ঢাকার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা দরকার

মেহেদী আহম্মদ আনসারী
Published : 24 Dec 2012, 06:38 PM
Updated : 24 Dec 2012, 06:38 PM

মাঝে-মধ্যেই ছোট ছোট ভূমিকম্পে কেঁপে উঠছে ঢাকাসহ সারাদেশ। এই সেদিনও যেমন একটি ছোট্ট ভুমিকম্প হল। এর পাশাপাশি কিছু ভূমিকম্প একটু মাঝারি ধরনেরও হচ্ছে। ঢাকার মতো মেগাসিটিতে যারা বাস করেন, তাদের মধ্যে এ নিয়ে একটি আতঙ্কও রয়েছে। বিপুল জনসংখ্যার চাপে পিষ্ট এ নগরীর গড়ে-ওঠায় অপরিকল্পনার ছাপ সর্বত্রই। আর সেটাই মানুষের মধ্যে এধরনের আতঙ্ক তৈরি করছে।

কিন্তু কী হত যদি রাজধানী শহরটিকে আমরা একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে পারতাম? সাধারণ মানুষ তাহলে বিশ্বাস করতেন যে, এরকম হলেও এ নগরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হবে না। সে সুযোগ যে একবারেই নেই এমনটি ভাবারও কোনও কারণ নেই। এজন্য দরকার শুধু পরিকল্পনা। ঢাকাকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার সদিচ্ছা। আমরা আনুষ্ঠানিকতায় বেশ এগিয়ে, কাজে নই। এই যেমন, বিশ্ব নগর পরিকল্পনা দিবস নামে একটি দিবস আন্তর্জাতিকভাবে ঘোষিত হয়েছে। ৮ নভেম্বর এ দিবসটি পালিত হচ্ছে। আমরা দিবস পালন করছি, ঢাকাকে পরিকল্পিত নগর হিসেবে গড়ে তোলা নিয়ে নানা আলোচনাও করছি। তবে আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ঢাকার মতো কোটি মানুষের বসবাসের একটি স্থানকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলার জন্য কোনও উদ্যোগই নেই। তাই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সাময়িকী বা জরিপে নিয়মিতই ঢাকাকে বিশ্বের অন্যতম বসবাসের অনুপযোগী শহর হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এটা তো নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য লজ্জাজনক। তবে তার চেয়ে বেশি উদ্বেগের।

ঢাকার পরিবেশ দূষণ ও বসবাসের অনুপযোগিতার কথা আমরা নিজেরাই জানি। দৈনন্দিনের জীবনযাপনে কত যে বিড়ম্বনা পোহাতে হয় আমাদের। পানি-গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটে বিপর্যস্ত নাগরিক জীবন। রাস্তায় বেরোলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থেকে মূল্যবান শ্রমঘণ্টা নষ্ট করতে বাধ্য হওয়া। কোথাও কোনও পরিকল্পনার ছাপ নেই। আবাসিক-অনাবাসিক এলাকা বলে আলাদা কিছু নেই। নেই পুকুর-জলাশয়-গাছপালা-খেলার মাঠ।

এ নগরে বায়ুদূষণ বেশি। এখানে সবুজের দেখা নেই। জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক। যখন খুশি যেখানে খুশি রাস্তাঘাট কেটে একাকার করা হয়। দেখা যায় মাসখানেক ওভাবেই পড়ে থাকে। ধুলোবালি থেকে অসুখ-বিসুখ হয়। উন্নত দেশে এটা কি কল্পনা করা যায়?

মোট কথা, যে সব সূচকের ভিত্তিতে একটি নগরকে বসবাসের উপযোগী বলা যায়, তার অনেক কিছুই এ নগরে নেই।

আপনি যদি মোটামুটি মধ্যবিত্তের বসবাসের স্থান ছেড়ে ঢাকার নিম্ন-মধ্যবিত্তদের আবাসস্থলে যান- দেখতে পাবেন বেশিরভাগ পরিবারের জন্য সেখানে ভালো ড্রেনেজ-ব্যবস্থা নেই। নেই টয়লেট-ওয়াশিং-বাথিং-এর জন্য কোনও স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থা। সাধারণ হাইজিন রক্ষা করতেই এ সব পরিবার হিমশিম খায়। ঢাকার জনসংখ্যার বিরাট অংশই এভাবে বসবাস করে। আসলে এভাবে থাকতে ওরা বাধ্য হয়।

ঢাকার জন্য সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল একটি সুন্দর পরিকল্পিত ব্যবস্থা যার মাধ্যমে নগরের মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ হবে। আবার নগরের ওপর চাপ কমাতে আরও বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিল যেগুলো বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগরীগুলো নিয়ে থাকে।

নগরের যানজট কমাতে আমাদের জন্য সবচেয়ে উপযোগী হল আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়ে। বিশ্বের ঘনবসতিপূর্ণ নগরীগুলোতে কিন্তু সাবওয়ের ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এমনকী আমাদের পাশের দেশ ভারতের দিল্লিতে সাবওয়ে চালু হয়েছে। কোলকাতার মতো শহরে দশ-পনেরো বছর আগে থেকেই সাবওয়ে চালু আছে।

