খান সারওয়ার মুরশিদ: সান্নিধ্যের সৌরভ

আহমাদ মাযহারআহমাদ মাযহার
Published : 13 Dec 2012, 02:21 PM
Updated : 13 Dec 2012, 02:21 PM

অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ সম্পর্কে আমি মোটামুটিভাবে জানতে পারি আশির দশকে, যখন তিনি বিদেশ থেকে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিলেন সে-সময়। তখনই লক্ষ্য করেছি যে, তাঁর প্রসঙ্গে যাঁরাই কথা বলেন তাঁদের কণ্ঠ থেকেই ঝরে পড়ে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম।

সে-সময়টাতে আমি ছিলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একজন সাধারণ কর্মী ও সাহিত্যের উৎসাহী ভোক্তা। জ্ঞানের বিচিত্র শাখার স্বাদ আমার পক্ষে যতটা গ্রহণ করা সম্ভব তার মাধ্যম তখন পর্যন্ত বাংলা সাহিত্য বা বাংলায় অনুবাদের মাধ্যমে পাওয়া বিশ্বসাহিত্য। সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ থেকেই আমার মধ্যে ধীরে ধীরে জন্ম নিয়েছিল সাহিত্যসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের প্রতি কৌতূহল। অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের প্রতি আমার আগ্রহের সৃষ্টি সাহিত্যের প্রতি ওই ভালোবাসা থেকেই, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রেরই সূত্রে। আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে কর্মসূত্রে সে-সময় ছিলাম আমার শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের প্রায় সর্বক্ষণের সঙ্গী।

একদিন তাঁর কাছেই শুনলাম অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের কথা। তিনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আসবেন। সায়ীদ স্যারকে যেন খানিকটা বিচলিত মনে হল কীভাবে তাঁকে সমাদর করা হবে তা নিয়ে। আমার কাছে তা খানিকটা অস্বাভাবিকও লেগেছিল। কারণটা পরে বুঝলাম যখন খান সারওয়ার মুরশিদ সম্পর্কে সায়ীদ স্যার দু-একটা কথা বললেন। জানতে পারলাম, অধ্যাপক মুরশিদ বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তো বটেই, তার ওপর তিনি তাঁর প্রিয় শিক্ষকও।

যতদূর জানি অধ্যাপক মুরশিদ সরাসরি সায়ীদ স্যারের শ্রেণিকক্ষের শিক্ষক ছিলেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রে পঞ্চাশের দশকের একেবারে শেষপ্রান্ত থেকে তিনি তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। সে সান্নিধ্য গভীরতর হয় ১৯৬১ সালে আইয়ুবী স্বৈরশাসনামলের রুদ্ধ-বাংলাদেশে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষের আয়োজন উপলক্ষে। সায়ীদ স্যার সে-সময় রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ উপলক্ষে সাংস্কৃতিক সম্মেলন আয়োজনের উদ্যোগপর্ব নিয়ে একটি স্মৃতিচারণমূলক ব্যক্তিগত রচনা লিখেছিলেন। ওই রচনায় প্রজ্ঞাবান-সুস্মিত-সুরুচিসম্পন্ন-দৃঢ়চেতা-প্রাণবান একজন মানুষ হিশেবে খান সারওয়ার মুরশিদের পরিচয় পাই। যদিও তখন তাঁর সম্পাদিত উচ্চরুচির ইংরেজি পত্রিকা 'নিউ ভ্যালুজ'-এর নাম শুনলেও সে-সম্পর্কে তেমন জানি না।

পরে একদিন সায়ীদ স্যার আমাকে বলেছিলেন যে, প্রকাশিত রচনার গুণগত মান ও সারবত্তায় 'নিউ ভ্যাল্যুজ' ছিল অতিউচ্চমানের ইংরেজি পত্রিকা। উচ্চমানের রচনা প্রকাশের আকাঙ্ক্ষা পত্রিকার গায়ে ছিল চিহ্নিত। বয়সে প্রবীণ আরো অনেককেই পত্রিকাটি সম্পর্কে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে দেখেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক অজয় রায় পত্রিকাটি সম্পর্কে সম্প্রতি মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ''এটি একটি অনবদ্য পত্রিকা। আদর্শত দিকটি বাদ দিলেও এর সাহিত্যিক মূল্য ছিল অপরিসীম, এবং বর্তমান প্রেক্ষাপটেও এর আবেদন নিঃশেষ হয়ে যায় নি বলে আমি মনে করি।''

