আমাদের প্রিয় শিক্ষক

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
Published : 10 Dec 2012, 02:04 PM
Updated : 10 Dec 2012, 02:04 PM

আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকদের মধ্যে তাঁকে মনে হত প্রায় রাজপুত্রের মতো। তাঁর উন্নত সুদর্শন কান্তি, রুচিস্নিগ্ধ ব্যক্তিত্ব ও অভিজাত মেধা চোখে না পড়ে উপায় ছিল না। সুচারুভাষী মুরশিদ তাঁর পরিশীলিত মনন, শাণিত শিল্পরুচি ও সচেতন প্রাণনা দিয়ে অপরিচিতদেরও অনায়াসে আকর্ষণ করতেন। তাঁকে আমার প্রথম দেখা ও চেনা এমনি একজন অপরিচিত হিসেবেই।

১৯৫৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই আমার ইংরেজি বিভাগের বন্ধুদের কাছ থেকে প্রথম তাঁর গুণপনার কথা শুনি। তবে তাঁকে কাছে থেকে দেখার এবং তাঁর কথা শোনার প্রথম সুযোগ হয় এর কমাস পরে, ১৯৫৮ সালের প্রথমদিকের কোনো এক সময়। তখন তিনি ফজলুল হক হলের মিলনায়তনে প্রায় একক উদ্যোগে দশ বছরের পূর্ব-পাকিস্তানী সাহিত্যের বিভিন্ন দিকের ওপর সাত দিনব্যাপী একটি সেমিনার-ক্রম পরিচালনা করছিলেন। সে সময় পর্যন্ত আমি আমার নিজের কথা বলার ভঙ্গিকে মার্জিত ও শ্রুতিনন্দন করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কারও মুখে সুন্দর ও সুশোভন কথা কানে এলেই তা রক্তের ভেতর বৃষ্টির মতো শুষে নিতে চেষ্টা করি। সেমিনারগুলোয় শোনা স্যারের অনবদ্য বাচনভঙ্গি, রুচিপূর্ণ শব্দচয়ন, শাণিত বৈদগ্ধ্য আমার মনের ওপর এক ধরনের সম্মোহন ছড়িয়ে দিয়েছিল।

অনুষ্ঠান-ক্রমে স্যারের দায়িত্ববোধ, উৎসাহ, ব্যক্তিত্বের দ্যুতি দীর্ঘদিন যে আমার মনের ভেতরটাকে কৃতজ্ঞ ও সশ্রদ্ধ করে রেখেছিল তা টের পেলাম এর বছর তিনেক পর, যখন রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের সময় এলো। সময়টা তখন খুবই বৈরী, দেশ আইয়ুবী সামরিক শাসনের নির্মম বুটের নিচে নিষ্পিষ্ট, ব্যক্তিস্বাধীনতা শ্বাসরুদ্ধ, বিশেষ করে বাঙালি সংস্কৃতির যে কোনো তৎপরতা প্রায় রাষ্ট্রদ্রোহিতার শামিল। পাকিস্তানের মোট তেইশ বছরে পূর্বপাকিস্তানের ওপর পশ্চিমাদের যতরকম নিগ্রহ আর নিষ্পেষণ চলেছে, তার কোনোটিই বর্বরতা এবং নির্দয়তায় এই সময়ের সঙ্গে তুলনীয় নয়। অথচ ঠিক এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী এসে দাঁড়াল আমাদের সামনে। আমরা টের পেলাম সেদিন আমাদের জন্য এই শতবার্ষিকী উদ্যাপন কেমলমাত্র একটি বিচ্ছিন্ন 'রাবীন্দ্রিক' ঘটনা নয়, এই বিপজ্জনক উদযাপন সম্ভব হলে তা হবে অবরুদ্ধ বাঙালি সংস্কৃতির আঙ্গিনায় কিছু দিনের জন্যে হলেও মুক্তির নির্মল হাওয়া বয়ে যাওয়া, আর সেই উজ্জ্বল আনন্দিত পরিবেশের ভেতর নিজস্ব সংস্কৃতিকে রক্তের ধারায় টেনে নিয়ে বাঙালি চেতনার স্বপ্ন নিয়ে বেঁচে থাকা।