আমার গবেষণার বিষয় মাটি। আমি দেখেছি, ঢাকার মাটি সাবওয়ের জন্য খুবই উপযুক্ত। জাইকা আমাদের এখানে সাবওয়ে করার ব্যাপারে একটি প্রস্তাব দিয়েছিল। সেটা আটকে আছে। আমরা চেয়েছি, পার্লামেন্টে আলোচনা হোক এটা নিয়ে। মনে আছে, জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার এ নিয়ে একদিন দুঃখ প্রকাশ করেছিলেন। কেন আমরা এ দিকে গুরুত্ব দিচ্ছি না এ প্রশ্ন আমাদেরও।

কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে মহাখালী পর্যন্ত যে লাইনটা গিয়েছে এটার নিচে আমরা সাবওয়ে নির্মাণ করতে পারতাম। সবচেয়ে ভালো জায়গা ছিল এটি। আমরা চিন্তা করেছিলাম এটা নিয়ে কিন্তু পরে দেখা গেছে আমরা ২৬ কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণ করে ফেলেছি।

তা না করে এখানে সাবওয়ে নির্মাণ করতে পারলে মহানগরীর অসহনীয় ট্রাফিক জ্যাম এড়াতে পারতাম আমরা। বায়ুদূষণ অনেক কমে যেত। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় এ ধরনের সাবওয়ে নির্মাণের আরও সুবিধা ছিল। তা না করে বরং বাধা দেওয়া হল। কেন এটা করা হল এর উত্তর নেই।

অবশ্যই একটি স্বার্থান্বেষী গ্রুপ সাবওয়ের ওপর গুরুত্ব দিতে বাধা দিচ্ছে। তাই দেখা যায়, কোনও এক অদৃশ্য কারণে আমরা মহানগরীতে কেবল বাস-সার্ভিসের বিকাশ ঘটিয়ে যাচ্ছি। আর এই বাস-চলাচলের সুবিধার জন্যই আমরা ঢাকার বুকে ফ্লাইওভারের সংখ্যা বাড়িয়ে যেতে বেশি আগ্রহী। বিশেষ একটি দল বা গোষ্ঠীর স্বার্থ না দেখে আমরা যদি আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়ে নির্মাণ করে নগরের রাস্তাঘাটের ওপর চাপ কমাতে পারতাম তাহলে এই নগরের অন্যান্য সমস্যার দিকে নজর দেওয়া যেত।

দ্বিতীয় যে পদক্ষেপ নেয়া আমাদের জন্য জরুরি ছিল তা হল, কমিউটার ট্রেন-সার্ভিসকে প্রমোট করা। তার মানে- ঢাকার আশেপাশের শহরগুলো যেমন, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, গাজীপুর ইত্যাদিতে বৃত্তাকারে কমিউটার সার্ভিস চালু করা। এর জন্য আমাদের কিন্তু যথেষ্ট ভালো অবকাঠামো আছে। তার মানে, রেললাইন তো আছেই। তাই খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হত না। শুধু ট্রেনের সার্ভিসটা আরেকটু উন্নত করলেই হত। কোথাও কোথাও ডাবল লাইন করে দিলেই হত।

ঢাকায় এখন ভাসমান জনগোষ্ঠী বাড়ছে এ জন্যই যে এখানে ভালোমানের কমিউটার সার্ভিস নেই। তাই লোকে যে কোনও মূল্যে এ নগরীর মধ্যেই নিজের ঠিকানা গাড়তে সচেষ্ট হচ্ছে। এর ফলে আরেক দিক থেকেও সমস্যা হচ্ছে। ডেভলপারদের সংখ্যা বাড়ছে। নদী-জলাশয় ভরাট করে উঁচু উঁচু ভবন তৈরি হচ্ছে।

সিডনিতে বাঙালিরা কেউ মূল শহরে থাকেন না। ত্রিশ কি চল্লিশ কিলোমিটার দূরে উপকণ্ঠে থাকেন। প্রতিদিন এসে অফিস করেন। মুম্বাই শহবে প্রতিদিন দু' থেকে তিন কোটি লোক প্রবেশ করেন। আবার কাজ শেষে বেরিয়ে যান।

আমাদের সে রকম রোড-নেটওয়ার্ক ও ট্রেন-সার্ভিস থাকলে লোকে তাই করত। মানুষ ঢাকামুখী হত না। ডেভলপাররা ওসব এলাকায় চলে যেত। ঢাকার আশেপাশে গড়ে ওঠা পরিকল্পিত আবাসিক এলাকা থেকে মানুষ প্রতিদিন কমিউটার সার্ভিসের মাধ্যমে ঢাকায় এসে কাজে যোগ দিত। আবার কাজ শেষে ফিরেও যেত। নগরীর জনসংখ্যা এ হারে বাড়ত না। বিশ্বের সবচেযে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঢাকার বদনাম ঘুচে যেত।

