করের কারেন্ট জাল: আটকা পড়বে শুধু জাটকারা

আলী আহমদ
Published : 17 June 2010, 02:51 PM
Updated : 17 June 2010, 02:51 PM

আমার পূর্বতন পেশার অত্যাবশ্যকীয় অংশ হিসেবে বাজেট নিয়ে অনেক ঘাটাঘাটি করতে হয়েছে। আর তারই অংশ হিসেবে হয় সংসদ গ্যালারিতে নতুবা টেলিভিশন সেটের সামনে বসে বিভিন্ন অর্থমন্ত্রীর মুখে শুনেছি বাজেট বক্তৃতা। কিন্তু বহু বছরের ব্যবধানে এবারই প্রথম ও দুটোর একটাও করা হয়নি; কিংবা বলা চলে করা যায় নি। তার কারণ, ঐ সময়টাতে দেশের বাইরে ছিলাম। পরে বাজেট সংক্রান্ত কাগজপত্র পড়ে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছে তারই দু'একটি নিয়ে কথা বলছি।

করারোপ রাষ্ট্রের সার্বভৌম ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং সে এখতিয়ার প্রশ্নাতীত। কিন্তু তা কেমন করে আরোপ করা হয়, আর তার ফলে নাগরিক সমাজের কার ওপর কী অভিঘাত বা আপতন হয়, তা সব সময়ই বিবেচনার দাবি রাখে, বিশেষ করে কর আরোপকারী কর্তৃপক্ষের, অর্থাৎ সরকার তথা অর্থমন্ত্রীর কাছে।

বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে এবার মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি হয়েছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে ৫.৫%, আর বাংলাদেশ সরকারের হিসাব কিংবা দাবি অনুযায়ী ৫.৭%। গত পাঁচ-ছয় বছরের মধ্যে এটি সবচেয়ে কম হলেও সার্বিক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার পটভূমিকায় নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কিন্তু উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এই যে রাজস্ব আহরণে সাফল্য শতভাগ, অর্থাৎ ৬১,০০০ কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষমাত্রা পুরোটাই চলতি অর্থ বছরে আদায় করা সম্ভব হয়েছে। কিছুটা এই কারণে, ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশের স্তরে উন্নীতকরণের লক্ষ্য সামনে রেখে, ২০১০-২০১১ অর্থবছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬.৭%। অর্থনীতিবিদগণ তাঁদের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় এটিকে উচ্চাভিলাষী বলে আখ্যায়িত করেছেন। কারণ এজন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২৪.২% থেকে ৩২.০% শতাংশে। কাজটি মোটেই সহজ নয়। আগামী অর্থবছরে তাই প্রাক্কলিত (এস্টিমেটেড) রাজস্বের পরিমাণ ধরা হয়েছে ৯২,৮৪৭ কোটি টাকা। আর প্রাক্কলিত (এস্টিমেটেড) ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৩২,১৭০ কোটি টাকা। এতে মোট ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৯,৩২৩ কোটি টাকা। এটি জিডিপির ৫ শতাংশ। ঘাটতির টাকা সাধারণত দেশী ও বিদেশী ঋণের দ্বারা মেটানো হয়ে থাকে। কিন্তু তাছাড়াও রাজস্ব আয়ের যে হিসাব দাঁড় করানো হয়েছে তা বর্তমান বছরের চেয়ে ১৯.৫% বেশি। আশঙ্কাটি এখানেই।

"
যানজটের কথা বলে অর্থমন্ত্রী একশ্রেণীর গাড়ির ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছেন। ফলে ঐ গাড়িগুলোর দাম বাড়বে।… অর্থমন্ত্রী কি উচ্চবিত্ত শ্রেণীর গাড়ি ব্যবহারকারীদের প্রতি এর দ্বারা অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করলেন না? কিংবা অর্থমন্ত্রী কি এটা বোঝাতে চাচ্ছেন যে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকদের গাড়িগুলো যানজটের কারণ নয়? মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ১০০১ থেকে ১৫০০ সিসির গাড়িগুলোই যানজটের কারণ? আমার জানা মতে, উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রায় সব সদস্যের প্রত্যেকেই একটি করে গাড়ি ব্যবহার করেন। সে ক্ষেত্রে তারাও যানজটের কারণ।

"

