পুলিশপুত্র সৃজন: সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যম

পলাশ দত্ত
Published : 3 Jan 2013, 01:59 PM
Updated : 3 Jan 2013, 01:59 PM

সোশ্যাল মিডিয়াকে পুঁজি করে বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে গেলো গতবছর। এক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীর ফেইসবুক প্রোফাইলে কোরআন অবমাননার ছবি শেয়ার হয়েছে- এই ধোয়া তুলে কক্সবাজারে বৌদ্ধবসতি ও বিহারে নজিরবিহীন হামলা চালায় একদল ধর্মোন্মাদ। ২০১২ সালের নভেম্বর মাসে এই ঘটনাটি ঘটে। এছাড়াও দুয়েকটি ছোটোখাটো ঘটনা ঘটে ফেইসবুককে কেন্দ্র করে। প্রয়াত লেখক হুমায়ূন আহমেদের স্ত্রীকে হুমকির অভিযোগে এক চিকিত্সককে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রধানমন্ত্রীকে কথিত হুমকির দায়ে গ্রেপ্তার করা হয় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে। পরে অবশ্য আদালতের নির্দেশে ছেড়েও দেয়া হয় ওই শিক্ষককে।

শেষের দুটি নেতিবাচক ঘটনা গণমাধ্যমে কমবেশি এসেছে। তবে বছরের একেবারে শেষ দিকে, ডিসেম্বর মাসে এসে সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্লেখযোগ্য একটি ইতিবাচক ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটির কেন্দ্রে রয়েছে একটি কিশোরীকে এক কিশোরের চড় মারা। এই ঘটনার একটি ভিডিও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। ইরফান নামে এক ফেইসবুক ব্যবহারকারী ভিডিওটি শেয়ার করে অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। যার ফলশ্রুতিতে একটি ব্লগীয় উদ্যোগের মাধ্যমে ওই চড়-মারা-কিশোরটির পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার ওই অর্জন কিংবা ভিডিওটি এখনো প্রথাগত গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি।

ইরফান তার ফেইসবুক নোটে ভিডিওটির বিষয়বস্তু সম্পর্কে বলেন: "এক ছেলে এক মেয়েকে হাতে ফুল নিয়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছে। তার চোখে কিশোরী সুলভ চঞ্চলতা দেখা দেয়। খানিকটা লজ্জাও ধরা পড়ে তাতে। ছেলেটি কিছুক্ষণ আই আই করে শেষে মেয়েটির গালে সজোরে চড় মারলো এবং বলল, আই স্লাপ ইউ (I Slap You)! এরপর মেয়েটি চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। আশেপাশে ছেলেটির আরো বন্ধুবান্ধবের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় ভিডিওর শব্দ থেকে। মেয়েটির তাত্ক্ষণিক মানসিক অবস্থা শুধু আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু আসলে তার কতটুকু খারাপ লেগেছিল তা সে ছাড়া আর কারো পক্ষে জানা সম্ভব নয়। ঘটনাটি ঘটে কোনও ক্লাস রুমে অথবা কোচিং সেন্টারে। কারণ ভিডিওতে পিছনে শিক্ষকদের লেখার বোর্ড দেখা যায়।"
২.
এর পরই ঘটে দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘটনাটি যা বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়ার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একটি ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে ইতিহাসে। ফেইসবুকের ওই পোস্টটি দেখে ব্লগার সুশান্ত আমারব্লগে একটি পোস্ট লেখেন। পোস্টে তিনি ছেলেটির পরিচয় জানার জন্য সবার সহযোগিতা কামনা করেন।
পোস্ট দেয়ার একদিনের মধ্যেই ওই ঘটনা ঘটানো ছেলেটির পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়। জানা যায়, ঘটনাটি ঘটেছিলো ২০১০ সালে। সিরাজগঞ্জে। আর চড় মেরেছিলো যে কিশোরটি তার নাম "সৃজন আহমেদ"। সুশান্ত বলছেন, ছেলেটি ওই ঘটনার কথা স্বীকার করেছেন। সৃজনের উদ্ধৃতি দিয়ে ওই ব্লগার বলেছেন, ২০১০ সালের অক্টোবরে সিরাজগঞ্জের জুয়েলস অক্সফোর্ড ইন্টার ন্যাশনাল স্কুলে এ ঘটনা ঘটেছিলো। ছেলেটি বর্তমানে অ্যাকাডেমিয়া স্কুলে পড়ছেন বলেও জানা যাচ্ছে ওই ব্লগপোস্ট থেকে। তার বাবা মো. আবুল কালাম আজাদ বর্তমানে বগুড়ার ধুনট থানায় ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসাবে আছেন।

২০১০ এর সেই ঘটনা মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে শিবলী শিপু নামে আরেক কিশোর। আর সৃজন সেটি ওই বছরের অক্টোবরেই ইউটিউবে আপলোড করেন। সম্প্রতি মাসুদ রানা নামের একজন ভিডিও ক্লিপটি ফেইসবুকে আপলোড করলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে। অনেকেই এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে ক্লিপটি শেয়ার করছেন। বাংলাদেশের সাংবাদিকদের একটি বড় অংশই সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়। তাদের অনেকেই এই ভিডিওটি দেখেছেন। তারা নিজে উদ্যোগ না নিলেও একটি ব্লগীয় উদ্যোগের মাধ্যমে ঘটনাটিতে জড়িত কিশোরগুলোকে চিহ্নিত করা গেছে।

৩.
গতবছরের মে মাসের শুরুর দিকে আরেকটি দুর্ঘটনা ঘটেছিলো যার প্রতিকার এনেছিলো সোশ্যাল মিডিয়াই। ওই ঘটনায় অভিযোগ উঠেছিলো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল আর্টসের কিছু শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। সেসময় একটি তরুণীকে উত্যক্তের প্রতিবাদ করায় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা প্রতিবাদকারীকে লাঞ্ছিত করে বলে অভিযোগ ওঠে। এর প্রতিক্রিয়ায় ছেলেটি একটি সামহোয়ারইনব্লগে একটি পোস্ট লেখেন ঘটনার রাতেই। পরবর্তীতে ঘটনাটি ফেইসবুকেও ব্যাপক প্রচার পায়।

এক পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য দিতে বাধ্য হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় ওঠা অভিযোগ নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠান! বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত বিষয়টি বিস্ময়করই বটে। কিন্তু ওই বিস্ময় শুধু ওখানেই থেমে থাকেনি। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া প্রতিবাদ গড়ে ওঠা ওই ঘটনা নিয়ে দেশের সবচেয়ে বেশি প্রচারিত দৈনিক পত্রিকাও এক পর্যায়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে ব্লগকে ভিত্তি করে।

এবার কি তেমন কিছু ঘটবে? পুলিশপুত্র সৃজনের পুরুষ-কাণ্ড নিয়ে প্রথাগত গণমাধ্যম কি কোনো প্রতিবেদন প্রকাশ করবে? নাকি সৃজন সেই ইউনিভার্সিটি অব লিবারাল আর্টসের ছাত্রদের মতো 'দুর্বল' না হ্ওয়ায় বিষয়টি সোশ্যাল মিডিয়াতেই থেকে যাবে?

পলাশ দত্ত:কবি ও সাংবাদিক।