বিচার বিভাগ: সর্ষের মাঝে ভূত

Published : 22 Dec 2012, 03:01 PM
Updated : 22 Dec 2012, 03:01 PM

"বিচারকদের জীবন ও আচরন হতে হবে সন্তুদের মতো। তাঁরা থাকবেন নিষ্কাম। দয়া , অনুশোচণা ও প্রায়শ্চিত্তের মানসিকতা থাকতে হবে তাদের। তাঁদের কাজ আলো ছড়ানোর; কোন কিছুকে পুড়িয়ে ফেলার জন্য নয়।"—ইন হাইকোর্ট অব জুডিকেচার ফর রাজস্থান বনাম রমেশ চান্দ পলিওয়াল,(১৯৯৮)২ এসসিসি ৭২।

ব্যক্তিগত কথপোকথনকে কৌশলে প্রযুক্তিগত চুরির মাধ্যমে পুঁজি করে একটি বিচারকে বানচাল করা যেমন কোনো মহৎ উদ্দেশ্য নয় । আবার কৌশলটিও সংশ্লিষ্ট আইনে অপরাধ বলে স্বীকৃত। কিন্তু নিম্ন আদালতে তারিখের পর তারিখ বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ফেলে রেখে মামলার নির্ধারিত রায় না দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা, একই আসরে (সেশন) এক পুরিয়া বা এক বোতল মাদকের জামিন না দিয়ে শুধুমাত্র প্রভাবশালী বা ঘনিষ্ট আইনজীবী, সরকার দলীয়, রাষ্ট্রপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ আইনজীবীদের চেহারা দেখে, উর্ধ্বচাপে বা নগদ নারায়ণে তুষ্ট হয়ে এক হাজার পুরিয়ার আসামিকে জামিন , হত্যা মামলায় শক্ত প্রমান থাকা সত্ত্বেও জামিন, হাতে নাতে ধরা এজাহার জব্দতালিকা নামীয়, হাকিমের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়া জাল টাকা প্রস্তুতকারী দুর্ধর্ষ অপরাধীদের, শীর্ষ তস্কর-সন্ত্রাসীদের জামিন দেয়া, দেশের অর্থনীতির জন্য ক্ষতিকর টেলিফোন সরঞ্জাম(ভিওআইপি) ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক কারণ ছাড়া জামিন দেয়া, সম্পত্তি বা পদের উপর যেখানে সরকারের এবং জনগনের স্বার্থ রয়েছে সে স্বার্থের বিরুদ্ধে যৌক্তিক ও আইনি কারণ ছাড়াই লেনদেনের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞার আদেশ দেয়া, বছরের পর বছর দেওয়ানি মামলার বিবাদির বিরুদ্ধে সমন না পাঠিয়ে ঝুলিয়ে রাখা, উপরের নির্দেশে শীর্ষ সন্ত্রাসীকে, হেরোইন পাচারকারীকেও রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলার আসামি বলে মামলা প্রত্যাহারের আবেদন মঞ্জুর করা, পুলিশের অবৈধ খায়েস মেটাতে না পেরে ফেঁসে যাওয়া নিরপরাধীর পক্ষে কোনো প্রতিকার না দেয়া, প্রকাশ্য আদালতে এক রকম ঘোষণা দিয়ে খাসকামরায় গিয়ে আবার সে আদেশ পরিবর্তন করা, আইন ভেঙ্গে অবৈধভাবে দেওয়ানি-ফৌজদারি আপিল, রিভিশন আবেদন মঞ্জুর করা এমনকি আসামিদের পক্ষ নিয়ে বিচারক নিজেই রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের ফিরিয়ে দেয়ার ঘটনা তথ্য প্রমানসহ দৈনিক কাগজে বার বার বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছে। খাসকামরায় ও বাড়িতে মামলার তদবীরকারকদের প্রশ্রয় দেয়া, সুবিধাজনক জেলা আদালতে বদলির তদবীরে সংশ্লিষ্ট কোনো কোনো সরকারী কর্তা ব্যক্তির বাড়িতে ধর্না দেয়া, বেসরকারী একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদানে ব্যাপৃত থাকার কারণে বিচার কাজে কম সময় দেয়া, যথাসময়ে আদালতে না বসে বিচারপ্রার্থী-আইনজীবীদের মূল্যবান শ্রম-ঘন্টার অপচয় করা এগুলো তো আদালতের, নানা পর্যায়ের বিচারকদের নৈমিত্তিক চিত্র। সবাই দেখেন, সবাই সব কিছুই বুঝেন। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। যদিও এর মধ্যেই ব্যতিক্রমী বিচারকদের ব্যতিক্রমী কর্তব্যপরায়ণতাও রয়েছে। আর এসব ঘটনায় আইন ও বিচার বিভাগের আমরা সবাই দায়ী। কেননা এ সব ঘটনার বিরুদ্ধে আমি, আমরা অনেকেই নিরব প্রতিবাদ করি। সরব হই না। অনেক সময় আবার আদালত অবমাননার ভয় থাকে।

