবে ? মাঝেমধ্যে গরু নিয়ে অভিন্ন সীমান্ত পার হতে গিয়ে যেসব তরুণ বাংলাদেশি রাখাল মারা পড়ছে বিএসএফ-এর গুলিতে, তারাই-বা ভারতের জন্য হুমকি কীভাবে।

তবে তাদের এভাবে যাতায়াত বৈধ নয় এটা ঠিক। কিন্তু কাঁটাতারের বেড়াসংলগ্ন নিজ কৃষিক্ষেতে কাজ করতে গিয়ে যারা মারা পড়ছে তাদের কী অপরাধ ? মাঝেমধ্যে সীমান্ত পার হয়ে যখন কোনো বিএসএফ জওয়ান মত্ত অবস্থায় গুলি করে গ্রামের মানুষ মেরে ফেলে তখন মৃত মানুষগুলোর কী অপরাধ থাকে? তাদের সবার নিয়তি কি তাহলে বলতে হবে এক নির্দয় প্রতিবেশির সীমান্তরক্ষীদের নিশানায় পরিণত হওয়া?

অনাকাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশিদের ঠেকাতে ভারত আশির দশকে দু'দেশের অভিন্ন সীমান্ত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঢেকে দেওয়ার পরিকল্পনা করে এবং ধীরে ধীরে তা বাস্তবায়ন করছে এখন। ৪ হাজার কিলোমিটারের বেশি অভিন্ন সীমান্তের সব জায়গায় বেড়া দেওয়া সম্ভব না হলেও বাংলাদেশের উত্তর ও পশ্চিম সীমান্তে কাজটি শেষ হয়েছে। সব সীমান্তে হত্যার ঘটনা ঘটে না। বরং সীমান্তের কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে ঘটনাগুলো ঘটছে। রাজশাহী, দিনাজপুর, লালমনিরহাঁট জেলা থেকে হত্যার খবর বেশি আসে।

এ বছরের শুরুতে দুই দিনে চার জন হত্যা ছাড়াও দুজনকে অপহরণ এবং একজনকে আটকের খবর পাওয়া গেছে ( সূত্র: আইন ও সালিশ কেন্দ্রের বিবৃতি )।

দেখার বিষয় যে, গরু পারাপার করতে গিয়েই বেশি লোক খুন হচ্ছে। সীমান্তে বিএসএফ-এর হত্যার এ মিশন বছরের পর বছর ধরে চললেও এর শুরু বেশিদিনের ব্যাপার নয়। যখন ভারত কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে যাতায়াতের বিষয়টি জটিল করে দিল তখন থেকে এর সূত্রপাত। ভারত থেকে কী বাংলাদেশে আগে গরুর চালান আসত না? নিশ্চয়ই আসত তখনও অবৈধভাবে গরু আনা হত, বিশেষ করে কোরবানির ঈদ উপলক্ষ করে হাঁটের গরুর এক বড় অংশ ভারত থেকে আসত। তবু তখন সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা শোনা যেত না।

'৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পরও বেশ কয়েক বছর সীমান্ত অবাধ ছিল। পাসপোর্ট-ভিসার প্রচলন হওয়ার পরও কোনোক্রমেই ভিসা নিয়ে ভারতে যাওয়া যাত্রীর সংখ্যা ভিসাহীন যাত্রীর চেয়ে বেশি ছিল না। অভিন্ন সীমান্তের দু'পাশের পরিবারগুলো বিভক্ত হয়েছিল র‌্যাডক্লিফের কলমের খোঁচায়। তাদের অপর পারের নিকট আত্মীয়কে দেখতে যাওয়া বা কৃষিক্ষেতে চাষ দিতে ভিসার অপেক্ষায় থাকতে হত না।

আর চোরাচালান তো ভৌগলিক বিভক্তির কারণে শুরু হয়েছে। দু'দেশের চোরাচালানীদের তালিকায় যখন যে পণ্য লাভজনক ছিল তা স্থান পেয়েছে। এখন যেমন গরু, ফেনসিডিল তালিকার উপরদিকে স্থান পেয়েছে। গরু আনতে গিয়ে লোকজন নিহত হলেও ফেনসিডিল আনতে গিয়ে কেউ হত্যা তো দূরের কথা কোনো বাধার সম্মুখিন হচ্ছে না। কেন?

গরু ধর্মীয় অুনভুতির দিক দিয়ে স্পর্শকাতর বলে কি তা আনতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, নাকি এর সঙ্গে সীমান্তরক্ষীদের পাওনার কোনো ব্যাপার আছে ? যারা গরু-পারাপার করে তাদের তো ভারতীয় প্রতিপক্ষ আছে যাদের যোগসাজশে অবৈধ পারাপারটি হয়ে থাকে। বস্তুত ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা বাংলাদেশিদের টাকার বিনিময়ে পারাপার করতে দেয়। শুধু সঠিক বখরা না পেলে গুলি চালিয়ে থাকে। তা না হলে প্রতিদিন এরকম অসংখ্য হত্যাকাণ্ড হবে কেন।

