আমার নাসিম মামা

মোস্তফা শিবলী
Published : 16 Dec 2012, 04:42 PM
Updated : 16 Dec 2012, 04:42 PM

যা হয়েছে, হয়তো ভালোই হয়েছে। আমার মামা সারাদিন বইপত্র, নথি নাড়াচাড়া করতেন। সাক্ষী-সাবুদদের জেরার রেকর্ড ঘাঁটতেন। প্রতিটি প্রসিডিংসের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতেন। ট্রায়ালের শুরু থেকে প্রতিদিনের ঘটনার রেকর্ড ছিল তাঁর নখদর্পণে।

চাইতেন যেন বিশ্বমানের ট্রায়াল হয়। যেন খুব ফেয়ার হয় ট্রায়ালটি। দেশের কোটি-কোটি মানুষের প্রাণের দাবি ছিল যেন যুদ্ধপরাধীদের খুব দ্রুত বিচার হয়। কিন্তু মামা প্রসেসের ব্যাপারে ছিলেন সিরিয়াস। নিয়ম ভেঙ্গে কোনোকিছু করতে চাননি। আর আসামীদের ব্যাপারে "ইনোসেন্ট আনটিল প্রুভেন গিল্টি"-এ এথিক্সে বিশ্বাসী ছিলেন। যত আসামীকে তাঁর এজলাসে আনা হয়েছে, তাদের প্রত্যেকের প্রতি যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেখিয়েছেন তিনি। ভালো ব্যবহার করেছেন সবার সঙ্গে। বিধি ভেঙ্গে তারা কথা বলতে চাইলে অন্যরা বাধা দিলেও উনি সুযোগ করে দিয়েছেন। আসামীপক্ষের জুনিয়র উকিলদের অসৌজন্যমূলক আচরণ সহ্য করেছেন দিনের পরদিন। পরে তারাই সিনিয়রদের নিয়ে তাঁর কাছে এসে মাফ চেয়েছেন। সাঈদী, সাকাচৌ-রা শুরুতে তাঁর ব্যাপারে আপত্তি জানালেও পরবর্তীতে তাঁর উষ্ণ ও মিষ্টি ব্যবহারের জন্য তাঁর পৌরহিত্য মেনে নিয়েছিলেন। সাম্প্রতিক এক প্রসিডিং-এর সময় মামা কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সদাউত্তেজিত সাকাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন- 'আপনি কি আমাদের ট্রায়ালের এ যাবতকার কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট?' সাকা চিৎকার করে হাত তুলে বলেছিলেন- ১০০% সন্তুষ্ট!

মামা আমার সহজ-সরল, তবে একটু রাগী। কোনোদিন তাঁকে অন্যায় করতে দেখিনি। আর্থিক, নৈতিক, আইনগত বিষয়ে তিনি সীমাহীন সৎ। ইডিয়োলজিকালি যারা তার ১০০% অপোজিট- সে জামাত-বিএনপির ঘাগু আইনজীবীদেরও দেখেছি তাঁর সততার প্রশ্নে তারা চুপ মেরে যান, মাথা নিচু করে ফেলেন। আমার প্রয়াত মা তাঁর এ ছোট ভাইটিকে ডাকতেন 'মিঃ নো।' কারণ যেকোনো নৈতিকতার বিষয়ে তিনি আপোষহীন; সামান্যতম এদিক-ওদিক দেখলেই 'নো' বলে গর্জন করে উঠেন। আর সবাই যখন ২-১% এদিক-ওদিক মেনে নেয়, নাসিম মামা ঘাড় ত্যাড়া করে থাকেন। কোনোরকম ডেভিয়েশন মেনে নেন না। স্বাধীনতার পর ছাত্রনেতারা যখন গা ভাসিয়ে দিল, তখন হাতেগোনা কিছু ছেলে সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা শুরু করে দিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন আমার নাসিম মামা।

এসএম হলে ডাকসু নির্বাচনে তৎকালীন সরকার-সমর্থক ছাত্রলীগের শক্তির বিরুদ্ধে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রটি নির্বাচন করে জিএস পদে জয়ী হয়েছিল। এরপর যখন শুরু হয়ে গেল ক্যাম্পাসে অস্ত্রের ঝনঝনানি, দু'পক্ষের নেতাদের রক্তপাত, জেলজুলুম ফলোড বাই সামরিক শাসন– তখন নাসিম মামা পড়াশুনা শেষ করে সরকারি চাকরিতে না গিয়ে যোগ দিলেন আইনকর্মী হিসেবে আদালতে। বাঘা-বাঘা সিনিয়র উকিলদের অধীনে শুরু করলেন নতুন সংগ্রাম; আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। পরবর্তী দীর্ঘ ২৫/৩০ বছর সুপ্রিম কোর্টে রাগী, প্রতিবাদী মানবাধিকার আইনজীবী হিসেবে নিরলস কাজ করে গেছেন। বছরের পর বছর কারাগারে আটক রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য হেবিয়াস কার্পাস করতেন ডঃ কামাল হোসেন বা অ্যাডভোকেট আমিনুল হকদের সঙ্গে বিনা পয়সায়। সামান্য ফি নিয়ে লড়াই করতেন বিনা বিচারে আটক সংগ্রামী রাজনৈতিক কর্মী, আদিবাসী পাহাড়িদের মুক্তির জন্য। অনেক সতীর্থ আইনজীবীর ততদিনে বাড়ি-গাড়ি হয়ে গেছে। মামা বৈষয়িক দিকটা গোছানোর চেষ্টাও করেননি। মামার বন্ধুরা বলতেন, উনি খুব ব্রিলিয়ান্ট এবং অনেস্ট। সব জাজরা উনাকে পছন্দ করেন। উনি যেকোনো সময় হাইকোর্টের জাস্টিস হয়ে যাবেন।

চিফ জাস্টিসের তালিকায় কয়েকবার নাম থাকলেও প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গিয়ে আটকে যেত। বিএনপির আমলে বলা হত, উনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক। অতএব আওয়ামী-ঘেঁষা। উনাকে নেয়া যাবে না। আর আওয়ামী নেতারা তাদের আমলে বলত, উনি তো জাসদ করতেন ছাত্রজীবনে। বিচারপতি হলে কারো কথা শুনবেন না। অতএব তাঁকে নিয়ে লাভ কী? এভাবে কয়েক বছর বাদ পড়তে পড়তে ২০০১ এ গিয়ে অস্থায়ী বিচারপতি হলেন। দুবছর পর বিএনপি এসে তাঁকেসহ দশজনকে চিফ জাস্টিসের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও স্থায়ী না করে বাদ দিলেন। নাসিম মামারা দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বিএনপি সরকারের এ সিন্ধান্তকে বেআইনি প্রমাণ করে আবার হাইকোর্টে স্থায়ী বিচারপতি হিসেবে ফিরে এলেন ২০০৯ এর শুরুতে।

পরে মাত্র এক বছর তিনি ছিলেন হাইকোর্টে। এ সময় হাইকোর্টের যেকোনো আইনজীবীর কাছে মামার নাম করলেই বলতেন, উনার মতো সৎ, ভালো জাস্টিস খুব কম আছেন। উনি সবার খুব প্রিয়। কুইক এন্ড জাস্ট ডিসপোজালের ক্ষেত্রে উনার জুড়ি মেলা ভার। এক বছর পরই ট্রাইবুন্যাল গঠিত হলে নাসিম মামাকে চেয়ারম্যান করা হল। আমি খুব উল্লসিত হলাম। যুদ্ধাপরাধী ট্রাইবুন্যালে এমন লোকই দরকার যার স্পিরিট থাকবে বিচার করার কিন্তু পদ্ধতি বা প্রসেসে যিনি উঁচুমান বজায় রাখতে পারবেন। ট্রাইবুন্যাল গঠনের পর তাঁর প্রথম এবং শেষ কমেন্টে বলেছিলেন; ''যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার সময় আমার চোখের সামনে থাকবে আদালতে উত্থাপিত ফ্যাক্টস ও এভিডেন্স।'' এরকম এক ব্যক্তিকে বিচারকের জায়গায় বসানোয় দেশে সবাই খুশি হয়েছিলেন। যখন জামায়াতীরা তাঁর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছিল তখন কোনো এক আইনজীবী মিডিয়াতে বলেছিলেন, 'জামায়াত, বিএনপি কী চায়? তারা কি ট্রাইবুন্যালে একজন রাজাকারকে বসালে খুশি হবে?'

বিশ্বমানের ট্রায়াল চাইতে গিয়ে, ইন্টারনেটে ডঃ জিয়ার সঙ্গে বিচারের নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন। কিন্তু কোথাও কি একবারও বলেছেন, রায় কী হবে? একবারও কি তিনি রায় নিয়ে আলোচনা করেছেন? করেননি। উনারা দুজনেই রায়ের আকার, আকৃতি, উপস্থাপনা ও বিভিন্ন রেফারেন্স নিয়ে আলোচনা করেছেন। কীভাবে রায়কে আন্তজার্তিকমানের করে তৈরি করা যায় তা নিয়ে কথা হযেছে। যেন বিশ্বের চোখে বাংলাদেশ প্রমাণ করতে পারে যে, ১৯৭১ এ সংঘটিত অপরাধের বিচার করার ক্ষমতা, অধিকার ও যোগ্যতা বাংলাদেশেরই আছে। আমাদের জাতিসংঘ, আমেরিকা, ভারত বা সৌদি আরবের কাছে যেতে হবে না। আমরা আমাদের আইনে আমাদের দেশীয় বিচারকদের দিয়েই এ বিচার সম্পন্ন করতে পারব।

যারা ওই পূর্ণাঙ্গ কথোপকথন পড়েছেন, তারা প্রত্যেকে স্বীকার করেছেন, কোথাও কোন অসৎ উদ্দেশ্য চোখে পড়েনি। কোথাও রায় কী হবে তা নিয়ে তিনি আলোচনা করেননি। তারপরও মানুষ না পড়েই সমালোচনা করে। না পড়েই বলে ওঠে তিনি অন্যায় করেছেন, আইন ভেঙ্গেছেন। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মধ্যে অনুপ্রবেশ করে তাঁর ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য এবং তা ছাপানোর জন্য 'আমার দেশ' পত্রিকাকে যারা ধিক্কার দিল না; তাদের কেবল দুটি কথা বলতে চাই:

১. আমার মামা আপাদমস্তক সৎ এবং ট্রাইবুন্যালে থাকাকালীন তিনি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে, কারও চাপের কাছে নতি স্বীকার করে কোনো ধরনের নৈতিক বা আইনগত অন্যায় করেননি।

২. যারা তাঁর এ একান্ত ব্যক্তিগত আলাপচারিতা আড়ি পেতে রেকর্ড করেছেন এবং অন্যায় কিছু করেননি জেনেও তাঁর ক্ষতি করার জন্য তা ছেপেছেন– তারা প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধাপরাধের বিচার চান না, ছলে-বলে-কৌশলে এর বিলম্ব ঘটাতে চান এবং কারও প্রাইভেসিতে হস্তক্ষেপে সমর্থন দিয়ে তারা দেশে নতুন এক নোংরামিকে প্রশ্রয় দিলেন যার ছোবল একদিন তাদের গায়েও লাগতে পারে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রায় শত বছর আগের সতর্কবাণী তাদের জন্য তুলে দিলাম; হে মোর দূর্ভাগা দেশ/ যাদের করেছ তুমি অপমান/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান।

মোস্তফা শিবলী: লেখক আর্ন্তজাতিক অপরাধ আদালত-১ এর পদত্যাগী চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম-এর ভাগ্নে, পেশায় ব্যবসায়ী।