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস আনিসুজ্জামান মনে করছেন (অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ: সংবর্ধনা গ্রন্থ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০১২)- ''পাকিস্তান সৃষ্টির নব উন্মাদনার মধ্যে পরিশীলিত মানবিক মূল্যবোধের একটি নতুন ধারা ছড়িয়ে দিতে উদগ্রীব, মননশীলতার চর্চায় সবাইকে আহ্বান করতে দৃঢ়সংকল্প, সেটা বুঝতে কারো বাকি ছিল না। সেই ১৯৪৯ সালে এটি শুরু করেছিলেন তিনি এবং ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছিলেন একক প্রচেষ্টায়– এর চরিত্র ও মানের ক্ষেত্রে কোনো আপস করেন নি, একথা মনে রাখতেই হবে। ঢাকায় যখন চারুকলা ইনস্টিটিউটের শৈশবকাল, এদেশের শিল্প-আন্দোলন সবে গঠিত হচ্ছে, তখন তিনি নিউ ভ্যালুজের একটি সংখ্যাই নিবেদন করেছিলেন পূর্ববাংলার চিত্রকলা-চর্চার বিষয়ে, এও এক অবিস্মরণীয় সত্য।''

তাঁর সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অজয় রায় কিংবা এ এম এ মুহিত পূর্বোক্ত বইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের বিদেশি অধ্যাপক এ জি স্টকের Memories of Dacca University 1947-51 বই থেকে যে উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন তা প্রাসঙ্গিক বলে তুলে দিচ্ছি। এ জি স্টক বলেছিলেন:

New Values was essentially Murshid's creation: an English journal, more or less quarterly, which set out to focus the many-sided thought that was stirring in East Pakistan.

I see that it was a remarkable venture from the start. It was the right moment to launch a serious journal, for severance from West Bengal and differences from West Pakistan had made East Pakistan suddenly, vividly conscious of an identity and in need of an outlet to explain itself.

It seems to me that he kept New Values to broad political outlook, unmistakably critical of the government but aloof from party commitment and discreetly general enough in its specific comments to escape suppression, without being merely cantankerous; kept a high standard of writing; kept it, in matters literary and artistic, above the mutual admiration level which would have made it a 'little magazine'.

এ জি স্টকের বক্তব্যের মধ্যে বাংলাদেশের সাহিত্য সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে খান সারওয়ার মুরশিদের অবদানের গভীরতারও পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর বক্তব্যের সঙ্গে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের কথারও মিল আছে।

পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশে যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটেছিল তার সূচনা নগরভিত্তিক মধ্যবিত্ত জনজীবনে। অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করেন না যে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের তাত্ত্বিক ভিত্তি গড়ে ওঠার পেছনে খান সারওয়ার মুরশিদের 'নিউ ভ্যাল্যুজ' ও সিকান্দার আবু জাফরের 'সমকাল' পত্রিকার ভূমিকার গুরুত্ব কতটা ছিল। বিদেশি ছিলেন বলেই হয়তো তাঁদের অবদান মোহমুক্ত দৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন এ জি স্টক। তাঁর চোখে ধরা পড়েছিল পত্রিকায় প্রসারিত রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিটি। তিনি অনুভব করেছিলেন যে, তৎকালীন সরকারের প্রতি 'নিউ ভ্যাল্যুজ' তাকিয়েছিল সমালোচনামূলক দৃষ্টিতে; কিন্তু তার ছিল না কোনো নির্দিষ্ট দলের প্রতি আনুগত্য।

পত্রিকা সম্পাদনায় তাঁর যে একটা আবেগ ছিল এর খানিকটা পরিচয় আমি পেয়েছিলাম তাঁর স্ত্রী নূরজাহান মুরশিদ যখন 'এদেশ একাল' নামে একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতিধর্মী পত্রিকা বের করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন তখন। এ-সময় কয়েকবার তিনি ও নূরজাহান মুরশিদ এসেছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে আলাপের সময় আমিও মাঝে-মাঝে উপস্থিত থাকতাম। তাঁদের মধ্যে যেসব কথা হয়েছিল তা থেকে আমার অন্তত এমনটিই মনে হয়েছে।