ভারতের দিক থেকে হত্যার পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে বলা হয় যে গরু পাচারকারীদের দ্বারা আক্রান্ত হলেই সীমান্তরক্ষীরা গুলি চালিয়ে থাকে। হতে পারে এ ব্যাখ্যায় খানিকটা সত্য আছে, কিন্তু কতজন এভাবে মারা পড়ছে এবং কতজন শুধু দেখামাত্র গুলির শিকার হচ্ছে তা বোঝা যায় কীভাবে ? তাছাড়া আক্রান্ত হওয়া মাত্রই রাইফেলের গুলি দিয়ে পাল্টা জবাব দিতে হবে কেন ? ভারতের প্রতি বৈরি-সন্ত্রাসী কোনো ব্যক্তি তো সীমান্ত পার হতে গিয়ে মারা পড়ছে না। মারা পড়ছে দরিদ্র মানুষ, যারা পেটের দায়ে এ রকম ঝুঁকির কাজ করছে। এমনকি সীমান্তরক্ষীদের দ্বারা নির্যাতিত হওয়ার পরও আবার ঝুঁকি নিতে পিছিয়ে যায় না এমন মানুষও আছে।

সীমান্তে হত্যার বিষয়টি ভারতের সরকারি মহলে কীভাবে দেখে সেটা বোঝা যায় গত সেপ্টেম্বরে দুদেশের সীমান্তরক্ষীদের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে বিএসএফ প্রধানের বক্তব্য থেকে। তিনি সেখানে বলেছেন, 'সীমান্তে অনুপ্রবেশকারীরা হত্যার শিকার হয় না বরং তাদের মৃত্যু হয়।' শুনে মনে হতে পারে যে এসব মৃত্যু খুব স্বাভাবিক কারণে হয়ে থাকে ! যেন তিনি হত্যা ও মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে অক্ষম!

ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের উন্মত্ত আচরণ থামানোর বিষয়ে ভারত বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, এ জাতীয় হত্যাকাণ্ড শূণ্যের ঘরে নিয়ে আসার ব্যাপারে কথা বলেছে। সাধারণত দুদেশের সীমান্তরক্ষী প্রধানদের সম্মেলনে এসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। গুলি না করে কীভাবে অনুপ্রবেশকারীকে ঠেকানো যায় তা নিয়েও বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা শোনা গেছে। কিন্তু ঘোষণা শুধু ঘোষণায় আটকে গেছে, কখনও বাস্তব রূপ লাভ করেনি। ভারতের রাজনৈতিক পর্যায় আমলা-প্রভাবিত হওয়ায় তাদের পক্ষে হত্যা বন্ধ করা সম্ভব হয় না। সম্পূর্ণ বিষয়টি নিছক সীমান্ত অলঙ্ঘনীয়তার বিচারে দেখা হয়, এতে কোনো মানবিকতার ছোঁয়া থাকে না।

বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের বন্ধুত্বকে অনেক মূল্য দিয়ে থাকে। তাই ভারতের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, যেমন উলফা বিদ্রোহী নেতাদের ভারতের কাছে তুলে দেওয়া এবং বাংলাদেশের স্থলভূমি দিয়ে সাময়িক ট্রানজিট প্রদান করতে এ সরকার কুণ্ঠা দেখায়নি। দুদেশের প্রধানমন্ত্রীর সফরকে সম্পর্কোন্নয়নের বেলায় বড় সাফল্য হিসাবে দেখা হয়েছে। কিন্তু ভারতের তরফ থেকে বাংলাদেশের স্বার্থ কতদূর রক্ষা করা হয়েছে তা প্রশ্ন হতে পারে। এবং এ প্রশ্ন খোদ সরকারের নীতিনির্ধারক তথা সর্বোচ্চ পর্যায়ে তোলা হয়েছে। গত বছরের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ত্রিপুরা রাজ্য সফরকালে ভারতীয় নেতাদের কাছে তাঁর হতাশা প্রকাশ করেছিলেন বলে জানা গিয়েছিল।

কিন্তু তাঁর হতাশা কী তাঁর সরকারের গৃহীত কোনো পদক্ষেপ দিয়ে দূর করার চেষ্টা হয়েছে ? বিষয়টিকে বাংলাদেশ কি কোনো জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে মোকাবেলা করেছে ? ফেলানীর লাশ তারের বেড়ার উপর ঝুঁলছিল কিন্তু এ ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেছে দেরিতে। সরকারের মন্ত্রীরা যখন 'এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে, আগামীতেও ঘটবে,' 'ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা বৈধভাবে গুলি চালিয়েছে কিনা দেখতে হবে ' জাতীয় মন্তব্য করেন- তখন মনে হয় তারা এদেশের মন্ত্রী নন, ভারতের মন্ত্রী! এবং তাদের কথাবার্তায় বাংলাদেশীদের 'অবৈধ প্রবেশ' বিষয়টির গুরুত্বই বেশি বোঝা যায়। যা ভারতের পক্ষ থেকেও সবসময় করা হয়ে থাকে।

ভারতের কাছে থেকে নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা ও বাণিজ্যিক সুবিধা পাওয়া বাংলাদেশের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। এটা পূরণ না হওয়ায় এ দেশের মানুষ হতাশ ও ক্ষুব্ধ। কিন্তু সীমান্তে হত্যার ঘটনা যখন ঘটে, কোনো বাংলাদেশিকে অপহরণ বা নির্যাতন করা হয়- তা মানুষের ক্ষোভ বাড়িয়ে দেয়। এমন কোনো ঘটনায় কোনো ভারতীয় সীমান্তরক্ষী শাস্তি পেয়েছে বলে তথ্য নেই। ভারতের ব্যাপারে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হয় না যখন বাংলাদেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে ভারতের কোনো সরকারি পদক্ষেপ দেখতে না পায়। দুদেশের বন্ধুত্ব তাহলে কি একতরফা ব্যবস্থা গ্রহণের উপর নির্ভর করতে পারে ?
৭/১/১৩

আকমল হোসেন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক।