স্বাধীনতার স্বপ্ন: আরো পথ পাড়ি দিতে হবে

শাহরিয়ার কবীরশাহরিয়ার কবীর
Published : 15 Dec 2012, 05:13 PM
Updated : 15 Dec 2012, 05:13 PM

তরুণরাই যেকোনো দেশে যেকোনো সমাজে যেকোনো সময়ে যেকোনো বিপ্লবে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে যদি তাকাই তবে সেখানেও একই চিত্র দেখা যাবে। শতকরা নব্বই ভাগ মুক্তিযোদ্ধার বয়স ছিল পঁচিশের নিচে। তবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে এটিও একটি লক্ষ্যণীয় বিষয় ছিল যে, এ যুদ্ধের নেতৃত্ব যাঁরা দিয়েছিলেন তাঁরাও ছিলেন তুলনামূলকভাবে নবীন। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল গঠিত অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতি, এমনকী মুক্তিযুদ্ধের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়সও তখন ছিল পঞ্চাশের নিচে। আমার ব্যক্তিগত কথা যদি বলি, আমি নিজেও তখন কুড়ি পেরুইনি। আমার মতো কুড়ি না-পেরুনো অসংখ্য তরুণ দেশের টানে সেদিন যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার পরপরই মুক্তিযুদ্ধের এ প্রজন্মের খানিকটা স্বপ্নভঙ্গ হয়। কারণ এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হল অস্ত্রসমর্পণ করতে। তারা যেন স্কুলে-কলেজে-কর্মক্ষেত্রে ফিরে যান সে আহ্বান জানানো হল। কিন্তু মুক্তিসংগ্রামের বিরোধীতাকারী রাজাকাররা অস্ত্রসমর্পণ করেনি। পাকিস্তানের এক লেখক 'আলবদরের ইতিহাস' নামে একটি বই লিখেছেন, সেখানে এক আলবদর কমান্ডারের সাক্ষাৎকার আছে, কমান্ডার বলছে, 'একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে, আমরা কিন্তু করিনি। অস্ত্রও জমা দিইনি।' সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রাইব্যুনালে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে আমি এ বইয়ের কথাগুলো উল্লেখ করেছি।

ফলে একাত্তরের পর দেশগড়ার ক্ষেত্রে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছিল। পাকিস্তান আমলের প্রশাসন তখনো এখানে বহাল ছিল। মুজিবনগর সরকারের প্রশাসনের লোকেরা সেভাবে ছিলেন না, থাকলেও এঁরা ছিলেন একেবারে অনুল্লেখযোগ্য। এর ফলে পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর প্রশাসনের 'পাকিস্তানিকরণ' হয়ে গিয়েছিল দ্রুত। এর পাশাপাশি, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। জেনারেল জিয়া ক্ষমতায় আসার পর দালাল আইন বাতিল করাসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া বাহাত্তরের সংবিধানে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগও তিনি করে দিলেন। এভাবেই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের 'বিস্মৃতিকরণ' ও 'বিকৃতিকরণ' শুরু হল।

একটা সময় আমরা দেখেছি, ইতিহাসের পাঠ্যবইতে 'হানাদার-বাহিনী' শব্দবন্ধটি ব্যবহৃত হচ্ছে, 'পাকিস্তানি-বাহিনী' বলা হচ্ছে না। ভারতীয় সেনাবাহিনী না বলে 'মিত্রবাহিনী' লেখা হচ্ছে। সংবিধানের মুখবন্ধ থেকে 'স্বাধীনতা-সংগ্রাম' শব্দবন্ধ বাদ দিয়ে 'স্বাধীনতাযুদ্ধ' শব্দবন্ধ যুক্ত করা হল। যেন একাত্তরে আমাদের মুক্তিসংগ্রাম একটি 'নয় মাসের যুদ্ধ' মাত্র ছিল, এটা স্বাধীনতালাভের জন্য একটি জাতির তীব্র আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিনিধিত্ব করে না।

এভাবে গোটা দেশে পাকিস্তানিকরণের একটা প্রক্রিয়া সেসময় আমরা লক্ষ্য করেছি। জেনারেল জিয়া তরুণ প্রজন্মকে রাজনীতিতে আগ্রহী করতে চেয়েছিলেন, খুবই ভালো কথা। কিন্তু তিনি সত্তর দশকের শেষদিকে 'হিযবুল বাহার' নামের জাহাজে করে যে তরুণদের নিয়ে প্রমোদভ্রমণে বেরিয়েছিলেন, তাদের সবাই কিন্তু পরে রাজনীতিতে 'টপ টেরর' হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। জিয়া একটা কথা প্রায়ই বলতেন, 'মানি ইজ নো প্রবলেম।' এভাবে তরুণ প্রজন্মকে কলুষিত, আদর্শবর্জিত ও দেশপ্রেমহীন করে তুলেছিলেন তিনি।

এটাই হয়। ছাত্র ও তরুণদের যদি আপনি রাজনৈতিক কোনো আদর্শ থেকে দূরে রাখেন, তাদের হাতে সহজে-সুলভে অর্থ ও অস্ত্র তুলে দেন, তাহলে এ শক্তিটা বিচ্যুত হবেই। এ কাজ বিএনপি যেমন করেছে, জামায়াতও করেছে। জামায়াতে ইসলামী তো স্কুল থেকেই ছাত্রদের দলে রিক্রুট করে। পড়াশুনার খরচ, কোচিংয়ের ব্যবস্থা, ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ ইত্যাদি দিয়ে জামায়াত মেধাবী ছাত্রদের একটি অংশকে বিভ্রান্ত করে। তাই আমরা বলি, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট-পরবর্তী প্রজন্মটি ছিল 'অন্ধকার প্রজন্ম।' এ প্রজন্ম জানে না, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধ কেন হয়েছিল, কার বিরুদ্ধে হয়েছিল, কে-কে ছিল এ যুদ্ধের শত্রু-মিত্র, সে-যুদ্ধে সাধারণ মানুষের ত্যাগ-তিতীক্ষার গল্পও তাদের জানা নেই। আসলে এ ইতিহাস তাদের জানতে দেওয়া হয়নি। এভাবে দীর্ঘ একটি সময় তরুণরা ইতিহাসহীনতার অন্ধকারে বেড়ে উঠেছে।

এসময়ই ওই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বড় একটি প্রতিঘাত তৈরি করেছিল ১৯৯২ সালে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে 'একাত্তরের ঘাতক দালাল কমিটি' গঠিত হওয়ার পর। এরপর আমরা সমন্বয় কমিটি গঠন করলাম। দেখা গেল, নবীন প্রজন্মের বড় একটি অংশ আমাদের মিটিং-মিছিল-সেমিনার-সমাবেশে অংশ নিতে শুরু করেছে। এ তরুণদের নব্বই শতাংশের বয়স পঁচিশের নিতে। আমরা তখন তরুণদের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলতাম, ''এটা হচ্ছে 'দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযুদ্ধ।' কারণ একাত্তরে আমরা যা চেয়েছিলাম তা অর্জিত হয়নি। পরিপূর্ণ বিজয় আমরা পাইনি। একাত্তরের ঘাতক দালালরা এখনো সক্রিয়। তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে, তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে তোমাদেরই নেতৃত্ব দিতে হবে।'' এর ফলে দেখা গেছে, এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা তরুণরা, যাদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি– তারা ২০০৮ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের মহাজোটকে ভোট দিয়েছে।

আমাদের এসব উদ্যোগের ফলেই আজ স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস বা শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে স্মৃতিসৌধগুলোতে নব্বই বা পাঁচানব্বই শতাংশ তরুণকে দেখা যায়। তারাই ফুল হাতে বিনম্র শ্রদ্ধায় শহীদদের স্মরণ করে। এরা আসলে মুক্তিসংগ্রামের অহংকারকে ধারণ করে তাদের চেতনায়। বিজয়ের অহংকার লালন করে তাদের বুকে। এরা যুদ্ধ করেনি, যুদ্ধ করেছেন তাদের পিতা-মাতা-পূর্বপুরুষ অথবা অগ্রজরা। কিন্তু তারা জানে, আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে 'বাংলাদেশ' রাষ্ট্র গঠন বাঙালি জাতির পাঁচ হাজার বছরের লিখিত-অলিখিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অর্জন। আর এভাবেই আমরা মুক্তিযুদ্ধের পর যে বিপরীত স্রোতটি তৈরি হয়েছিল তাকে রুখে দিতে পেরেছি।

হ্যাঁ, পাশাপাশি তরুণদের একটা অংশকে ওই ঘাতক-দালালদের শক্তিটি বিপথগামী করছে, করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ওরা এটা করতে পারছে এজন্য যে, এগুলো একেবারে পেশাদারি ও ক্যাডারভিত্তিক সংগঠন। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন শিবিরের সদস্য হলে টাকা পাওয়া যায়। তখন ওরা অধিনায়কের নির্দেশে কারো গলা কাটে, কারো রগ কাটে, কারো-বা হাত-পা ভেঙ্গে দেয়। জামায়াত মনে করে, এটাই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তাদের জেহাদের একমাত্র পথ।

হিজবুত তাহরিরের মতো সংগঠনেও সামান্য-সংখ্যক তরুণ আজকাল যুক্ত হচ্ছে। এ নিয়ে আমার পর্যবেক্ষণের কথা আমি সম্প্রতি বিলেতে এক সেমিনারে বলেছি। নব্বই দশকে তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার ফলে বিশ্বব্যাপী একটি আদর্শিক শূন্যতা দেখা দিয়েছে। গোটা বিশ্বে এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একক পরাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ওদের ঠেকানোর কেউ নেই। এরই সুযোগ নিচ্ছে ওয়াহাবীপন্থীরা যারা ইসলামের নামে রাজনীতি করে। এরা মনে করে, গোটা বিশ্বে এরাই একমাত্র মার্কিনবিরোধী শক্তি। এজন্য এরা সন্ত্রাসী সংগঠন তৈরি করছে।

এর পেছনে এক ধরনের ইসলামী আদর্শের বিষয় তো আছেই, তবে সবচেয়ে বেশি হল সহজে অর্থপ্রাপ্তি। আপনি এদের অর্থ ও অস্ত্রের উৎস বন্ধ করে দিন, দেখবেন ক'জন তরুণ-তরুণী জামায়াতে ইসলামী করে! এটা তো কোনো আধুনিক ভাবধারা নয়! কেন একজন তরুণী নিজেকে আপাদমস্তক বোরখায় আবৃত দেখতে চাইবে? তারুণ্যের ধর্মই হচ্ছে বিদ্রোহ, প্রতিবাদ। আসলে আমাদের মতো দেশগুলোতে দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ওরা আমাদের তরুণদের মগজ-ধোলাই করতে পারছে। এর ফলে এ অঞ্চলে হিজবুত তাহরির, পাকিস্তানে মওদুদীবাদ বা মিশরে মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো সংগঠনগুলো কাজ করতে পারছে। কিছু তরুণকে আকৃষ্ট করতে পারছে ওরা যদিও এ তরুণরা সংখ্যায় খুব নগণ্য।

উন্নত বিশ্বের তরুণরাও কিন্তু এ ধরনের সংগঠনগুলোতে যুক্ত হচ্ছে। এর কারণও সেই সোভিয়েত ভেঙ্গে যাওয়া পরবর্তীর আদর্শিক সংকট। এ সংকটটি তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্র নামের রাষ্ট্রটাই। আল কায়েদা বলুন, তালেবান বলুন আর ওসামা বিন লাদেনই বলুন– এই দানবগুলোকে তৈরি করেছে যুক্তরাষ্ট্রই, রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য। এখন এগুলো 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইন' হয়ে তাদেরই আক্রমণ করছে।

একসময় পাকিস্তান, আফগানিম্তান ও ইরাকে তারা মৌলবাদী শক্তিকে উস্কানি দিয়েছে। এখন দিচ্ছে মিশরে, মুসলিম ব্রাদোরহুডের মতো শক্তিকে। যুক্তরাষ্ট্র সবসময় আমাদের দেশের ও পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীকে 'মডারেট মুসলিম শক্তি' বলে মূল্যায়ন করে। এর ফলে জামায়াত আস্কারা পেয়েছে। ওরা এ সাহস থেকেই একাত্তরে রাজাকার-আলবদর-আল শামস বাহিনী গঠন করেছে। গণহত্যায় অংশ নিয়েছে। এ আস্কারা থেকেই তারা ধর্মের নামে গণহত্যাকে জায়েজ করেছে।

আমি একবার পাকিস্তানে এক সেমিনারে বলেছিলাম, যদি একটা সুন্দর সকালে ঘুম ভেঙ্গে আমরা দেখি, পাকিস্তান একটি ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে- তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র সেটা মেনে নেবে? অবশ্যই নয়। কারণ সেখানে ওরা তো বসে আছে সন্ত্রাস দমনের জন্য। নিজেদের অবস্তানের যৌক্তিকতা তখন ওরা কীভাবে প্রমাণ করবে?

এ জন্যই ইরাকে সাদ্দাম হোসেনের মতো শাসক যিনি স্বৈরশাসক হলেও ছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ– তাকে সরিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের ব্যবস্থা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সেদেশে কী রাষ্ট্রব্যবস্থা থাকবে না থাকবে সেটা সেখানকার জনগণের বিষয়। আমরা তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাই না। মূল বিষয়টি হল, বিশ্বের দেশে-দেশে যত বেশি জঙ্গীবাদ-মৌলবাদ তৈরি হবে ততই তাদের আধিপত্য বিস্তারে সুবিধা হবে। তাই ওরা জামায়াতের মতো দলগুলোকে বলে দেয়, 'তোমরা ইচ্ছেমতো জঙ্গী বানাও, আমরা দেখব।' আমাদের দেশেও ওরা এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে চায় যেখানে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা যাবে না, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা যাবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু জঙ্গী যে রপ্তানি করা যায় এটা তো পাকিস্তান দেখিয়ে দিযেছে। আপনি বিশ্বের কোথাও জঙ্গী তৈরি করলে আপনি নিজেও নিরাপদ থাকতে পারবেন না। জঙ্গীরা সুবোধ বালকের মতো নির্দিষ্ট ভৌগোলিক বলয়ের মধ্যে আবদ্ধ থাকবে না। ফলে নয়-এগারোর মতো ঘটনা আরো ঘটতে থাকবে। এখন গুরুত্বপূর্ণ হল মার্কিন জনগণকে বিষয়টি বোঝানো্। একাত্তরে আমরা মার্কিন সরকারকে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করতে দেখেছি। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ আমাদের পক্ষে ছিল। এখনো আমাদের তাই করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের জনগণকে বোঝাতে হবে যে, জঙ্গীবাদ-মৌলবাদের কারখানা তৈরি করে ওরা নিজেরাও নিরাপদ থাকতে পারবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের কথা শুনলে একাত্তরে আমরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পেতাম না। এখনো তাদের কথা শুনতে হলে আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারব না। দেশকে আমরা যেখানে নিয়ে যেতে চাই সেখানে নিয়ে যেতে পারব না।

