খেলছে ওরা, কাঁপছি আমরা

Published : 19 June 2010, 11:43 AM
Updated : 19 June 2010, 11:43 AM

একসময় পুরো ইউরোপ জুড়ে যে রক্তক্ষয়ী জাতিগত দাঙ্গা ও ধর্মযুদ্ধের বিভীষিকা চলেছে, তা থেকে ইউরোপবাসী আজ মুক্ত হলেও তাদের ভিতরে পারস্পরিক অবিশ্বাস, ঘৃণা ও বিদ্বেষ সূক্ষ্মভাবে রয়ে গেছে। তাই যখন দুটো দেশের ফুটবল দল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মাঠে নামে, সে মাঠ হয়ে যায় যুদ্ধের প্রতীকী ময়দান; খেলায় জয়-পরাজয় যুদ্ধে জয়-পরাজয়ের মতই তীব্র জাতীয়তাবাদী আবেগের সাথে একীভূত হয়ে যায়। সাদা মানুষদের মননের গভীরে, রক্তস্রোতে, জিনের ঘোরানো সিঁড়িতে, স্নায়ুর কোষে কোষে যে নিগূঢ় বর্ণবাদ আজো খেলা করে এবং যা নির্মূল প্রায় অসম্ভব, তা তীব্রভাবে প্রকাশিত হয় কালোদের সাথে খেলায়।

তাদের ঐ 'সুপিরিয়রিটি কমপ্লেক্স' এখনো ভালভাবেই বজায় রয়েছে, কেননা আফ্রিকা বা এশিয়ার কোনো দেশ এখনো বিশ্বকাপ জেতা দূরে থাক, এর ফাইনালেও খেলতে পারে নি। তবে এও সত্যি সাদা দলগুলোতে অনেক বর্ণের খেলোয়াড় দেখা যায় । ক্লাবগুলো নিয়ে এখন যে মাতামাতি তা অতীতের অঞ্চল নিয়ে বিরোধের ছায়ামাত্র। আর রয়েছে আত্মপরিচয়ের সংকটগত গূঢ়তর প্রেষণা, যা একক মানুষকে দলগত চিহ্নায়নে সাহায্য করে এবং অবিরত অনিরাপত্তায় ভোগা ব্যক্তি-মানুষকে সমষ্টিগত নিরাপত্তার মানসিক বর্ম এনে দেয়।

ফুটবল ভক্তরা যে অতীতে পেলে বা ম্যারাডোনা আর বর্তমানে মেসি বা রোনালদোকে নিয়ে অমন মেতে ওঠে তার একটি বড় কারণ সাধারণ মানুষ মঞ্চে বা মাঠে নায়ক দেখতে চায়, আর চায় উত্তেজনা। দৈনন্দিনতার চাপে পিষ্ট কোটি জনতার জীবনে তেমন কোনো উত্তেজনা নেই, ফুটবল সেই উত্তেজনা এনে দেয়। ফুটবলের নায়করা তাই করে দেখায়, যা তাদের অসাধ্য। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে সাথে, বিশেষ করে ইউরোপে, মানুষের মাঝে ধর্মীয় বিশ্বাস শিথিল হতে থাকে। অন্যদিকে, প্রবল রাজনৈতিক আদর্শিক সম্পৃক্ততা থেকে সরে আসে ইউরোপের অর্থনৈতিকভাবে স্বচ্ছল জনগোষ্ঠি; আর এশিয়ায় বারংবার রাজনৈতিক নেতৃত্বের দ্বারা প্রতারিত মানুষেরা আস্থা হারিয়ে ফেলেন রাজনৈতিক নেতৃত্বে। ফলে তাদের জীবনে নায়কের সঙ্কট দেখা দেয়। ফুটবলের নায়করা কিছুটা হলেও সে স্থান পূরণ করেন।

সত্তর দশকে বাংলাদেশের প্রধান সাপ্তাহিক ছিল বিচিত্রা, আর মনে আছে সেখানে খোন্দকার আলী আশরাফ 'দুর্জন উবাচ' শিরোনামে একটি কলাম প্রায় নিয়মিত লিখতেন। তাঁর ছিল অসামান্য রসবোধ, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের নানাবিধ অসঙ্গতি তিনি ফুটিয়ে তুলতেন দারুণ রসিকতায়। একটি লেখা ছিল বিশ্বকাপ নিয়ে। যেখানে তিনি ভবিষ্যতের এক স্বপ্ন বা বিভ্রম ফুটিয়ে তোলেন এভাবে যে, ২০১০ সালের বিশ্বকাপের ফাইনালে প্রবল পরাক্রমশালী জার্মানীর মুখোমুখি ফুটবল বিশ্বে নবাগত, ক্ষুদ্র দেশ বাংলাদেশ। খেলা শুরু হতেই বাংলাদেশ ঝাঁপিয়ে পড়ল জার্মানীর গোলমুখে আর প্রথমার্ধেই তিন গোলে এগিয়ে গেল।

গোটা দুনিয়া হতবাক আর পুরো স্টেডিয়াম স্তব্ধ, কেননা খেলা হচ্ছিল জার্মানীতেই। লেখকের পাশেই বসেছিলেন জার্মানীর এক ডাকসাইটে সাংবাদিক, তিনিও বিস্মিত। বাংলাদেশের ফুটবল সাফল্যের অভাবনীয় রূপকথার রহস্য জানতে চাইলেন সাগ্রহে। তখন যে ব্যাখ্যাটি সাংবাদিকরূপী লেখক দেন তা যেমন হাস্যরসাত্বক তেমনি বেদনাদায়ক। তিনি জানালেন স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে অন্যান্য সবকিছুর মতই ফুটবল সামগ্রীর দাম চড়তে থাকে, চড়তে চড়তে তা এমন চূড়ায় চলে যায় যে বাংলাদেশের সাধারন মানুষেরা কোনোভাবেই চামড়ানির্মিত ফুটবল কিনে খেলতে পারে না। তখন তারা বিকল্প হিসেবে বেছে নেন বাতাবী লেবু, যাকে অনেকেই জাম্বুরা বলে থাকেন। লেখকের ব্যাখ্যা হল, যারা জাম্বুরার মত একটি ভারি জিনিসকে সহজেই ট্যাকল করতে পারেন তাদের কাছে চামড়ার ফুটবল তো নস্যি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিই যে ফুটবল নৈপুণ্যের উর্ধ্বগতির মূল কারণ–সেটাই তিনি ব্যাখ্যা করলেন ঐ জমজমাট কল্পিত ফুটবল কাহিনীর মধ্য দিয়ে।

"
নিজের দেশের অপারগতার বেদনা অথচ হৃদয়ে অটুট ফুটবলপ্রেম এখন তারা ঢেলে দিচ্ছে ভিনদেশী দলের প্রতি। তারা যে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলকে সমর্থন দেয় তা নিখাঁদ ফুটবলপ্রেম থেকেই দেয়, এখানে কোনো জাগতিক হিসেব-নিকেষ বা লেনদেন নেই, কেননা সুদূর লাতিন আমেরিকার ঐ দুটো দেশের সাথে বাংলাদেশের তেমন কোনো রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন নেই।

"

উপরের ঐ গল্পে যে কাহিনী ফুটে উঠেছে তা হল, শারীরিক অপুষ্টির শিকার একটি জনগোষ্ঠির পক্ষে ফুটবলের মত একটি শারীরিক দক্ষতা ও নৈপুণ্যের খেলায় যেমন বিশ্বমান অর্জন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় আকাশছোঁয়া দামের ক্রীড়াসামগ্রী জোগাড় করে বাংলাদেশের বেশিরভাগ তরুণ-যুবার পক্ষে ফুটবল খেলাও। ফুটবলে ভাল ফলাফল করতে হলে যেমন একটি শক্তিশালী জাতীয় কাঠামো প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন সারা দেশে ফুটবল ছড়িয়ে দেয়া, রাষ্ট্রীয় অনুদান ছাড়া যা অসম্ভব। শহরে ফুটবল খেলার মাঠগুলো অনেক আগেই চলে গেছে ভূমিদস্যুদের দখলে, গ্রামে নেই পর্যাপ্ত উপকরণসামগ্রী। ফুটবলকে হটিয়ে ক্রিকেটের জনপ্রিয় হয়ে ওঠার আরেকটি কারণ হতে পারে, ফুটবল খেলতে একটি মাঠের প্রয়োজন হয়, সীমিত পরিসরে হলেও; ক্রিকেট কিন্তু একটি গলির ভেতরেই খেলা যায়। মাঠগুলোকে গলি বানিয়ে ফেলা রাজধানীতে শিশু-কিশোরদের খেলার মাঠগুলো অনেক আগেই লুট হয়ে গেছে, বাড়ির ছাদ আর অলি-গলি ছাড়া তাদের আর কোনো বিকল্প নেই।

নিজের দেশের অপারগতার বেদনা অথচ হৃদয়ে অটুট ফুটবলপ্রেম এখন তারা ঢেলে দিচ্ছে ভিনদেশী দলের প্রতি। তারা যে আর্জেন্টিনা বা ব্রাজিলকে সমর্থন দেয় তা নিখাঁদ ফুটবলপ্রেম থেকেই দেয়, এখানে কোনো জাগতিক হিসেব-নিকেষ বা লেনদেন নেই, কেননা সুদূর লাতিন আমেরিকার ঐ দুটো দেশের সাথে বাংলাদেশের তেমন কোনো রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বন্ধন নেই। এর প্রমাণ ঢাকায় ব্রাজিল বা আর্জেন্টিনার কোনো দূতাবাস নেই। গোটা দুনিয়াই এই একটি মাস মেতে থাকবে ফুটবল নিয়ে, বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমী মানুষেরা তাদের উল্লসিত সহযাত্রী মাত্র।