'নিউ ভ্যাল্যুজ' সম্পর্কে তিনি নিজে বলেছিলেন, ''এ কাগজের অন্বিষ্ট ছিলো একটি সেকুলার ডেমোক্রেটিক রাষ্ট্র, যার ভিত্তি হবে দেশের দুটি প্রধান সম্প্রদায়ের যৌথ জাতীয়তা এবং মিলিত উত্তরাধিকার। যে উত্তরাধিকারের ভাষা, ভাষাগত সংস্কৃতি এবং সাহিত্য, একে অন্যের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত … এ শুধু আমার জীবনকাহিনীর অন্তর্গতই নয়। পত্রিকাটি প্রমাণ করে ওই তখন থেকেই পাকিস্তানের সংকীর্ণ পশ্চাৎমুখী রাষ্ট্রাদর্শের বিকল্প একটি রাষ্ট্রীয় ধারণা পূর্ববাংলায় দানা বাঁধছিল… আমরা একটা আধুনিক রাষ্ট্র চাই যেখানে ধর্ম জাতীয়তার নিয়ামক নয়, যেখানে সব সম্প্রদায় এবং সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী বিনা অন্তরায়ে বিকশিত হবে, এবং এভাবে একটি সত্যিকারের জাতি গঠিত হবে।'' [কালের কথা, খান সারওয়ার মুরশিদ, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা, পৃষ্ঠা ১০৯]

পত্রিকাটির কোনো কপি আমার দেখার সৌভাগ্য হয় নি। তবে পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি যে পরিশীলনে কতটা খুঁতখুঁতে স্বভাবের ছিলেন তা তাঁর সঙ্গে কথা বলে খানিকটা অনুভব করতে পেরেছি।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আয়োজনে দেশের সুধীমহলের পক্ষ থেকে অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে সংবর্ধিত করা হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন অধ্যাপক মুরশিদ। ঘটনাক্রমে অনুষ্ঠানটিতে উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেছিলাম আমি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইসফেন্দিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তন ও মিলনায়তনের সম্মুখ-প্রাঙ্গণের ফাঁকা জায়গা মিলিয়ে প্রচুরসংখ্যক সুধী ব্যক্তির সমাবেশ ঘটেছিল সেদিন। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া খ্যাতিমান মানুষদের এরকম বড় সমাবেশ খুব একটা অনুষ্ঠিত হত না সে-সময়। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ দেখেও এসেছিলেন অনেকেই। এমন একটি অনুষ্ঠান উপস্থাপনার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি প্রায় আড়ষ্ট হয়ে ছিলাম। খান সারওয়ার মুরশিদ সেদিন বক্তৃতা করেছিলেন ইংরেজিতে। সত্যি বলতে কী, আমার ভালো লাগে নি তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করেছিলেন বলে। তবে মনে আছে, প্রায় বইয়ের ভাষায় লেখা প্রবন্ধের মতো হয়েছিল তাঁর বক্তৃতাটি।

আরেক দিনের কথা মনে আছে। আহমদ ছফার মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল। পত্রিকায় ছোট্ট করে সে-আয়োজনের খবর বেরিয়েছিল। তা দেখেই চলে এসেছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ। উদ্যোক্তাদের অনুরোধে দু-একটি কথাও বলেছিলেন তিনি।

তাঁকে সভাপতিত্বের আসনে রেখে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আরও একটি অনুষ্ঠানের আমি ছিলাম উপস্থাপক। ওই অনুষ্ঠানটি আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে। সেটা ২০০২ বা ২০০৩ সালের কথা। আমি ততদিনে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সার্বক্ষণিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছি। হঠাৎ একদিন সায়ীদ স্যার আমাকে ফোন করে বললেন, তাঁর আগ্রহে অর্থনীতিবিদ-রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মোহাম্মদ আনিসুর রহমান কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে গান গাইতে রাজি হয়েছেন। অনুষ্ঠানে তিনি গান তো গাইবেনই, সে-সঙ্গে রবীন্দ্রসংগীত নিয়ে তাঁর স্বতন্ত্র ভাবনা-প্রকাশক বক্তব্যও রাখবেন। সায়ীদ স্যারের অনুরোধে এতে সভাপতিত্ব করতে রাজি হয়েছেন অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ। কিন্তু মুশকিল হল যে, খুব জরুরি একটা কাজ পড়ে যাওয়ায় সায়ীদ স্যার নিজেই উপস্থিত থাকতে পারছেন না। আমি যেন অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করি ও দুই শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্বকে সামলে রাখি।