যুদ্ধাপরাধের বিষয় নিয়ে সম্প্রতি যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা নিয়ে বলব, জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের বিচার বন্ধ করার জন্য লবিষ্ট নিয়োগ করে রেখেছে। সম্প্রতি আমি একটি প্রোগ্রামের উদ্দেশে দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখলাম, পত্রপত্রিকায় ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে স্কাইপতে আরেক আইনবিশেষজ্ঞের কথাবার্তা নিয়ে তোলপাড় চলছে। আমি এতে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। আমি মনে করি, এখানে জিয়াউদ্দিন নামের যে-আইনবিশেষজ্ঞ ট্রাইব্যুনালের প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলেছেন, তিনি আইন জেনে-বুঝে আমাদের ট্রাইব্যুনালকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করেছেন। এই জিয়াউদ্দিন সাহেব নিজেকে প্রগতিশীল ও মুক্তিযুদ্ধের ধারক বলে দাবি করেন। কিন্তু কোন সাহসে তিনি আমাদের বিচারপতির সঙ্গে বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে কথা বলেন? আমি বলব, এ নিয়ে জোর তদন্ত হওয়া উচিত। মিডিয়াকেও সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি যে পত্রিকাগুলো বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে তাদের ব্যাপারেও জোর তদন্ত দরকার।

আমি মনে করি, যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া বানচাল করার জন্য জামায়াতে ইসলামী দীর্ঘদিন ধরে সক্রিয় রয়েছে। তাদের হাতে একটি সুযোগ তুলে দিয়েছেন জিয়াউদ্দিন সাহেব। যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচালের জন্য এটা একটা ষড়যন্ত্র বলে মনে হচ্ছে। কারণ আমরা শুরু থেকেই বলে এসেছি, ওরা বিভিন্ন লবিষ্ট গ্রুপ নিয়োগ করে রেখেছে যারা বাইরের দেশগুলোতে বিচারের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালাচ্ছে। যেমন, ক্যাসিডি অ্যান্ড এসোসিয়েটসের কথা আমরা জানি, এরা ২০ মিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কাজ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের লবিয়িং পুরোপুরি বৈধ। মার্কিন নৈতিকতার ধরন এটাই। তবে ইউরোপে এটা নেই। এখন কথা হল, এসব লবিস্ট গ্রুপের তৎপরতায় এসব হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে। বিলেতের এই 'ইকোনোমিস্ট' পত্রিকায় একসময় যুদ্ধাপরাধ নিয়ে প্রতিবেদন ছাপানো হয়েছে। আমার সাক্ষাৎকারও সেখানে ছিল। আল-জাজিরা, বিবিসির মতো চ্যানেলও আমাদের দেশের যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছে। এখন হঠাৎ করে কেন এরা গুটিকয়েক খুনির পক্ষে চলে গেল বোঝা মুসকিল।

আমি তো বলব, আদর্শ সাংবাদিকতা এখন বিশ্বের কোথাও নেই। 'টাইম' ম্যাগাজিনের অ্যালেক্স পেরির কথা আমরা ভুলে যাইনি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় পেরি এদেশে এলে আমরা তাকে জানিয়েছিলাম এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের কথা। বছরখানেক পর দেখলাম, খালেদা জিয়ার সরকারকে নিয়ে ইতিবাচক প্রচ্ছদকাহিনী ছাপিয়েছে টাইম। এ নিয়ে বিতর্কের এক পর্যায়ে জানা গেছে, এজন্য পেরিকে এক মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছিল। পরে তো পেরিকে 'টাইম' ম্যাগাজিন ছাড়তে হল।

এধরনের 'এমবেডেড জার্নালিজম' যুক্তরাষ্ট্রই আমাদের শিখিয়েছে। তবে আমরা জনগণের শক্তিতে বিশ্বাসী। যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্র চলবেই। একে প্রতিহত করতে পারব আমরা। আমি আশাবাদী। পাশাপাশি, আমাদের এই ষড়যন্ত্রগুলো বুঝে এগুতে হবে। ট্রাইব্যুনালের বিচার যেভাবে চলছিল সেভাবেই চলতে হবে। এটা ট্রাইব্যুনালের আইনেই আছে। মোট কথা, যুদ্ধাপরাধের বিচার করা শহীদ পরিবারগুরোর দাবি, আমাদের তরুণদের প্রাণের দাবি। এ থেকে সরে যাওয়া চলবে না।

শাহরিয়ার কবীর: লেখক, সাংবাদিক, চিত্রনির্মাতা ও মানবধিকারকর্মী।