গণধর্ষণ: যে গল্পের শেষ নেই

মাসুমা বিল্লাহ
Published : 3 Jan 2013, 06:08 AM
Updated : 3 Jan 2013, 06:08 AM

মেয়েটা সভ্যতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে মরে গেল। মৃত্যুর আগে বিচার চেয়েছিল, কার বিচার চাইলো মেয়েটি ? সাহস ছিল বটে, পুরুষের বিচার চায় ! সবাই বলে তুমি নাকি মরে গিয়ে বেঁচে গেলে, যারা বেঁচে রইলো তাদের কী হবে? দামিনী তোমাকে বলছি, তোমার মৃত্যুর পরের একটি ঘটনা, স্থান বংলাদেশের মধুপুর, মেয়েটি তোমার চেয়েও বয়সে ছোট হবে, মাত্র স্কুলে পড়তো, হায়েনার দল তিন দিন মেয়েটাকে আটকে রেখে নির্যাতন করে ফেলে রেখে গেলো রাস্তার ধারে। এখন ছোট মেয়েটি মৃত্যুর সাথে লড়ছে। বিচারের নামে এখন প্রহসন হবে, অভিযুক্তদের অনেক মামা চাচা পাশে এসে দাঁড়াবো, কেউ কেউ আড়ালে শয়তানগুলোকে পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলবে বাঘের বাচ্চা, আবার অতি উৎসাহী সজ্জন কেউ কেউ বলবে , মেয়েটা সেরে উঠুক আমরা বিয়ে পরিয়ে দেব এদের একজনের সাথে–এই হয়, হয়ে আসছে অনেক দিন থেকে, সেই সবমেহেরের আমল থেকে বা আরও আরও অনেক আগে থেকে।

দামিনীর মৃত্যুর পর কত আলোচনাই তো হচ্ছে, একজন ফেইস বুকে লিখেছেন, ধর্ষণের সুপ্ত কামনা নাকি কমবেশি সব পুরুষের মধ্যেই থাকে। আরেকজন লিখেছেন সিনেমার কাটতির জন্য যুগে যুগে এ উপমহাদেশে যৌনতাকে উস্কে দেয়ার কারনেই নাকি ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটছে। একজন বলেছেন , আমাদের সমাজ এখনও যৌন কামনাকে নিয়ন্ত্রনের মতো করে প্রস্তুত হয়ে ওঠেনি। তিনি রেড লাইট এরিয়াগুলোকে বৈধও করতে বলেছেন। সবচেয়ে সরেস আর দামি কথা বলেছেন ভারতের বিজেপির রাজ্য বিধান সভার এক সভ্য—তিনি বিদ্যালয়গুলোতে স্কার্ট পড়া নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছেন। তার বিজ্ঞ মতে, এতে নাকি পুরুষের 'লোলুপ দৃষ্টি' থেকে মেয়েদের রক্ষা করা যাবে। আর ভারতের রাষ্ট্রপতির সুযোগ্য পুত্রধনের মন্তব্য আর না ই বা বললাম, তিনি মেয়েদের ঠোঁটে এখনও লিপস্টিকের রং খুঁজে বেড়ান। সাধু সাধু—–। তার মানে তো আপনারা আপনাদের পাশবিকতার কাছে পরাজিত, বরং গভীর জঙ্গলে চলে যান, সেটাই হবে আপনাদের মত পশুদের থাকার জন্য প্রকৃষ্ট স্থান ।

ভিন্ন একটা ঘটনা , কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া–আপনাদের নিশ্চয়ই মনে পরবে–দেখুন মিল খুঁজে পান কিনা: স্থান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, পত্রিকায় প্রকাশিত একটা ছবি, সচেতন মহল তথা দেশবাসী হতভম্ব। প্রক্টর এক ছাত্রীকে হাত উচিয়ে চড় দিতে উদ্ধত, কারন ছাত্রীটি ছিল প্রতিবাদে মুখর। নমস্য বোন তোমাকে, কারন আমাদের সমাজে খুব কম নারীই জানে প্রতিবাদ করতে।

আমি বিদেশ বিভূঁই, মনটা পরে থাকে দেশে, দেশের প্রতিটি খবর মন দিয়ে পরি। মনটা বিষন্ন হয়ে গিয়েছিল যখন আমার এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সাথে ঐ শিক্ষকের তুলনা অবচেতনেই এসে যাচ্ছিল। কিন্তু পরদিন আমার ক্ষোভ বিষন্নতাকে গ্রাস করলো ।

প্রক্টর সাহেব সাফাই করলেন, তিনি ছাত্রীটিকে চড় মারতে আলবৎ চাননি, ছবিটির নাকি ভুল ব্যাখ্যা হয়েছে। তিনি অত্যন্ত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষনতার সাথে ছাত্রীটিকে বলতে চেয়েছিলেন যে, ছাত্রীটির পোষাক ঠিক নেই , সে যেন তার পোষাক ঠিক করে। কতটা অসভ্য হলে একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাস্তার বখাটে অসভ্য বিকৃত লোকদের মত একজন প্রতিবাদমূখর ছাত্রীকে তার ওড়না ঠিক করতে বলতে পারে তা আমি ভেবে পাই না। প্রক্টর সাহেব বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা দিতে নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু তার দৃষ্টি, আচরণ এবং জবানের কাছেই কি নারী ছাত্রীটি সত্যিই নিরাপদ ছিল ?

নব্বই দশকের শেষের দিকের কথা, আমি তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যারয়ে ছাত্রী । বিশ্ববিদ্যালয়টি শহর থেকে কিছুটা দূরে বিধায় হরহামেশাই ছাত্রছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালযের বাসে করে শহরে যায়, শহর থেকে ফিরে। এমনি একদিন রাতের বাসে ছাত্রছাত্রীরা শহরে যাচ্ছে, রাস্তায় ট্রাক শ্রমিকদের সাথে ছাত্রছাত্রীদের বচ্সা এবং সেই সূত্রে বেশ কিছু অনাকাংঙ্খিত ঘটনা। খবরটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছা মাত্র ছাত্রছাত্রীরা ক্রোধে ফেটে পড়ে । মহাসড়কে ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তা চেয়ে শুরু হয় দূর্বার আন্দোলন। সেই আন্দোলনে আমরা যখন মূখর, আমার আজও মনে পড়ে, ছাত্রছাত্রীরা মশাল মিছিল করছে, তখন শেষ বিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী (গুটি কয়েক ছাত্র নামধারী অছাত্র ছাড়া ) তখন মিছিলে, শুরু হলো মূষল ধারে বৃষ্টি, একজনও মিছিল থেকে বেরিয়ে গেল না, বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমরা যখন এগিয়ে যচ্ছি প্রশাসনিক ভবনের দিকে, তখন একজন শিক্ষক ছাত্রীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, এই যে তোমরা বৃষ্টিতে ভিজে মিছিল করছো, তোমাদের দেখে তো ট্রাক শ্রমিকরা অশ্লীল কথা বলবেই, তাদের আর দোষ কি ? কতটা ইতর হতে পারে শিক্ষক নামধারী পশুরূপী একটা মানুষ।

নারীর জন্য নিরাপদ শহর, নিরাপদ ক্যাম্পাস কেন চাইতে হবে ? এই একবিংশ শতাব্দিতেও কেন চেয়ে আদায় করে নিতে হবে নারীর নিরাপত্তা ? আমি জানি না , কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐ শিক্ষকের কোন বিচার হয়েছে কি না , নাকি কে জানে তিনি হয়তোবা পুরস্কতও হতে পারেন । যে দেশে স্বঘোষিত ধর্ষক মানিকদেরকে বাঁচাতে মন্ত্রী এমপিরা মাঠে নামেন সে দেশে একটা মেয়েও কি নিরাপদ? ব্র্যাকের ঐ চিকিৎসক মেয়েটির মৃত্যু কিন্তু প্রমান করে দিয়েছে, কোন নারীই আজকে সমাজে নিরাপদ নয়, সে হোক শিক্ষিত অশিক্ষিত, সে থাকুক গৃহে বা কর্মক্ষেত্রে, রাস্তায় কি পরিবহনে।