তৃতীয় যে কাজ আমাদের করা উচিত ছিল তা হল, নগরীর আবাসিক ও অনাবাসিক এলাকার মধ্যে সুস্পষ্ট সীমারেখা টেনে দেওয়া। কোন এলাকায় কী হবে আর কী হবে না এ ব্যাপারে পরিকল্পনা থাকার পাশাপাশি কঠোরভাবে এটা মেনে চলতে হবে।

আধুনিক ঢাকা যখন গড়ে উঠছিল তখন এ ধারাটি রক্ষার চেষ্টা হয়েছিল। ওয়ারী ছিল ঢাকার প্রথম পরিকল্পিত আবাসক এলাকা। সম্ভবত পঞ্চাশের দশকে এটি গড়ে উঠেছিল। ধানমণ্ডি গড়ে উঠেছে ষাটের দশকে। পরে এসেছে মোহাম্মদপুর। এ সব জায়গার আবাসিক চরিত্র আর নেই। ধানমণ্ডিতে এখন সবসময় জ্যাম লেগে থাকে। ওয়ারী পুরোপুরি বাণিজ্যিক এলাকা হয়ে উঠেছে। এ সব এলাকায় স্কুল বা অফিস তো হওয়ারই কথা ছিল না। পৃথিবীর কোন মেগাসিটিতে এমন অবস্থা দেখা যায়?

আমার কথা হল, একেকটি এলাকাকে আবাসিক বা অনাবাসিক চরিত্র নিয়ে গড়ে উঠতে না দিলে সমস্যা হবেই।

আমাদের আর যে জিনিসটি দরকার তা হল, নগরের সবুজ ও জলাশয় রক্ষা করা। উন্নত দেশের শহরাঞ্চলে সবুজ অনেক বেশি। একটি পরিকল্পিত নগরে ত্রিশ শতাংশ সবুজ থাকার কথা। এখন আমাদের উঁচু উঁচু অ্যাপার্টমেন্টগুলোতে সবুজের ছোঁয়া পাওয়া যায় না। চারদিকে সবুজ ধ্বংস করে যেটুকু গাছপালা লাগানো হচ্ছে তা সামান্যই।

বলধা গার্ডেনের পাশে কিন্তু ষোল তলার বেশি উঁচু ভবন তৈরি হওয়ারই কথা ছিল না। এখন হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের জন্য বলধা গার্ডেনের গাছগুলো সূর্যের আলো পায় না। তাই নতুন গাছ ওখানে জন্মায় না। অথচ একসময় এটি ছিল ঢাকার বুকে এক টুকরো সবুজ।

আমার মনে আছে, একসময় শান্তিনগরে বড় একটা পুকুর ছিল। আমার এক বন্ধুর বাসা ছিল ওখানে। যেতাম নিয়মিত। দেখেছি। সেটা খুব বেশিদিন আগের কথাও নয়। এখন সেখানে শুধু অ্যাপার্টমেন্ট আর অ্যাপার্টমেন্ট। পুরো ঘিঞ্জি হযে উঠেছে এলাকাটা। সেগুনবাগিচায় ছোট ছোট একতলা বাসা ছিল প্রচুর। এখন সেখানে বহুতল ভবনের প্রাচুর্য। কোথায় সবুজ? কোথায় জলাশয়? এসব বহুতল ভবন নির্মাণের ব্যাপারে কি কোনও পরিকল্পনা আছে? পুরান ঢাকায় একসময় অনেকগুলো পুকুর ছিল। গুগলে দেখেছি, এখন দুটি কী তিনটি পুকুর অবশিষ্ট আছে মাত্র!

কিন্তু এ পরিস্থিতি তো আমরা এড়াতে পারতাম। এর জন্য যে পরিকল্পনার দরকার ছিল সেটাই তো নেই।

এভাবে ঢাকার সবুজ আর পানি ধ্বংস করে শুধু ভববন গড়ে উঠছে। যারা তৈরি করছে তারা কিন্তু দেখছে এখানে জায়গার দাম বেশি। এখনই এ সব না থামালে আগে যে চল্লিশ শতাংশ জল বা সবুজ ছিল তা এখন যে দশ শতাংশে নেমে এসেছে তা-ও আর থাকবে না।

আসলে আমাদের সমস্যা হল, আমরা সবকিছুই স্বল্পমেয়াদে করতে চাই। যেমন বিদ্যুতের জন্য কুইক রেন্টাল সার্ভিস। তিন বছর মেয়াদী এ সার্ভিসের জন্য নতুন পাওয়ার প্ল্যান্টের কথা আর শোনাই যাচ্ছে না। আমরা একটা জিনিস বুঝতে চাই না যে, দীর্ঘমেয়াদী স্থাপনায় এ মুহুর্তে খরচ বেশি হলেও পরে এর খরচ কমে আসে।

তাই আমার সাধারণ জ্ঞান বলে এভাবে হবে না। এভাবে আমরা বেশিদূর এগুতে পারব না। এ জন্য আমাদের দরকার লংটার্ম মিশন-ভিশন দুটোই। তা না করলে ঢাকাকে একটি দূষণমুক্ত পরিচ্ছন্ন এবং নাগরিকের বসবাসের উপযোগী মেগাসিটি হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন ব্যর্থ হবে।

ড. মেহেদী আহম্মদ আনসারী : বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক।