যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো?

নজরুল ইসলাম
Published : 21 Feb 2016, 05:34 AM
Updated : 23 Dec 2012, 12:19 PM

ইংল্যান্ড, সাউথ আফ্রিকা, অষ্ট্রেলিয়া, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, জিম্বাবুয়ে, আয়ারল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, কেনিয়া- আইসিসির এই সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে পাকিস্তানের বন্ধুতা থাকুক বা না থাকুক, অন্তত শত্রুতা নেই বলেই জানি। শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট দল পাকিস্তানে গিয়ে একবার আক্রান্ত হয়েছে আর ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের একটা রেষারেষি আছে, এটুকু ধরে নিলেও শত্রুতার ব্যাপারটা নেই। অন্তত এই দেশগুলোর কোনো একটাতেও পাকিস্তান গণহত্যা চালায়নি, ৩০ লক্ষ মানুষ খুন করেনি, লাখ লাখ মা বোনকে ধর্ষন করেনি, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীদের হত্যার নীল নকশা তৈরি করেনি, দেশের অভ্যন্তরে তাবেদার বাহিনী তৈরি করে রেখে আসেনি যারা ষড়যন্ত্রের জাল বুনে যুগের পর যুগ ধরে দেশটিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রাখবে, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে জাতির গৌরবের ইতিহাস ভুলে মিথ্যে ইতিহাস শেখানোর চেষ্টা করবে।

এই কাজগুলো পাকিস্তান অন্য কোনো রাষ্ট্রের সঙ্গে করেনি, করেছে একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গে।

ক্রিকেট বিশ্বে পাকিস্তান আজ বড্ড অসহায়, সেই (না)পাকিস্তানে কোনো ক্রিকেটার খেলতে যেতে রাজী হয় না, সেই অভিশপ্ত দেশে কোনো রাষ্ট্র তাদের গৌরবের ক্রিকেট দলকে পাঠাতে রাজী হয় না, সেই বর্বর মাটিতে পা রাখতে চায় না কোনো আম্পায়ার, কোনো অফিসিয়াল। এই যখন অবস্থা, তখন পাকিস্তানের প্রতি সদয় বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিলো বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড! অন্য ক্রিকেট জাতিগুলো যেখানে পাকিস্তানে খেলতে যাচ্ছে না, সেই পাকিস্তানে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমকে পাঠাতে উঠে পড়ে লেগেছে বিসিবি!

কেন?
২.
ক্রিকেট বাংলাদেশে এখন শুধু একটি খেলা না, এর সঙ্গে মিশে গেছে একটি জাতির, ষোলো কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খা, আনন্দ বেদনা সবকিছু। এই জাতির হাসি কান্না হীরে পান্না সবই এখন ক্রিকেট টিমকে ঘিরে, সাকিব তামিমদের ঘিরে। এই গর্বের ধনকে আমরা কোথায় আগলে রাখবো পরম মমতায়, তা না করে আমরা তাদের পাঠিয়ে দিচ্ছি পাকিস্তানে, যেখানে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও জঙ্গী হামলার ঘটনা নিত্যনৈমিত্তিক। যেখানে এই ২০১২ সালেই জঙ্গী হামলায় মৃতের সংখ্যা প্রায় ছয় হাজার। সর্বশেষ সফরকারী শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট দল যেখানে সন্ত্রাসী হামলার শিকার। সেই ভয়ঙ্করতম বর্বর মাটিতে আমরা মুশফিক বাহিনীকে পাঠাচ্ছি!

আবারো প্রশ্ন: কেন?
৩.
বিসিবি এবং পিসিবি গলা মিলিয়ে বলছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের এই পাকিস্তান সফর নিরাপদ। সর্বোচ্চ নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিয়েছে পিসিবি।

কথা হচ্ছে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা আসলে কতটুকু 'নিরাপদ'? আজকের(২২-১২-২০১২) পত্রিকা খুললেই দেখা যাবে এক আত্মঘাতী বোমা হামলায় তাদের দেশের কোন এক মন্ত্রীসহ ৯ জন নিহত হয়েছে। বছরের পর বছর ধরে পাকিস্তানে এরকমটাই কালচার হয়ে গেছে। সর্বোচ্চ নিরাপত্তাধারী বেনজীর ভূট্টোকে তারা রক্ষা করতে পারেনি। এতো যে বীর তাদের সেনাবাহিনী, দুবছর আগে সেই সেনা দপ্তরেই হয়েছে জঙ্গী হামলা, ১০ জন নিহত হয়েছে।

পাকিস্তানের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা কাগজের দেয়ালের মতোই ঠুনকো। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের নিরাপত্তার জন্য একে যথেষ্ট মানবো কেন?

৪.
বিপদটা সেখানে আসলে আরো তীব্র। এই সংক্ষিপ্ত সফর শেষে বাংলাদেশ দল যদি নিরাপদে দেশে ফিরে আসে, সেটা হবে 'পাকিস্তানে ক্রিকেট দল পাঠানো নিরাপদ' এই সার্টিফিকেট দিয়ে আসার মতো একটা ব্যাপার। যেই সার্টিফিকেটের জন্য পিসিবি এবং পাকিস্তান সরকার এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। যেই সার্টিফিকেট দেখিয়ে পিসিবি আইসিসি এবং অন্য ক্রিকেট জাতিগুলোকে নিজেদের বর্বর ভূমিতে আমন্ত্রণ জানানোর স্বপ্ন দেখছে। হয়তো বাংলাদেশের দেওয়া এই সার্টিফিকেট দেখে অন্য দেশগুলো পাকিস্তানে দল পাঠাতে আগ্রহও দেখাবে। কিন্তু এর পর যদি কোনো দল আবার আক্রান্ত হয়, সেই দায় কি 'পাকিস্তান নিরাপদ' সার্টিফিকেট প্রদানকারী বিসিবি নেবে?

৫.
পাকিস্তানে ক্রিকেট দল পাঠানোর সঙ্গে অন্য দেশগুলোর যেখানে শুধু নিরাপত্তাই ইস্যু, বাংলাদেশ সেখানে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। পাকিস্তান আর বাংলাদেশের মধ্যে এখনো অনেক হিসাব বাকী আছে।

হিসাবের খাতাটা বছরের পর বছর ধরে বন্ধ ছিলো নানা কারনেই। কিন্তু আজ ৪১ বছর পর হলেও সেই হিসাবের খাতা আবার খুলেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সামনে আসার পর থেকে। এখন তাই নতুন করেই ভাবতে হবে। শুধু নিরাপত্তার প্রশ্নে নয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের প্রতিবাদী অবস্থানটাও এখন স্পষ্ট করতে হবে। ডি-এইট সম্মেলনে যোগ না দিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে প্রতিবাদের ধারা শুরু করেছেন বলে মনে করি, সেই পতাকা বয়ে নিয়ে যেতে হবে আমাদেরকেই। পাকিস্তানের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে বন্ধুতা দেখানোর কোনো দায় আমাদের নেই, এমনকি পাকিস্তানকে 'নিরাপদ রাষ্ট্র' প্রমাণ করার কোনো দায়ও আমাদের নেই। আমাদের দায় আছে পাকিস্তানকে বর্জন করার, সর্বক্ষেত্রে।

৬.
অতএব বিসিবির কাছে অনুরোধ, বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের পাকিস্তান সফর বাতিল করুন।