প্রতি বছরই প্রধান বিচারপতি মহোদয় এসব ঘটনা উল্লেখ করে বিচারকদের সতর্ক করে দেন। গত বুধবারও সুপ্রিম কোর্টের অ্যানেক্স ভবন মিলনায়তনে জেলা জজ, মহানগর দায়রা জজ ও জেলা জজ পদ মর্যাদার বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সবাইকে বিচারে যত্নবান হতে আহবান করেন বর্তমান প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন। আশার বানীও দেন তিনি। বলেন, "বিচার বিভাগ হচ্ছে জনগণের আস্থা ও শেষ আশ্রয় স্থল । আমি মনে করি এখনো বিচার বিভাগের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। সেই আস্থাকে ভূলুন্ঠিত হতে দেয়া যায় না।" তিনি বলেন, "দেখা যায় যে সুপ্রিম কোর্ট থেকে অধস্তন আদালতগুলোতে যখন কোনো সমন , নোটিশ জারির জন্য পাঠানো হয় , সেগুলো যথাসময়ে জারি হয়ে প্রতিবেদনসহ ফেরত আসে না। এমনকি তাগিদ দেওয়ার পরও নথি না পাঠানো উচ্চ আদালতে মামলাজটের অন্যতম কারণ। তাই এ ব্যাপারে জেলা জজদের ব্যক্তিগত তদারকি বাড়াতে হবে। যেসব কর্মচারী দায়িত্বে অবহেলা করবেন , তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এতে যেন অন্যথা না হয়।" ১৭০ জন বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।

ওই অনুষ্ঠানটির কথা মনে রেখেই এ আলোচনার অবতারণা। অনুষ্ঠানে জেলা জজ বা এই শ্রেণীর বিচারকদের (সব বিচারক নন) নিজেদের দুর্নীতি বা অনিয়মের কথা বলেননি। আর যদি বিচারকদের দুর্নীতি অনিয়মের কথা তুলতেনও তাহলেও এ আলোচনাটি আসবে। কারন প্রধান বিচারপতি এবং সুপ্রীম কোর্ট রেজিষ্ট্রারের কাছে প্রতি বছর বিচারকদের দুর্নীতি , অনিয়মের বিষয়ে বিচার চেয়ে দরখাস্ত জমা পড়ে। সেগুলোর আদৌ তদন্ত হয় কিনা, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয় কিনা সে বিষয়ে জানা যায় না।

আর আমাদের আইনমন্ত্রী, আইন প্রতিমন্ত্রী মহোদয় বিচার প্রশিক্ষণ ইনষ্টিটিউটে বিচারকদের প্রশিক্ষণ উদ্বোধনের সময়ে বিভিন্ন সেমিনার, সভায় দেওয়ানী মামলার জট নিরসনের জন্য বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির কথা বলে থাকেন । এ বিষয়ে আইনও প্রণীত হয়েছে। কিন্তু জন্মের পর ওই শিশুটির এখনো ঘুম ভাঙ্গেনি। আর কেউ চেষ্টাও করছেন না ওই ঘুম ভাঙানোর। মন্ত্রী বলেন, আগে দেওয়ানী মামলায় বিবাদীদের উপর জারী করা সমন ফেরতের (সার্ভিস রির্টান) তারিখ নির্ধারিত থাকতো বছরের পর বছর । আর এ কারনে মামলার বিচারও ঝুলে থাকতো দিনের পর দিন। তাদের উদ্যোগে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির আইন প্রণীত হওয়ার পর বিবাদিদের হাতে সমন জারী হয়ে তা ফেরত আসতে এখন সময় নেয় ৩/৪ মাস। কিন্তু এ বিধান কোন বিচারক মেনে চলেন বলে মনে হয় না। ঢাকার আদালতে একটি দুটি নয় হাজার হাজার দেওয়ানী মামলার উদাহরণ রয়েছে যেগুলোর সমন তাড়াতাড়ি ফেরত আসছে না এবং বিচারকগণ বছরের পর বছর সমন ফেরতের জন্য দিন ধার্য করে যাচ্ছেন। দেওয়ানী কার্যবিধির ৮৯ ধারা (সম্প্রতি পুনরুজ্জীবিত) অর্থাৎ বাদি-বিবাদীর আপোষের ধারাটি নিরানব্বই ভাগই অকার্যকর, নিষ্ফলা হয়ে পড়ে থাকে। এর বড় কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়, বিচারকদের উদাসীনতাকেও। যেখানে বেশি বেশি আপোষের সুযোগ থাকার কথা সেই অর্থ ঋণ আদালতে অর্থ ঋণের মামলায়ও এ বিষয়ে তো কেউ কথা বলেন না। ভুগতে হয় আমাদের মতো অতিসাধারন, অভাজন, অনুল্লেখিত আইনজীবী আর পাপী বিচারপ্রার্থীদের। মন্ত্রীগন ফৌজদারি মামলা নিষ্পত্তিতেও অতি শীঘ্রই বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান প্রণীত হবে বলে কথা বলেন। কিন্তু ধর্মগ্রন্থে পড়ে থাকে ধর্মের বাণী, আইনগ্রন্থে পড়ে থাকে আইনের বাণী, সারা দিন বড় বড় প্রতিজ্ঞা করি, প্রতিশ্রুতি দেই ভালো কাজ করার, সেমিনারে সভায় আমরা বক্তৃতা দিই , কথার ফুলঝুড়িতে স্তাবকবৃন্দের বাহবা কুড়াই, কথার মোক্ষম রসায়নে গণমাধ্যমের সামনে নিজেদের কীর্তি জাহির করি। যেসব অশুভ কর্মের বিপরীতে দাড়ানোর কথা কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দাঁড়াই তাদেরই পক্ষে। আত্মপ্রবঞ্চনায় ডুবে থাকি। বিচার বিভাগ স্বাধীন বলে মিথ্যা বাগাড়ম্বর করি। আইন, বিচার বিভাগের অধিকাংশ কর্মকর্তাও এর বাইরের কিছু নয়।

প্রকাশ বিশ্বাস:বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক।