রোহিঙ্গা-ইস্যু: জাতিসংঘের প্রস্তাব ও আমাদের করণীয়

ড. ইমতিয়াজ আহমেদ
Published : 28 Dec 2012, 12:57 PM
Updated : 28 Dec 2012, 12:57 PM

মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যকার জাতিগত সহিংসতা নিয়ে জাতিসংঘের সাধারণ সভায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে ২৪ ডিসেম্বর। পাশাপাশি, সেদেশে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য দায়ী পক্ষগুলোকে চিহ্নিত করতেও দেশটির সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ সভায় মিয়ানমারে চলমান জাতিগত সংকট নিরসনে সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়।

প্রস্তাবে রোহিঙ্গা মুসলমানদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়াসহ সব ধরনের মানবাধিকার রক্ষায় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। এর আগে এক হিসাবে বলা হয়, গত জুন থেকে মিয়ানমারে উগ্রবাদীদের মুসলমানবিরোধী দাঙ্গায় শত শত রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এক লাখ ১৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা ভিটেমাটি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তাদের ঘরবাড়িও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে রোহিঙ্গা-সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আহ্বান জানিয়ে যে প্রস্তাব রাখা হয়েছে- আমি মনে করি তা খুবই স্বাভাবিক। কারণ এ মুহুর্তে এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে মিয়ানমারের ওপর চাপ রয়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদের জন মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রথম যে দেশ সফরে গিযেছেন সেটি হল মিয়ানমার্। নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা-সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে মিযানমারের প্রেসিডেন্ট থিয়েন সেইনের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলেছেন্। ইয়াঙ্গুন বিশ্ববিদ্যালযে বক্তৃতা দিতে গিয়েও একই কথা বলেছেন তিনি। তখন তাঁর পাশে বসেছিলেন মিয়ানমারের গণতন্ত্রীপন্থী নেত্রী অং সান সুচি। মিয়ানমারে এ মুহুর্তে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের যে আভাস দেখা যাচ্ছে সেখানে সুচিই হতে পারেন সেখানকার সম্ভাব্য শাসক। সেক্ষেত্রে মিযানমারের কাছে যুক্তরাষ্টে কী কী পরিবর্তন প্রত্যাশা করে এটা এভাবে খোলাখুলি জানিয়েই দিল মার্কিন প্রশাসন।

মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন রাজ্যে জাতিগত সহিংসতার পেছনে কোনো ধরনের অজুহাত চলবে না বলে মন্তব্য করেছিলেন বারাক ওবামা। সেখানকার মুসলিম রোহিঙ্গাদের সঙ্গে রাখাইন বৌদ্ধদের চলমান সহিংসতা ও উত্তেজনা বন্ধের জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহবান জানিয়েছেন তিনি। সে সঙ্গে রোহিঙ্গাদের সম-অধিকারের কথা তুলে ধরে তাদের রাষ্ট্রের মূলস্রোতে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়ার জন্য জোরালো আহবান জানিয়েছিলেন তিনি।

মিয়ানমারের কাছে যুক্তরাষ্ট্রর এ প্রত্যাশার ফলেই এখন স্বভাবত জাতিসংঘ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ জাতিসংঘ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো প্রভাবশালী দেশের চাওয়াকে সবসময়ই গুরুত্ব দিয়ে থাকে। তাছাড়া মিয়ানমার আগামী বছর থেকে আসিয়ানের নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছে। একাধিক আসিয়ান দেশে রোহিঙ্গা-শরণার্থী রয়েছে, তাই আসিয়ান-ভুক্ত দেশগুলোর চাপ তো মিয়ানমারের ওপর রয়েছেই। ফলে রোহিঙ্গা-ইস্যুটির সমাধান মিয়ানমার যত দ্রুত করবে সেটা তাদের জন্য ততই ভালো।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদাযের পক্ষ থেকে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের পর মিয়ানমারের পক্ষে এ থেকে পিছিয়ে আসার কোনো সুযোগ আর নেই এটা বলা যায়। বারাক ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদে সদ্যই নির্বাচিত হয়েছেন। আরও চার বছর ক্ষমতায় আছেন তিনি। তাই তাঁর আহ্বান উপেক্ষা করলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাম্প্রতিক বন্ধুত্বের সম্পর্কটি ধরে রাখা এবং বিশ্বায়নে প্রবেশ করা মিয়ানমারের জন্য কঠিন হবে। দেশটি এখন গণতন্ত্রায়নের পথে হাঁটছে। অং সান সুচিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে দেশটি একটু একটু করে সামনে এগুতে চাচ্ছে। দেশটির অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বড় একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেদেশে মার্কিন বিনিয়োগ ও মার্কিন মুল্লুকে নিজেদের বাজার তৈরি করতে চাচ্ছে মিয়ানমার। এ প্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে মিয়ানমার যাতে অভ্যন্তরিণ সমস্যাগুলোর সমাধান করে ফেলে। আর তাই সাধারণ পরিষদের এই আহ্বান উপেক্ষা করা মিয়ানমারেরর পক্ষে কঠিন।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির নানা সমীকরণের খবর যারা রাখেন তারা খুব ভালোভাবেই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। কথা হচ্ছে যে পরিবর্তিত এ অবস্থায় আমরা কীভাবে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারি। সন্দেহ নেই, রোহিঙ্গা-সমস্যাটি মিয়ানমারের অভ্যন্তরীন। কিন্তু আমরা যে এ সমস্যার সঙ্গে কঠিনভাবে জড়িয়ে গেছি। ১৯৯১ সাল থেকে কয়েক দফায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা আমাদের দেশে এসে ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশে বৈধ রোহিঙ্গা-শরণার্থী রয়েছে ২৬ হাজারের মতো। আরও তিন লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে যাদের ব্যাপারে তথ্য নেই। এত বিপুল জনসংখ্যাকে নাগরিকত্ব দেওয়া বা রেখে দেওয়া তো আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই আমাদের দিক থেকেও একটি তাগাদা থাকতে হবে।

রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দিক থেকেও একটি চাপ ছিল। বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বের দিক থেকে। কারণ রোহিঙ্গারা গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, এমনকী সিঙ্গাপুরেও রয়েছে রোহিঙ্গা-জনগোষ্ঠী। একাধিক মধ্যপ্রাচ্যীয় দেশে রোহিঙ্গারা রয়েছে। সব মিলিয়ে এ সংখ্যা কারও মতে ৭ লাখ, কারও মতে ১ মিলিয়ন, এমনকী কেউ কেউ এ সংখ্যা ২ মিলিয়ন বা বিশ লাখের মতো বলেও মত দিয়েছেন। এ প্রেক্ষিতে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো গোটা বিশ্বের কাছে রোহিঙ্গাদের অমানবিক অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক রিপোর্টে রাখাইন রাজ্যে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন রোহিঙ্গা-ইস্যুটির সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক মহল তৎপর।

এ বছরের জুনে রাখাইন রাজ্যে এক বৌদ্ধ নারীকে ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার প্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতা চালায় রাখাইনরা। বাড়িঘর ছেড়ে রোহিঙ্গারা আশেপাশের দেশগুলোতে আশ্রয় নিতে আসে। সবচেয়ে বেশি আসে বাংলাদেশে। তখন বাংলাদেশ ওদের আশ্রয় দিতে অস্বীকার করে। বাংলাদেশের এ পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, একাত্তরে আমরা নিজেরাও এমন একটি আশ্রিত জাতি হিসেবে ভারতের কাছ থেকে প্রচুর সহযোগিতা পেয়েছি, সে অতীত কেন ভুলে গেলাম আমরা? আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এ কাজ মানবাধিকারের আন্তর্জাতিক ধারণার পরিপন্থী। বিশেষ করে অত্যাচারের শিকার রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের আশ্রয় না দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। আমরা যদি বরং সে সময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিষয়টির কূটনৈতিক সমাধানের ওপর জোর দিতাম, বাইরের বিশ্বের কাছে এ সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে দৃষ্টিআকর্ষণ করতাম, তাহলে সেটা আমাদের জন্য বেশি ভালো হত।

রোহিঙ্গা-সমস্যার সমাধানের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি উদ্যোগ আমাদের দিক থেকেই আসা জরুরি ছিল। কারণ এরা সবসময় আমাদের প্রতিবেশি হিসেবেই থেকে যাবে। বিরাটসংখ্যক রোহিঙ্গা-শরণার্থীকে এদেশে আশ্রয় দিতে হয়েছে। আমরা এসব বিষযে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টিআকর্ষণে ব্যর্থ হয়েছি। রোহিঙ্গাদের নিয়ে এখানে বস্তুত কোনো আলোচনাই নেই। এমনকী জাতিসংঘ যে প্রস্তাব দিযেছে সেখানে আমাদের দিক থেকে কোনো চাপ বা উদ্যোগ ছিল না।

অথচ একাধিক মুসলিম দেশ গত ছয় কী নয় মাসে রোহিঙ্গা-ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আযোজন করেছে। মালয়েশিয়াতে এ আয়োজনে স্বয়ং মাহাথির মোহাম্মদ উপস্থিত ছিলেন। তুরস্কের ইস্তাম্বুলের আয়োজনটির উদ্যোক্তা ফার্ষ্টলেডি ও মানবাধিকার-কর্মী মিসেস এরদোগান। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ইস্তাম্বুলে আয়োজিত 'কনফারেন্স অন দ্য আরাকানে' অংশ নিয়েছিল অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের অনেক দেশ। একাধিক টেলিভিশন চ্যানেলে অনুষ্ঠিানটি সরাসরি দেখানো হয়েছে। ফার্স্টলেডি এর উদ্বোধন করেছেন। সেখানে রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপনের ওপর অনেক ডকুমেন্টারি দেখানো হয়েছে। ফার্ষ্টলেডি বক্তৃতা দেওয়ার সময় জানিয়েছেন, তিনি নিজে রিফিউজি-ক্যাম্প পরদর্শন করেছেন, কথা বলেছেন রোহিঙ্গাদের সঙ্গে। এসব বলতে গিয়ে তিনি কযেকবার আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন।

অবাক হয়েছিলাম, ওখানে বাংলাদেশ দূতাবাসের কেউ ছিলেন না। এত বড় একটি আয়োজনের খবর আমাদের দূতাবাস কি জানত না? নাকি তারা ভেবেছেন যে ওখানে তাদের সমালোচনা করা হবে? মজার বিষয় হল, বরং বিপরীতটিই হয়েছে। তুরস্কের ফার্ষ্টলেডি ওখানে বাংলাদেশের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছেন, 'বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য অনেক করেছে। এখন রোহিঙ্গা-সমস্যার সমাধান আন্তর্জাতিক মহলকে কাজ করতে হবে।' আরও বলেছেন, 'এটা বাংলাদেশের একার দায়িত্ব নয়।'

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কিছু করতে পারছে না এটা নিয়েই ওখানে কথা বলেছেন সবাই। আামি রোহিঙ্গাদের নিয়ে গবেষণা করেছিলাম বলে আমাকে কনফারেন্সে ডাকা হয়েছিলে। আমি ওখানে জানিয়েছি, বাংলাদেশের সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা-শরণার্থীদের আশ্রয় না দেওয়ার বিষয়টি সমালোচিত হয়েছে। তাতে সম্মেলনে উপস্থিত অন্যান্য দেশের ডেলিগেটরা স্বস্তি অনুভব করেছেন। আরও ভালো হত যদি ওখানে সরকারের পক্ষ থেকে কেউ বা দূতাবাসের লোকেরা থাকতেন। আমার মত হল, যদি ওখানে আমাদের সমালোচনাও করা হত- যদিও সেটা করা হয়নি- তবু উচিত ছিল ওখানে উপস্থিত থাকা। এটা আমাদের ডিপ্লোমেসির ব্যর্থতা। অথবা হতে পারে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা হয়তো অন্যকোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত!

এমনিতেই আমাদের অনুসৃত পররাষ্ট্রনীতির কিছু ব্যর্থতার চিত্র স্পষ্ট হচ্ছে। আমরা গত কয়েক বছর ধরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধানকে দেশে আনতে পারিনি একমাত্র ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ছাড়া। শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ্র রাজাপাকসে বাংলাদেশে এসছেন। তিনি আন্তর্জাতিকভাবে বিতর্কিত একজন সরকারপ্রধান। তাঁকে কেউ ডাকে না। ইউরোপিয়ান কোর্টে তার বিরুদ্ধে মামলাও রয়েছে, তামিল টাইগারদের ওপর নিপীড়ন করেছিলেন বলে। ওদিকে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট এসেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে দেশটির একটি ঝামেলা রয়েছে। আর তাই ওরা অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সহায়তার সম্ভাব্যতা যাচাই করছে। ভুটানের রাজা এসেছিলেন। আর এসেছেন থাই প্রধানমন্ত্রী ইংলাক সিনাওয়াত্রা। কিন্তু এঁরা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নন। তাদের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মিয়ানমারের বিরোধীদলীয় নেতা অং সান সুচি।

গত বছর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমার সফরে গিয়েছিলেন। অং সান সুচির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। সুচির ব্যস্ততার জন্য দুজনের সাক্ষাতের সময় ঠিক করা যায়নি। আমার মনে হযেছে, সেক্ষেত্রে কোনো না কোনো অজুহাত দেখিয়ে সফরটি পিছিয়ে দিলে ভালো হত। কারণ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টকে কজন চেনে যতজন জানে সুচির নাম?

আমাদের এখানে যে কূটনৈতিক চিন্তাটি ছিল তা ব্যর্থ হয়েছে। চিন্তাটি ছিল সুচির সঙ্গে দেখা না করলে সামরিক জান্তারা খুশি হবেন। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের প্রেসিডেন্টকে আমরা বাংলাদেশে আনতে পারব। আমরা কিন্তু সেটাও পারিনি। ফলে আমরা দুকুল হারিয়েছি।

অং সান সুচি এখন অনেক দেশে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিবেশি দেশ হিসেবে বাংলাদেশে তাঁর আসা জরুরি ছিল। তাছাড়া যেখানে রোহিঙ্গা-শরণার্থীদের জায়গা দিতে বাধ্য হওয়ায় আমাদের ওপর একটি চাপ রয়েছে– তাই তাঁর সঙ্গে আমাদের নেতৃত্বের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকলে রোহিঙ্গা-শরণার্থীদের জন্য বাংলাদেশ কী করেছে বা কীভাবে এ সমস্যাটি আমাদের বিপর্যস্ত করছে সে ব্যাপারে তাঁকে আমাদের দিক থেকে স্পষ্ট করা যেত।

আমাদের মনে রাখতে হবে, তিনি এখন বাইরে বিপুলভাবে গৃহীত। তিনি কোনো দেশ সফরে গেলে সেটা একটা বড় খবর হয়। সুচি মানেই এখন একটি আইডিয়া যেমনটি নেলসন ম্যাণ্ডেলা। সুচি মিয়ানমারের ভবিষ্যত, অতীত নন। ব্যক্তি সুচি বড় নন। তাই তাঁকে সব জায়গায় সম্মান দেওয়া হয়। ভবিষ্যতে মিয়ানমারে গণতন্ত্রায়ন হলে সুচি ক্ষমতায় থাকুন কী না থাকুন, তিনি গুরুত্বপূর্ণই থাকবেন। তাই তাঁর সঙ্গে আমাদের একটি যোগাযোগ থাকা দরকার।

কোনো ক্ষেত্রে তিক্ততা তৈরি হয়ে গেলে সেটার ক্ষতিপূরণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এর আগে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রবিজয় উদযাপনের যে মহোৎসব করেছি তাতে পারস্পরিক সম্পর্কে একটি ক্ষতি হয়েছে। প্রতিবেশির সঙ্গে জয়-পরাজয়ের কিছু নেই। আমাদের সংস্কৃতিতে রয়েছে, কোনো বিজয় লাভ বা বিশেষ কোনো অর্জনের পর বিনয়ী থাকতে হয়। আমাদের ঘরোয়া রাজনীতিতে যে সমস্যাটা রয়েছে, এক দল আরেক দলের ওপর নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে চায় সেটারই যেন প্রকাশ হল এভাবে। আমরা ন্যায্যভাবেই সমুদ্রসীমায় আমাদের দাবি পেয়েছি, এতে নিজেদের বিজয়ী ভাবার কোনো কারণ নেই। অথচ আমাদের সংবিধানে আছে, 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়।' কাজেই সংবিধান মানলে আমাদের সম্ভব সব উপায়ে অন্যদেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।

বাংলাদেশ এখন রোহিঙ্গা-ইস্যুতে যা করতে পারে তা হল, একটা হোমওয়ার্ক করে নিতে পারে। যে দেশগুলো এখানে জড়িত সেগুলোর সঙ্গে কথা বলে আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে খোলাখুলি আলোচনা করতে পারি। তাদের আমরা বলতে পারি, সমস্যাটি আমরাই যদি সমাধান করে ফেলি তবে এখানে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলার বা চাপ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

তাছাড়া বাংলাদেশ এ ইস্যুতে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করতে পারে। এটি হতে পারে সুশীল সমাজ, এনজিও এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলোকে সঙ্গে নিয়ে। সেটা ঢাকায় বা অন্যকোনো দেশেও আয়োজন করা সম্ভব। সেখানে সমস্যার সুস্পষ্ট সমাধানের ব্যাপারে একটা দিকনির্দেশনা আসতে পারে। সেক্ষেত্রে পরবর্তীতে স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে আরেকটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করা যায়। যেমন, চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে এ ধরনের আয়োজন হলে সেখানে রোহিঙ্গা-ইস্যুর সমাধানের পুরো নির্দেশনা উঠে আসবে। পরে এসব সমাধান নিয়ে আমরা মিয়ানমারের ওপর একটি চাপ তৈরি করতে পারি। কারণ আমাদের বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত পাঠানোর একটি স্বার্থ জড়িত রয়েছে। আমরা সীমান্ত বন্ধ করে দিয়ে বসে থাকব ভাবলে ভুল হবে।

তাছাড়া মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা-ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপটি পরে না-ও থাকতে পারে। বাংলাদেশ যদি একে গুরুত্ব না দেয় তবে অন্যদের আগ্রহ কমে যেতে পারে। অথবা কিছুদিন পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যকোনো বড় ইস্যু সামনে চলে এলে এটি আড়ালে চলে যেতে পারে। এখন রোহিঙ্গা-ইস্যুতে আমরা যদি ভালো একটি ভূমিকা রাখতে পারি তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেটা মনে রাখবে।