শীতকাল কবে আসবে, সুপর্ণা?

দীপংকর চন্দ
Published : 11 Dec 2012, 12:48 PM
Updated : 11 Dec 2012, 12:48 PM

"শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব।"

কেন তিনমাস ঘুমিয়ে থাকবেন ভাস্কর চক্রবর্তী?

কেন তিন মাসের বেশি নয়?

সারাজীবনই-বা নয় কেন?

জেগে থাকলে কি কোনো অসুবিধে আছে?

ঠিক জানি না আমরা। সব প্রশ্নের উত্তর জানা নেই আমাদের। সব প্রশ্নের উত্তরের প্রত্যাশা করা উচিতও নয়। কবিতা মানেই জানা-অজানার মিথস্ক্রিয়া, বাস্তবের সঙ্গে কল্পনা-রূপকের সেতুবন্ধ। কিন্তু আমরা তো কবি নই! আমাদের জীবন কবিতার মতো শৈল্পিক নয়। আমাদের শীতকাল কেবলই কুয়াশাভরা, অস্বচ্ছতায় নিমগ্ন। ঘুমিয়ে থাকার মতো নিশ্চিত অবকাশ পেছনে ফেলে রাস্তায় নেমে আসতে বাধ্য হই আমরা। অনিবার্য জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার জন্যই শীতের কাব্যমুখরতা অতিক্রম করে এগিয়ে যাই কর্মক্ষেত্র অভিমুখে।

বিশ্বজিত দাস আমাদেরই একজন। বয়স খুব বেশি ছিল না তার। মাত্র ২৪। দুভাই এক বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট তিনি। সবচেয়ে আদরের। বাড়ি শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া উপজেলার মশুরা গ্রামে। ওদের মায়ের নাম কল্পনা দাস। বাবা অনন্ত দাস কাজ করেন ভোজেশ্বর বাজারের একটি মিষ্টির দোকানে। পরিবারে অর্থাভাব ছিল বলে খুব বেশি লেখাপড়া শিখতে পারেননি বিশ্বজিত। অল্পবয়সেই স্বজনদের মায়া পেছনে ফেলে গ্রাম ছাড়েন। সংসারে স্বচ্ছলতা আনার স্বপ্ন বুকে নিয়ে পা রাখেন মহানগরী ঢাকায়। সেটা বছর ছয়েক আগের ঘটনা।

পুরোনো ঢাকার লক্ষ্মীবাজারের ঋষিকেশ দাস রোডে পরিবারসহ থাকতেন বড় ভাই উত্তম কুমার দাস। ঢাকায় এসে সেখানেই উঠলেন বিশ্বজিত। বেঁচে থাকার জন্য বেছে নিলেন পোশাক তৈরির পেশা। ধীরে ধীরে পোশাক তৈরির একটা দোকান দিলেন তিনি। ১২৩ নম্বর শাঁখারিবাজারে অবস্থিত দোকানটির নাম দিলেন 'নিউ আমন্ত্রণ টেইলার্স'। সর্বসাধারণের প্রতি আমন্ত্রণের বার্তা জানানো সেই দোকাটিই হয়ে উঠল বিশ্বজিতের ধ্যান-জ্ঞান।

৮ ডিসেম্বর ২০১২। শীতের এক শনিবার। রাতে দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে এলেন বিশ্বজিত। তার কাকাতো ভাই রকি এসেছেন বাসায়। দীর্ঘক্ষণ রাত-জেগে দুজন গল্প করলেন। এক বিছানায় ঘুমালেন। পরদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন নয় যদিও, তবু দোকান খোলার কোনো তাড়া নেই বিশ্বজিতের। কারণ বিএনপি-জামায়াতসহ ১৮ দলীয় জোটের অবরোধ কর্মসূচি সেদিন। বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সংঘর্ষ, ভাঙচুর হতে পারে। তাই এদিন দোকান না খোলার সিদ্ধান্তে অটল বিশ্বজিত।

পরদিন সকালে অবরোধ কর্মসূচি সফল করতে রাজপথে তৎপর ১৮ দলীয় জোটের কর্মীরা। কর্মসূচির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিল অবরোধ-বিরোধীরা। ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হল অনাকাঙ্ক্ষিত শীতের সকাল। আতঙ্ক সৃষ্টি করা সে সকালে বিশ্বজিতকে ফোন করলেন এক নাছোড়বান্দা ক্রেতা। জরুরি প্রয়োজনে পোশাক হস্তান্তরের অনুরোধ জানালেন। ক্রেতা লক্ষ্মী। তার অনুরোধ রক্ষা করার জন্য অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘর ছেড়ে বেরুলেন বিশ্বজিত। লক্ষ্মীবাজার থেকে রওনা হলেন শাঁখারিবাজারের উদ্দেশ্যে।

সকাল আনুমানিক নয়টা তখন। ঢাকা জজকোর্ট এলাকা থেকে অবরোধের সমর্থনে একদল মানুষের মিছিল এগিয়ে গেল ভিক্টোরিয়া পার্কের দিকে। মিছিলটি পার্কের কাছে পৌঁছুতেই অবরোধ-বিরোধী পক্ষ ধাওয়া করল অবরোধ-সমর্থক পক্ষকে। পাল্টা জবাব দিল সমর্থকরা। কিছুক্ষণ পরই ভিক্টোরিয়া পার্কসংলগ্ন একটি তেলের পাম্পের কাছে কয়েকটি বিষ্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেল। অবরোধ-বিরোধীদের একটি মারমুখী অংশ তেড়ে গেল পাম্পের দিকে।

ঘটনা দেখে আতঙ্কিত পথচারীরা। দুর্ভাগ্যবশত বিশ্বজিতও ছিলেন পথচারীদের দলে। প্রাণভয়ে ছুটলেন সবাই। দ্বিগ্বিদিকজ্ঞানশূণ্য হয়ে বিশ্বজিতও নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছেন তখন। কাছেই ইনটেনসিভ ডেন্টাল কেয়ার নামের একটি বেসরকারি ক্লিনিক। সে ক্লিনিকের দোতলায় আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করলেন বিশ্বজিত। অবরোধ-বিরোধীরা অজ্ঞাত কারণে তাড়া করল তাকেই। ক'জন যুবকের একটি সশস্ত্র দল জাপটে ধরল বিশ্বজিতকে। ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে শুরু করল আঘাত। আঘাতের পর আঘাত!

প্রাণভয়ে আতঙ্কিত বিশ্বজিত তখন হাতজোড় করে তাদের বলার চেষ্টা করলেন, 'আমি রাজনীতি করি না… আমি হিন্দু।'

না, বিশ্বজিতের আকুতি কানে গেল না সশস্ত্র যুবকদের। অকম্পিত আঘাতে তারা রক্তাক্ত করল তাকে। একফাঁকে ভীত-সন্ত্রস্ত যুবকটি দৌড় দিলেন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। কিন্তু সফল হল না সে চেষ্টাও। কারণ, কোথায় সেই নিরাপদ জায়গা আমাদের এই বাংলাদেশে!

বিশ্বজিতের মৃত্যু হল শেষাবধি। এই শীতকালেই।

ভাস্কর চক্রবর্তীর ইচ্ছেটা নিজের করে নিতে ভীষণ ইচ্ছে করে আমাদের। তবে শুধু তিন মাস নয়, ইচ্ছে করে ঘুমিয়ে থাকতে একটা জীবন। সম্ভবত তাহলেই এমন পাশবিক হত্যাকাণ্ড আর দেখতে হবে না!