ইউরোপের নিরাপদতম একটা শহরে থাকি। খুব ভালো করেই জানি, আমার নারী সত্ত্বা নিয়ে এখানে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই, তবুও অন্ধকার যখন ঘনিয়ে আসে বিচলিত হয়ে পরি কতক্ষণে বাসায় পৌঁছাব এই ভেবে । আমার পাশ্চাত্যের বন্ধুরা মাঝে মাঝে অবাক হয়, কখনও কখনও কিছুটা উষ্মাও প্রকাশ করে । কিন্তু কী করে বোঝাই ওদের, নারী হয়ে এই উদ্বেগ নিয়েই আমি বেড়ে উঠেছি। আমার মেয়ের কচি মনেও আমি সাবধানতার এই পাঠ নিজের অজান্তেই দিয়ে দিচ্ছি। ২০০৭-০৮ এর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতের শিফটে একটা মাষ্টার্স করতাম, প্রতিদিন রাত ৯/১০ টার দিকে আমাকে দাড়িয়ে থাকতে হতো নীলক্ষেতে বাসের অপেক্ষায়। প্রতিটা দিন ছিল নিজেকে অনাকাঙ্খিত কিছু থেকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। আমি আমার আশেপাশের প্রতিটা নারীকে দেখতাম, সবার চোখে উদ্বেগ। আমার শহরে আমি নিরাপদ না কারন আমি নারী, আমার শহরে আমি নিরাপদ না কারন শহর ভরা হায়েনার দল। তবে কি দোষটা আমার নাকি ঐ হায়েনাদের ।

অতি উৎসাহী অর্বাচীনগন, যারা অহরহ বলেন, নারীর পোষাক আষাক, চলন বলন নাকি পুরূষকে প্ররোচিত করে ধর্ষণের মত ঘটনা ঘটাতে। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, নারীর পোষাক যদি ধর্ষণে কারন হতো তবে ইউরোপে তো প্রতিদিন হাজার হাজার ধর্ষণ হওয়ার কথা । যারা হিন্দি বাংলা যৌন সুরসুরির সিনামা দেখে নিজেকে নাকি নিয়ন্ত্রন করতে পারেন না বলে দাবি করছেন, তাদেরকে ইউরোপ আমেরিকায় এনে ছেড়ে দেন না, ওরা তো একটি উলঙ্গ মেয়ের দিকেও চোখ তুলে তাকানোর সাহস পাবে না , ধর্ষণ তো দূরের কথা । তার মানে সমস্যটা কোথায়? যুগের পর যুগ পার পেয়ে পেয়ে আজকে এরা পশুর চেয়েও হিংস্র হয়ে গেছে ।

নারীর জন্য নিরাপদ একটা শহর, একটা নগর, একটা দেশ, একটা পৃথিবীর দাবীতে ভারতের রাজধানী আজকে উত্তাল। এক ভারতীয় বন্ধুর সাথে কথা হচ্ছিল এই আন্দোলন নিয়ে । তিনি বললেন ভারতের প্রচলিত আইনে ধর্ষণকারীকে বাঁচিয়ে দেয়ার অনেক ফাঁক ফোঁকর রয়ে গেছে। আন্দোলনকারীরা ধর্ষণের সর্ব্বোচ্চ শাস্তির দাবী আদায়ে সোচ্চার। বাংলাদেশেও এমন একটা প্রতিবাদ চাই। আমার চিকিৎসক সহকর্মীর মৃত্যু আমাকে বেদনায় নীল করে , কিন্তু প্রতিবাদে আমরা আজও ফেটে পড়তে পারি না কেন ? মধুপুরের ছোট বোনটা বাংলাদেশের দামিনী হয়ে উঠুক ।

সবাই সচেতন হোন। যে যেভাবে পারেন প্রতিবাদ করুন। সরকারকে বলবো আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করুন যাতে হায়েনার দল ভীত হয়। সামাজিক আন্দোলনের কোন বিকল্প নেই। মধুপুরের ধর্ষণকারীদের ছবি পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার করুন , যাতে সমাজের সবাই এদের চিনতে পারে । দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিন যাতে পরবর্তীতে এমন ঘটনা ঘটানোর আগে পশুর দল শিউরে ওঠে।

নারীর অগ্রযাত্রা মানে সভ্যতার অগ্রযাত্রা। নারীর নিরাপত্তা মানে সভ্যতার নিরাপত্তা। নারীকে ধর্ষণ মানে সভ্যতাকে ধর্ষণ।

মাসুমা বিল্লাহ্: গবেষক, এন এফ পি রিসার্চ ফেলো, ইউনিভার্সিটি অফ গ্রোনিনগেন, দি নেদারল্যান্ডস্।