মৃত্যু ও ঠাট্টা

Published : 5 Jan 2016, 02:53 PM
Updated : 17 Dec 2012, 04:33 PM

কেভিন কার্টারের নামটা সবার পরিচিত না হলেও সেই দুর্ভিক্ষের ছবিটি নিশ্চয়ই মনে আছে। সুদানের আয়ুদ'র দুর্ভিক্ষতাড়িত এক কালো শিশু কন্যার ছবি। হামাগুড়ি দিয়ে আগাচ্ছে আর পেছনে শকুন অপেক্ষা করছে শিশুটির মৃত্যুর। পুলিৎজার জেতা এই ছবি কেভিন কার্টারের। কেভিন ছবিটি তুলে বিশ্ব পরিচিতি পেয়েছিলেন ঠিকই, তবে আত্মহত্যা করেছিলেন ৩ মাস পরই। অনেক সংকটের ভেতর সবচেয়ে বড় সংকট ছিল মানবিক দায়বোধ এড়ানোর অনুশোচনা। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনি শকুন ও শিশুর মধ্যে প্রত্যাশিত নৈকট্য পেতে প্রায় ২০ মিনিট সময় নিয়েছেন অর্থাৎ ইচ্ছে করলেই বাঁচাতে পারতেন মেয়েটিকে কিংবা ছবি তুলেই চলে এসেছেন, এরপর কী হয়েছিল? কেভিন কোন প্রশ্নেরই উত্তর দিতে পারেন নি। একপর্যায়ে কেভিন অনুশোচনার কথা স্বীকার করেছেন কিন্তু নিজেই নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি।

বিশ্বজিৎ-শোক প্রথম দিনে অনেকটাই প্রদর্শণীর বিষয় এবং পরের দিনেই টি-টুয়েন্টির উত্তেজনায় পিং পং টেবিল টেনিসের বলে রুপান্তরিত হয়েছে। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই যে দেশে ১১১ জন মানুষ নিহত হওয়ার ঘটনা দু'সপ্তাহের ব্যবধানে পুরনো স্মৃতির খাতায় চলে যায়, সেখানে এক বিশ্বজিৎ!

৯ ডিসেম্বর বিশ্বজিৎ নিহত হওয়ার ঘটনায় মন্ত্রীদের হাস্যকর বিবৃতি প্রসঙ্গে প্রশ্ন তোলার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। কিন্তু সুশীল সমাজ, সাংবাদিক ও প্রশাষনকে কিছু প্রশ্ন এড়ানো যাচ্ছে না। সুশীল সমাজ, আপনারা যারা মিয়ানমার সীমান্ত, শরনার্থী সমস্যা, রামুর ঘটনা বা তাজরিন গার্মেন্টস দুর্ঘটনায় সাময়িক হলেও প্রতিবাদ করতে নেমেছিলেন তারা কী ভূমিকা রাখলেন বিশ্বজিৎ হত্যার প্রতিবাদে? নাকি মন্ত্রী ও নেতাকর্মীদের মত আপনাদের কাছেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা ? তাহলে জেনে রাখুন আরো এমন শত শত বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে চলেছে নির্বাচন পর্যন্ত।

প্রশাসন, সেদিনতো আপনারা বিশ্বজিতের কয়েক গজের ভেতরেই ছিলেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছে, যে দোতলা ক্লিনিকে তাকে চাপাতি দিয়ে কোপানো হচ্ছিল তার নিচে পুলিশ এবং কয়েক গজ দূরের পেট্রোল পাম্পের কাছে ছিলেন নিরাপত্তারক্ষীরা। কিছু দেখেন নি আপনারা? হত্যাকারিরা সরকার সমর্থিত দলের ব্যানার নিয়ে এসেছিল বলে? সেই ব্যানারের প্রথম দিকেই দাড়িয়েছিল তারা। আপনাদের উপেক্ষা বা উপরওয়ালাদের নির্দেশে দর্জি দোকানি, পাড়ার ছেলেদের সাথে ক্রিকেট খেলা ছেলেটা প্রথমে হয়ে গেল শিবিরকর্মী তারপর নিহত বিশ্বজিৎ? প্রশাসনের চরিত্র হচ্ছে রাস্তার পাশের বিলবোর্ড, পোস্টারের মত বদলে যাওয়ার চরিত্র। একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন- দু' ধরনের পোস্টার থাকে, অত নং ওয়ার্ডবাসীর পক্ষ থেকে অমুক ভাইয়ের শুভেচ্ছা নেত্রীকে। অন্যটা হচ্ছে, তমুক ভাইয়ের নিঃশর্ত মুক্তি চাই। কথাগুলো একই থাকে; ক্ষমতা পাল্টালে শুধু নামগুলো বদলায়। প্রশাসনও তাই। সরকারি দলের কর্মী দেখলেই সানগ্লাস পরে দাড়িয়ে থাকবে আর বিরোধী পক্ষকে এক হাত নিবে বা তাদের হাতে হেনস্তা হবে। ঘটনা কিন্তু একই। মাঝখানে পরে থাকে শুধু মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত বিশ্বজিৎরা। সেদিনের দৃশ্যপটে উপস্থিত প্রশাসন, সাংবাদিক ও সাধারণ জনতার মধ্যে বিশ্বজিৎকে বাচাঁনোর দায়িত্বটা কাদের ছিল প্রথম?

যে কারণে কেভিন কার্টারকে দিয়ে শুরু করেছিলাম সে প্রসঙ্গে আসি। ঘটনার সময় কতজন সাংবাদিক ও ক্যামেরামান উপস্থিত ছিলেন? জানি, আপনাদের দায়িত্ব সত্যি ঘটনার পর্যবেক্ষণ এবং তা প্রচার করে মানুষকে জানানো। এও জানি যে বিশ্বজিৎকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া অফিসিয়াল ডিউটিতে পরে না কিন্তু মানবিক দায়িত্বে? সত্যি যে বিশ্বজিৎকে বাঁচানোর বিষয়ে পুলিশি কেস, রাজনৈতিক পরিচিতির ঝামেলা, এমনকি নিজেদের দুর্ঘটনার আশংকাকেও উপেক্ষা করা যায়না কিন্তু তারপর? কেউ কি পারতেন না আপনাদের অফিসের গাড়ি দিয়ে ছেলেটাকে অন্তত হাসপাতালে পৌঁছে দিতে? যেটা পেরেছিল একজন রিকশাচালক।

এরপরের দায়িত্বটুকু কাদের? একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বিশ্বজিৎ নিহত হওয়ার পর থেকে কোন ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টও তো চোখে পড়েনি। প্রতিটি সংবাদ মাধ্যমে ডেজ ইভেন্ট হিসেবেই বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড কাভার করা হচ্ছে। বরাবরই তাই হয়। রুণী-সাগর হত্যাকাণ্ড, ইলিয়াস-সুরঞ্জিত-রোহিঙ্গা সমস্যা-রামু এমনকি তাজরীন গার্মেন্টসের ঘটনাতেও। কিছু প্রশ্ন নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে করতে চাই। সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনারা সেদিন যারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন, কেউ কি পুলিশ ডেকেছিলেন ( জানি এর ফলাফলও শূণ্যই), মন্ত্রী বলেছিলেন ৮ জনকে আটক করা হয়েছে, একই সময় সূত্রাপুর থানা পুলিশ বললো কাউকে আটক করা হয়নি। দ্বিতীয়বার মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছেন, কেন আটকের কথা বললো? যদি সত্যি তাই হবে তাহলে পুলিশ কেন মিথ্যে বলছে? ১৪ ডিসেম্বর সূত্রাপুর থানার ওসিকে কেন বদলি করা হয়েছে এ প্রশ্নটা কোন সাংবাদিক তুলেছেন? আটককৃতদের মিডিয়ার সামনে আমরা প্রথম দেখলাম ১৩ তারিখ অর্থাৎ গ্রেপ্তারের ৩ দিন পর। তাও ৩ জনকে। এই ৩ দিনে সাংবাদিকরা কোন প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন কেন মিডিয়ার সামনে আনা হচ্ছে না? আপনারা যদি মন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে সঠিক জবাব না পান তাহলে সেটা নিয়েই প্রতিবেদন করতেন! মন্ত্রী দাবি করছেন হত্যাকারিরা কেউ ছাত্রলীগের সক্রিয় কর্মী নয় কিন্তু প্রত্যেকেরই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের সাথে জড়িত থাকার প্রমান পাওয়া গেলো। মন্ত্রীকে কেউ তার স্টেটমেন্ট সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছেন ?

হত্যাকাণ্ডের ছবি বিষয়ে বলি। হত্যাকাণ্ডের ফুটেজ যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে তাতে পাবলিক সেন্টিমেন্ট পাওয়া গেছে এবং নিউজের কাটতি বেড়েছে। কেউ কেউ এক্সক্লুসিভ পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে নিজের সাংবাদিকতার বিজয়ী মুকুটে আরো একটি পালক গুজতে পেরেছেন কিন্তু একবার কি ভেবেছেন যে ছেলেটা ক্রিকেটে বাংলাদেশ জেতার আনন্দে আগের রাতে বিশ্বজিতের হাত থেকে পতাকা নিয়ে উড়িয়েছে তার মানসিক অবস্থা কী হতে পারে? শরীয়তপুরে বিশ্বজিতের সাথে যারা ঝাপিয়ে পুকুরে নেমে শৈশব পার করেছেন তাদের অবস্থা? পরিবারের কথাতো বাদই দিলাম! এক ফটো সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই ফুটেজ কি এভাবে দেখানো উচিত? সে বলেছে হ্যাঁ, মানুষের ভেতর তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে আরো অনেক অনেক বেশি দেখানো উচিত, আমার প্রশ্ন, কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হবে মানুষের মধ্যে? মানুষতো সেদিন হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সামনেই ছিল। কী করতে পারে মানুষ ধারালো অস্ত্রের মুখে আর দুর্বিনীত ক্ষমতার কাছে পরাস্ত হওয়া ছাড়া? টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ছবি দেখেছেন সবাই, মার্কিন গণমাধ্যম কি বিধ্বস্ত ভবনের ভেতরের ছবি প্রকাশ করেছে? নরওয়েতে ব্রেইভিকের হত্যাকাণ্ড বা যদি শুক্রবার কানেকটিকাট স্কুলে ২৮ জন নিহত হওয়ার কথা বলি, একটা মৃতদেহের ছবি পাবলিশ হয়েছে?

যুবলীগ কর্মীদের দেয়া আগুনে শাহবাগ মোড়ে ১১ জন পুড়ে মারা গিয়েছিল। কতদিন ধরে আগুনের ছবি দেখানো হয়েছিল? এমনকি অভিযুক্ত বর্তমান সরকারের একজন স্থায়ী কমিটির সদস্যকে ইন্টারোগেশনে নেয়ার পর স্বীকারও করেছিলেন কৃতকর্মের কথা। কী হয়েছে ? অভিযুক্তদের বিচার হয়েছে? বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের ৮ দিনের রিমাণ্ড শেষ হতে হতে নতুন হরতাল এবং নতুন সহিংস কোন ঘটনায় চাপা পরে যাবে বিশ্বজিৎ। সাংবাদিকেরাও তখন ছুটবেন নতুন ছবি নতুন খবরের পেছনে। কবে যে এইসব হত্যাকারীরা কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে যাবে জানবেওনা মানুষ। বছরখানেক পর শুনবেন, বিশ্বজিতের পরিবার হুমকির মুখে। ২০ বছর পর দেখবেন এই হত্যাকারীদের কেউ কেউ মন্ত্রী মিনিষ্টার হয়ে গেছে। বুদ্ধিজীবি দিবসের দিনেইতো ছাড়া পেলো হত্যাসহ ১২ মামলার দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী 'বিকাশ'। অতএব বলি কী, বিশ্বজিত নিহত হওয়ার দৃশ্যটার আর প্রদর্শনী করবেন না বরং সম্ভব হলে হত্যাকারীদের ছবি বারবার দেখান। একযুগের বেশি সময় ধরে এ দেশে স্যাটেলাইট চ্যানেল নির্ভর হলেও এখন পর্যন্ত কোন নীতি নির্ধারণী তৈরি হয়নি। তবে ১৯৭৪ সালের ১১ এর (বি) ধারা অনুযায়ী প্রণীত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা এবং সাংবাদিকদের জন্য অনুসরণীয় যে নীতিমালা যেটা ২০০২ সালে সংশোধিত হয়েছে এর কয়েকটি নিয়মের মধ্যে একটি, 'জনগণকে আকর্ষণ করে অথচ জনস্বার্থ পরিপন্থী চাঞ্চল্যকর মুখরোচক কাহিনীর মাধ্যমে পত্রিকার কাটতির স্বার্থে রুচিহীন ও অশালীন সংবাদ ও অনুরূপ ছবি পরিবেশন না করা।'
যদি বলি আমাদের সংবাদ প্রচারের পেছনে থাকে শুধুই বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য। সেখানে কোন মানবিকতা নেই, তদন্ত নেই, ডেজ ইভেন্ট ছাড়া কোন ফলোআপ নেই, ক্ষমতাসীন নেতা-কর্মীদের মত সংবাদ কর্মীদের কাজের ধরণেই বিশ্বজিৎদের মৃত্যৃও তাই পরিণত হয় ঠাট্টায়, ভুল বললাম?

কেভিন, আফসোস হচ্ছে আপনার জন্য। ভুল সময়ের মানুষ ছিলেন। এই সময়ে ছবিটি তুলে পাঠিয়ে দিলে পুলিৎজার পেয়ে যেতেন, হয়তো আপনার ছবি দেখে নোবেল কমিটি ভাবতো ফটোগ্রাফিতে নোবেল দেয়া উচিত কিন্তু কেউ মানবিক দায়িত্ব বোধ নিয়ে প্রশই তুলতো না আর আপনিও অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে আত্মহত্যা করতেন না।
১৬ ডিসেম্বর ২০১২

সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম:সাংবাদিক ও লেখক।
সাদিয়া মাহ্জাবীন ইমাম
সাংবাদিক ও লেখক