একথা প্রায় সবাই স্বীকার করেন যে সম্ভাব্য রাজস্ব আর প্রকৃত আদায় করা রাজস্বের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে, অর্থাৎ যথেষ্ট পরিমাণে রাজস্ব ফাঁকির ঘটনা নিয়মিতই ঘটছে। বিশেষ করে আয়কর ও মূল্য সংযোজন করের ক্ষেত্রে এই কথাটি বেশি প্রযোজ্য। এর জন্য সংশ্লিষ্ট রাজস্ব বিভাগের দুর্নীতি অনেকখানি দায়ী। কিন্তু সেটিই সব নয়। রাজস্ব প্রশাসনের অদক্ষতা ও প্রশাসনিক যন্ত্রের অপ্রতুলতার কারণে সম্ভাব্য করদাতার নিকট পৌঁছুতে না-পারাও এর একটি বিরাট কারণ। এ কারণে অনেকে যথার্থই মন্তব্য করেন যে নতুন কর আরোপ কিংবা বিদ্যমান করের হার না-বাড়িয়ে যাদের কর দেয়ার কথা অথচ দিচ্ছেন না তাদের কাছ থেকে কর আদায়ের ব্যবস্থা করলে একদিকে যেমন মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়বে না, অন্যদিকে তেমনি সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও তা হবে অগ্রগতিমূলক একটি পদক্ষেপ। নীতিগতভাবে এ ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ থাকার কারণ নেই। তবে কথাটা বলা যত সহজ, বাস্তবায়ন করা মোটেই তত সহজ নয়। একটু ভেবে দেখলেই বিষয়টি সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে।

আমাদের দেশে কর প্রশাসনের যে অবকাঠামো তাতে দূর-দূরান্তের গ্রাম তো দূরের কথা বড় বড় গুটিকয় শহর-বন্দর বাদ দিলে অনেক ছোট ছোট শহর ও বাণিজ্যকেন্দ্রেও তার উপস্থিতি একেবারেই নেই। সুতরাং স্রেফ কর আদায়ের লোক না থাকার ফলে অনেক সম্ভাব্য করই ঐ সব এলাকায় অনাদায়ী থেকে যায়। খোদ ঢাকা নগরীর কথাই যদি ধরা যায় তাহলেও দেখা যাবে অবস্থা খুব একটা সন্তোষজনক নয়। সুসংগঠিত কতিপয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প-কারখানা কিংবা সেবাদানকারীরা নিয়মিত কর দেন কিংবা দিতে বাধ্য হন। তাদের মধ্যেও কেউ কেউ যে কর ফাঁকি দেন না এমন কথা কেউই হলফ করে বলতে পারবে না। তবুও কর প্রশাসনের আওতায় তারা আছেন। কিন্তু কর দেয়া যাদের জন্য আইনানুযায়ী বাধ্যতামূলক এমন অনেক ব্যবসায়ী, শিল্প প্রতিষ্ঠান এমনকি চাকুরিজীবীও এই খোদ ঢাকা শহরেই কোনো প্রকার কর দেন না। এর একাংশ ঘটে কর প্রশাসনের যোগসাজশে, আর একাংশ তাদের নাগালের বাইরে থাকে বলে। সুতরাং যত দ্রুত সম্ভব কর প্রশাসনকে দক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত ও এর প্রশাসনিক কাঠামো বিস্তৃততর করা অতিশয় জরুরি।

বর্তমান বাজেটে এই দিকটায় দেরিতে হলেও খানিকটা নজর দেয়া হয়েছে। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় জানিয়েছেন, দেশের সবগুলো উপজেলা সদরে একজন মূল্য সংযোজন কর কর্মকর্তা, একজন কম্পিউটার চালক ও দুইজন সেপাই নিয়ে একটি করে মূল্য সংযোজন কর অফিস খুলবেন। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আয়করের ব্যাপারেও অত ব্যাপক না-হলেও, এমন ধরনের উদ্যোগ নেয়া এখনই দরকার। অর্থমন্ত্রী যদিও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট সরকারী মহলের পূর্ব-সম্মতি নিয়েই এই প্রশাসনিক পরিবর্ধনের পরিকল্পনা পেশ করা হচ্ছে, তবুও সরকারী কাজের প্রবাদপ্রতীম ধীরগতির কথা জানা আছে বলেই খুব সহসা এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়। তবুও আশা করা যায়, পুরোপুরি না-হলেও, আদায়যোগ্য কিছু মূল্য সংযোজন কর প্রস্তাবিত এই প্রশাসনিক বিস্তারের মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব হবে।

এবার আলোচ্য বাজেটের করারোপের আরও কয়েকটি বিষয় নিয়ে একটু আলাপ করতে চাই। মূল্য সংযোজন করের পরিধি খানিকটা বাড়ানো হয়েছে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর মূল্য সংযোজন কর আরোপ করা হয়েছে। এটা বিতর্কের সৃষ্টি করবে। নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের অনেক ছেলেমেয়েই যারা হাতে গোনা ক'টি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায় না তারাও ভর্তি হয় বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে। এমনিতেই ঐ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খরচ অনেক বেশি। এবার তা আরো বাড়বে। তার চেয়ে এর সার্বিক আয়ের ওপর প্রত্যক্ষ কর আরোপ করলে ছাত্রদের বোঝা হয়তো কিছুটা কম হতে পারত।

যানজটের কথা বলে অর্থমন্ত্রী একশ্রেণীর গাড়ির ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়িয়েছেন। ফলে ঐ গাড়িগুলোর দাম বাড়বে। ১০০০ সিলিন্ডার ক্ষমতাসম্পন্ন গাড়ির করহার অপরিবর্তিত থাকছে; বাড়ছে ১০০১ থেকে ১৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির। এগুলোর ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক ৩০% থেকে বেড়ে ৪৫% করা হলো। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার যে ১৫০১ থেকে ১৬৫০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির সম্পূরক শুল্ক বিদ্যমান ১০০% থেকে কমিয়ে ৪৫% এ আনা হলো। অর্থমন্ত্রী কি উচ্চবিত্ত শ্রেণীর গাড়ি ব্যবহারকারীদের প্রতি এর দ্বারা অন্যায় পক্ষপাতিত্ব করলেন না? কিংবা অর্থমন্ত্রী কি এটা বোঝাতে চাচ্ছেন যে উচ্চবিত্ত শ্রেণীর লোকদের গাড়িগুলো যানজটের কারণ নয়? মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ১০০১ থেকে ১৫০০ সিসির গাড়িগুলোই যানজটের কারণ? আমার জানা মতে, উচ্চবিত্ত পরিবারের প্রায় সব সদস্যের প্রত্যেকেই একটি করে গাড়ি ব্যবহার করেন। সে ক্ষেত্রে তারাও যানজটের কারণ।

বাজেট বক্তৃতার প্রত্যক্ষ কর বা আয়কর অংশে অর্থমন্ত্রী বলেছেন যে ভূমি-ব্যবসায় ও নির্মাণ খাতের অভাবনীয় সম্প্রসারণের ফলে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী প্রায় রাতারাতি অকল্পনীয় সমৃদ্ধি অর্জন করেছেন। সুতরাং তাদের ওপর খানিকটা কর আরোপ করা ন্যায়সংগত। তাঁর এই বক্তব্যের সাথে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু এ-কথা বলে তিনি যে কর প্রস্তাব করলেন তা ঐ নব্যধনীদের টিকিটিও ছুঁতে পারবে না। অবশ্য বাংলা প্রবাদের সেই টিকি এই নব্য ধনীদের কারোরই এখন আর নেই; সাংস্কৃতিক পট পরিবর্তনের কারণে। পরোক্ষ করের মত, নতুন এই করের পুরো দায়ভারই গিয়ে পড়বে ফ্ল্যাটের ক্রেতার ওপর। এটিকে তাহলে প্রত্যক্ষ কর কেন, মূল্য সংযোজন কর হিসেবে আরোপ করলেই তো হতো!

এত কিছু সত্বেও বলব, বাজেটের একটি লক্ষ্যমাত্রা আছে। আর তাহলো বার্ষিক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু সেজন্য করদাতা হিসেবে সাধারণ নাগরিক যেখানে আত্মত্যাগ করবেন, ধনিশ্রেণীর সুস্পষ্ট ত্যাগের কোনো স্বাক্ষর এখানে লক্ষণীয় নয়। ফলে, এবারের এই বাজেট করের এক কারেন্ট জাল মাত্র, যাতে আটকা পড়বে শুধু জাটকারাই। রাঘব বোয়ালরা এবারেও জালের বাইরে  বাইরেই থাকছেন।