সায়ীদ স্যারের নির্দেশ পেয়ে আমার একটু অস্বস্তি হল, কী করে আমি এই দুজনকে সামলাব তা ভেবে। আবার ভালোও লাগল এটা ভেবে যে, এমন একটা অনুষ্ঠানের জন্য স্যার আমাকেই যোগ্য ভেবেছেন। যথাসময়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে হাজির হলাম আমি। অধ্যাপক মুরশিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ওই আসরে মোহাম্মদ আনিসুর রহমান তাঁর নিজস্ব বিবেচনার আলোকে অনেকগুলো রবীন্দ্রসংগীত গাইলেন এবং প্রাসঙ্গিক কথাবার্তা বললেন। মোটামুটি ভালোসংখ্যক সুধী-সমাবেশ ঘটেছিল সেদিনের অনুষ্ঠানে।

অধ্যাপক মুরশিদ সভাপতির ভাষণ দিতে শুরু করতেই আমি একটু চমকে উঠলাম। কারণ তাঁর বক্তৃতা শুরু হয়েছে আমার প্রশংসা দিয়ে। তিনি যা বললেন তার মর্মার্থ হল, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কর্ণধার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের শিষ্যদের তৎপরতায় তাঁকে সভাপতি হিশেবে প্রায় নিস্ক্রিয় থাকতে হয়েছে। আর সেজন্য তিনি মোটেও দুঃখিত নন। কারণ সভাপতি হিশেবে যখন তাঁর যে ভূমিকা রাখার দরকার ছিল তা উপস্থাপক যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছেন, সভাপতির নির্দেশনার কোনো অবকাশ না দিয়েই। ফলে বক্তৃতা দেওয়া ছাড়া সভাপতির আর কোনো ভূমিকার অবকাশ থাকে নি। তারপর তিনি অধ্যাপক আনিসুর রহমানের রবীন্দ্রসংগীতের দু-একটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে প্রাজ্ঞ আলোকপাত করলেন।

২০০৬ সালে কবি শামসুর রাহমানকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হলে সেখানেও দেখলাম কবির শোকগ্রস্ত শিক্ষক খান সারওয়ার মুরশিদকে। চ্যানেল আইয়ের পক্ষ থেকে সে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচার চলছিল। আমি ছিলাম অনুষ্ঠানের উপস্থাপক। শোকস্তব্ধ তাঁকে দেখতে পেয়ে মাইক্রোফোন নিয়ে এগিয়ে গেলাম। খুব কম কথায় শামসুর রাহমান সম্পর্কে সারবান বক্তব্য রেখেছিলেন তিনি।

এ রকম হঠৎ-হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা হলেও সংকোচবশত আগ বাড়িয়ে তাঁর কাছে যেতাম না। তাছাড়া তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হতো দীর্ঘ বিরতির পরপর। ধরেই নিয়েছিলাম যে, আমার কথা তাঁর মনে থাকার কথা নয়। কারণ লেখক হিশেবে আমি একদিকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই, তেমনি আবার তাঁর সঙ্গে কোনো কার্যসূত্রে নিয়মিতভাবে সম্পর্কিতও নই।

২০০৯ সালে তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে আমিনুর রহমান রানার সাংগঠনিকতায় 'আলোকিত নগরী' নামের একটি সংগঠন গুলশানে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। আমি আমন্ত্রিত ছিলাম সেখানে। মধ্যাহ্নভোজনের পর লোকজন কমে এলে আমি তাঁর কাছাকাছি বসার সুযোগ পেলাম। আমার উদ্দেশ্য তাঁর কথা শোনা। মার্জিত ও পরিশীলিত রুচির মানুষটির কথা শুনতে আমার ভালো লাগত। তাঁর কথায় ছিল বৈদগ্ধ্য, সূক্ষ্ম ও স্মিত পরিহাসরসিকতা। সেদিন আকস্মিকভাবে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কী লিখছ তুমি?'

আমি প্রথমে পেছনের দিকে তাকালাম। ভাবলাম অন্য কারও উদ্দেশে তাঁর এই প্রশ্ন। কিন্তু দেখলাম তা নয়, তিনি আমাকেই জিজ্ঞেস করছেন! খানিকটা বিস্মিত হলাম, 'আমাকে জিজ্ঞেস করছেন! আমাকেও চেনেন আপনি!' তিনি স্পষ্ট করে বললেন, 'হাঁ, তোমাকেই জিজ্ঞেস করছি। তোমাকে তো ভালোভাবেই চিনি।' তারপর আমাকে আরও অবাক করে দিলেন, 'তুমি একসময় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সামনের সারির নেতা ছিলে না… তোমার স্ত্রী শিরীন বকুল নাট্যশিল্পী না….।' মৃদু হাসলেন তিনি, 'আমার সঙ্গে বিনয় করার প্রয়োজন নেই! আমি না-হয় লিখতে পারি না। কিন্তু তোমরা তো তা নও! তোমার লেখা তো মাঝে-মাঝেই নজরে পড়ে!'

তারপর বেশ কিছুক্ষণ আমরা কথা বললাম, ছবি তুললাম। বেশ ভালো মেজাজে ছিলেন বলে তাঁর সেই অনন্য মার্জিত ভঙ্গিতে অনেক কথা বললেন। একজন মেয়ে ভুল উচ্চারণে কথা বলছিল, ইংরেজির ভুল প্রয়োগ করছিল বারবার। মেয়েটিকে তিনি বললেন, 'কিছু মনে কোরো না, তোমাকে একটা কথা বলি। যখন আনুষ্ঠানিক কথা বলবে তখন আঞ্চলিকতা পরিহার করবে। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মেশাবে না।' আমি জানতাম খান সারওয়ার মুরশিদ বাংলায় কথা বলার সময় একটিও ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন না। কথা বলেন ধীরলয়ে, পরিস্কার উচ্চারণে, সম্পন্ন বাক্যে। ওপরিতলের ধারণানির্ভর কোনো চটুল মন্তব্য করে আসর মাত করার প্রবণতা তাঁর মধ্যে কখনও দেখা যায় নি। তাঁর সঙ্গে সে কয়েক মিনিটের বাক্যালাপের মধ্য দিয়ে আমরা একজন যথার্থ সংস্কৃতিবান মানুষের সাহচর্য লাভের আনন্দ যেমন পেয়েছিলাম তেমনি তা আমাদের জন্য ছিল শিক্ষণীয়ও।

এরপর থেকে তিনি বার্ধক্যজনিত নানা অসুস্থতায় পীড়িত ছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হচ্ছিল না। ২০০৯ সালের নভেম্বরে 'বইয়ের জগৎ'-এর প্রথম সংকলন প্রকাশিত হওয়ার পরের কথা। অধ্যাপক মুরশিদের কন্যা শারমিন মুরশিদের বারিধারার দূতাবাস রোডস্থ বাড়িতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার সুযোগ হয়েছিল। সঙ্গে ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ যিনি অধ্যাপক মুরশিদের খুবই অনুরাগী। আমার সম্পাদিত বই-সমালোচনার পত্রিকা 'বইয়ের জগৎ'-এর প্রথম সংকলনে অধ্যাপক মুরশিদের লেখা 'কালের কথা' বইটি নিয়ে আবদুল মান্নান সৈয়দ একটি সমালোচনা লিখেছিলেন। এটা করেছিলেন শুধু আমার অনুরোধে নয়, তাঁর নিজের পক্ষ থেকেও শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের তাগিদ থেকে। তাই মান্নান ভাই চেয়েছিলেন নিজে হাতে অধ্যাপক মুরশিদকে 'বইয়ের জগৎ'-এর ওই কপি তুলে দিতে।

সে-সন্ধ্যায় মান্নান ভাই আর আমি প্রায় ঘণ্টাদেড়েক ছিলাম সেখানে। দেশ, শিল্প, সাহিত্য, দুর্নীতি, বিশ্বায়ন ইত্যাদি নানা বিষয়ে কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে। কথা হয়েছিল টিআইবি নিয়েও। টিআইবির সঙ্গে অধ্যাপক মুরশিদের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে আমি প্রশ্ন তুললেও কুপিত না হয়ে তাঁর স্বভাবসুলভ মননশীলতা দিয়ে আমার বক্তব্যকে খণ্ডন করছিলেন। বয়স ও সামাজিক প্রতিষ্ঠার এতটা ব্যবধান সত্ত্বেও তিনি আমার পর্যবেক্ষণকে তাচ্ছিল্য করেন নি, তিরস্কার করেন নি বেয়াদবি বলে। বরং শান্তভাবে নিজের উপলব্ধির ব্যাখ্যা করে চলেছিলেন। এখানেও তাঁকে আমার যথার্থ গণতান্ত্রিক মানসিকতার একজন মানুষ বলে মনে হয়েছিল।

অধ্যাপক মুরশিদের সান্নিধ্যে আমাদের আলাপের মুহুর্তগুলো আমি ও মান্নান ভাই উভয়ের জন্যই ছিল স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। অধ্যাপক মুরশিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে 'আলোকিত নগরী'র রানা ভাইয়ের তৎপর ভূমিকার কথা এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে আমার। সঙ্গ দেওয়ার জন্য মান্নান ভাই আমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন, মনে পড়ছে সে-কথাও।

২০১২ সালে অধ্যাপক মুরশিদের ৮৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমী থেকে যে সংবর্ধনাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল, তার সংগঠনে আমিনুর রহমান রানার উদ্যোগের কথা মনে আছে। মনে পড়ছে অধ্যাপক মুরশিদের আরেক ছাত্র বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের কথা। রানা ভাইয়ের এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হতে পারত না তাঁর নিদের্শনা না থাকলে ও বাংলা একাডেমী থেকে তা প্রকাশের উদ্যোগ না নিলে। বইটি অধ্যাপক মুরশিদের কর্মময় জীবনকে বুঝতে বেশ সহায়ক হবে।

সংবর্ধনা-গ্রন্থের উদ্যোগপর্বের শেষপ্রান্তে রানাভাই আমাকে বলেছিলেন যে, সংবর্ধনাগ্রন্থটির জন্য অধ্যাপক মুরশিদ তাঁর প্রিয় ছাত্র আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের লেখা প্রত্যাশা করছিলেন। সায়ীদ স্যারও যে খুবই ইচ্ছুক ছিলেন লেখা দিতে সে-কথা আমার জানা ছিল। কিন্তু স্যারের ব্যস্ততার জন্য রানা ভাই তাঁর সঙ্গে কিছুতেই যোগাযোগ করে উঠতে পারছিলেন না। আমি সায়ীদ স্যারের সঙ্গে কথা বলে তাঁর সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ ঘটিয়ে দিতে পেরেছিলাম। রানা ভাইয়ের উপর্যুপরি তাগাদায় সায়ীদ স্যার শেষ পর্যন্ত লেখাটা দিতে পেরেছিলেন ওই সংকলনে।

অভিজ্ঞতা, প্রজ্ঞা, রুচি, শুভবুদ্ধি, দেশপ্রেম সব মিলিয়ে খান সারওয়ার মুরশিদ ছিলেন অসাধারণ একজন মানুষ। আমার সৌভাগ্য যে, এমন উঁচুস্তরের একজন মানুষের সামান্য সান্নিধ্য আমি পেয়েছিলাম। পেরেছিলাম তাঁর সার্বিক ব্যক্তিত্বের সুবাস অনুভব করতে। তাঁর বেঁচে থাকা মানে ছিল তাঁর সে সুবাসের দ্বারা আমাদের সমৃদ্ধ হওয়ার অবকাশ থাকা। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সে সুযোগের অবসান হল। তাঁর অভাব দীর্ঘকাল আমাদের অসহায় করে রাখবে।

আহমাদ মাযহার : প্রাবন্ধিক ও গবেষক।