সেই বৈরী পরিবেশে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়ার ঝুঁকি অনেক। কোনোখানে এ ব্যাপারে কোনো আশান্বিত আগ্রহও দেখা যাচ্ছে না। তবু আমরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষের গুটিকয় বন্ধু, এককাট্টা হয়ে ঠিক করেছি যা মূল্য দিতে হয় দেব, কিন্তু আমরা জাতীয়ভাবে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করবই। নিজেরা সব না পারলেও কাজটা শুরু করে একটা চলনসই পর্যায় পর্যন্ত এগিয়ে তুলে দেব বড়দের হাতে, তারা পরেরটা করবেন। এই ত্রাস আর ভীতির রাজ্যে কেউ নিজে থেকে এগিয়ে আসতে সাহস পাচ্ছে না, তাই আমাদের নির্বোধ তারুণ্য দিয়ে এই কাজটুকু শুরু না করলে হয়ত এ আলোর মুখই দেখবে না। এত বড় অনুষ্ঠান করতে গিয়ে প্রথমেই মনে আসে সংগঠনের কথা। মনে হল এমন বিরুদ্ধ পরিবেশে এরকম অনুষ্ঠান করতে হলে প্রথমে চাই বিশ্বাসযোগ্য মানুষদের একটা দায়িত্বশীল কমিটি। না হলে সর্বগ্রাসী রাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের মুখে এ টিকে থাকতে পারবে না। প্রথমেই ভাবতে হল কে হতে পারেন এর সাধারণ সম্পাদক যিনি যোগ্যতায় বৈদগ্ধ্যে পরিশীলনে সুধী সমাজের বিশ্বাস ও আস্থা ধরে রাখতে পারবেন। আলোচনার সময় আমাদের সামনে যে নামটি প্রথমেই উঠে এল সে নাম খান সারওয়ার মুরশিদের। বিদ্যা-বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব আর আত্মপ্রত্যয়ে তাঁর চেয়ে চোখে পড়ার মানুষ আমাদের চারপাশে তখন আর কেউ নেই।

তাছাড়া তিনি যে এমন একটা উঁচুমাপের সাংস্কৃতিক দায়িত্ব নেবার জন্য সাংগঠনিকভাবে যোগ্য তার পরিচয় তিনি তো বছর কয়েক আগের সেই সপ্তাহব্যাপী সেমিনার-ক্রম পরিচালনায় দিয়েছেন। কাজেই আপত্তি কোথায়।

আগেই বলেছি, তাঁর যে গুণগুলো আমাকে সবচেয়ে আকর্ষণ করেছিল তাঁর একটি হল তাঁর বৈদগ্ধময় অনবদ্য বাচনভঙ্গি। তিনি মননশীল মানুষ। তাঁর কথার পরতে পরতে তাঁর ভেতরকার চিন্তাশীল মনটিকে প্রতিমুহুর্তে অনুভব করা যেত। তিনি কথা বলতেন কিছুটা থেমে থেমে, ভেবে ভেবে, সবচেয়ে অনিবার্য শব্দটিকে মননলোক থেকে চয়ন করে করে। চিন্তার এই অমসৃণ ও বন্ধুর গতি যে কারও কথাকে কিছুটা আড়ষ্ট বা কৃত্রিম করে তুলতে পারে। মনে হতে পারে নিষ্প্রাণ বইয়ের ভাষা শুনছি। তাঁর ব্যাপারেও তা ঘটত না তা নয়। কিন্তু সে একেবারেই অল্পক্ষণের জন্যে। কিছুক্ষণ শোনার পরই টের পেতাম তাঁর ভেতরকার সজীবতা, স্বতঃস্ফুর্ততা ও উৎসাহের গতি সেই কেতাবি আড়ষ্টতাকে ছাপিয়ে তাঁর কথাকে করে তুলেছে স্বচ্ছন্দ ও প্রাঞ্জল। এই নিক্বনমুখর সাবলীলতা তাঁর সঙ্গীতময় প্রকৃতির একেবারেই নিজস্ব জিনিশ। এই প্রকৃতির সঙ্গে বক্তব্যের তীক্ষ্ণ প্রাণনা যোগ হয়ে তাঁর কথাকে করে তুলত প্রসাদগুণময়। তাঁর উচ্চারিত প্রতিটি শব্দের ভেতর যে মননের উপভোগ্যতা, চিন্তার আস্বাদ্যতা বা মেধার তীক্ষ্ণতা আমরা পেয়েছি তার সমমাপের জিনিস আমাদের সময়ের খুব অল্প মানুষের মধ্যে দেখেছি।


রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আয়োজন-উদ্যোগের প্রথম দিকে জাতীয় কমিটি গড়ে ওঠার পর্বে, আমি ছিলাম স্যারের কাছাকাছি। নানান সাংগঠনিক ব্যাপার নিয়ে স্যারের সঙ্গে তখন প্রায়ই কথা হত। কিন্তু কমিটি পূর্ণায়ত হয়ে নানা কার্যক্রম শুরু করে দিলে, দেশের বড় বড় মানুষ আর ব্যক্তিত্বদের পাশে আমরা, এই আয়োজনের প্রথম অস্ফুট উদ্যোক্তারা এক সময় প্রায় হারিয়েই যাই। স্যারের সঙ্গেও আমাদের যোগাযোগ কমে আসে, অনুষ্ঠানের পর একরকম তা হারিয়েই যায়। এরপর আমার জীবনে আসে ষাটের দশকের তরুণ লেখকদের সাহিত্য আন্দোলনে জড়িয়ে যাবার দিন। আমাদের এবারের কর্মযজ্ঞ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে, শহরের এ পাড়ায়, ও পাড়ায়। ফলে স্যারের সঙ্গে যোগাযোগের মতো দেখাশোনাও শেষ হয়ে যায়। তবু দূর থেকে সাহিত্য নিয়ে আমার সে সময়কার এই নতুন মাতামাতির খবর যে তিনি কমবেশি রাখছেন তা বুঝতাম তাঁর মুখের ছিটোফোটা হঠাৎ দুয়েকটা কথায়। একদিন দেখা হলে হঠাৎ হেসে বললেন, 'কী খবর, আমাদের সাহিত্যের 'লোন ক্রুসেডার'। কথাটা বার দুই তাঁর মুখেই শোনা। বাক্যটার মধ্যে প্রসন্ন শ্লেষের আভাস থাকলেও সত্যিকার আন্তরিকতা নিয়েই কথাটা বলছেন বলে মনে হত। টের পেতাম আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক আমাদের এই সাহিত্য চেষ্টাটিকে যে উপহাস বা তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতেন অন্তত তিনি সেভাবে দেখতেন না। এই সসম্মান ব্যাপারটা তাঁর ভেতর সব সময় দেখেছি। যোগ্যকে ন্যায্য মূল্য দেবার ব্যাপারে তিনি অকৃপণ ছিলেন।

তাঁর পরিশীলিত বাচনভঙ্গি ছিল তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে জ্বলজ্বলে জিনিস। তাঁর ভেতরকার প্রখর বৈদগ্ধ, তীব্র মননশীলতা, ক্ষিপ্র বুদ্ধিমত্তা, গভীর উপলব্ধি-সবকিছুই তাঁর এই বাচনিক প্রতিভা ও সুললিত কণ্ঠমাধুর্যকে আশ্রয় করেই সারাজীবন দীপিত হয়েছে।

এ তাঁর ফ্যাশান নয়, স্টাইল। এ জন্যে তাঁর কথার সঙ্গে আর কারো মিল নেই। এর মধ্যে ফ্যাশানের মতো যদি কিছু থেকেও থাকে তা অন্যের কাছ থেকে ধার করা কিছু নয়। আর যদি স্টাইল হয়ে থাকে তবে তা অননুকরণীয়।


আগেই বলেছি তাঁর ব্যক্তিত্বের সবচেয়ে স্বতঃস্ফুর্ত প্রকাশমাধ্যম তাঁর বাচনভঙ্গি। কিন্তু কথা তো একদিন বাতাসে মিলিয়ে যায়। সবচেয়ে খুশির ব্যাপার হত যদি তিনি তাঁর গাঢ় সাহিত্যবোধগুলোকে কিংবা দেশ-সমাজ-রাষ্ট্র সম্বন্ধে তাঁর মৌলিক ভাবনাগুলোকে তাঁর মুখের কথার মত স্বতঃস্ফুর্ত ভাষায় লিখে রেখে যেতে পারতেন। নিশ্চিত বলা যায়, তাহলে আমাদের যুগের একজন উঁচু মাপের মেধাবী মানুষ হিসেবে তিনি স্মরণীয় হতেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তিনি খুব বেশি লেখেন নি। যেটুকু লিখেছেন তার মধ্যে তাঁর ব্যাপ্ত চিন্তাজগত সামান্যই ধরা পড়েছে। খুবই বেদনাদায়ক যে এ পর্যন্ত তাঁর প্রকাশিত মৌলিক বই সাকুল্যে একটি– একেবারেই আটপৌরে নামের একটি প্রবন্ধগ্রন্থ: 'কালের কথা'। বইটি কোনো বিশেষ বিষয়ের ওপর নয়, নিষ্কৃতিহীন কোনো প্রেরণা থেকেও লেখা নয়– দেশ, সমাজ, মুক্তিযুদ্ধ, সাহিত্য, শিক্ষাঙ্গন এসব বিষয়ে বিভিন্ন সময় লেখা তাঁর বিক্ষিপ্ত কিছু রচনার একটা আধখেচড়া সংকলন মাত্র।

তার চেয়েও যা খেদের তা হল লেখাগুলোর অধিকাংশ তাঁর নিজের তাগিদে লেখা নয়, কমবেশি ফরমায়েসি লেখা। তবু অনুরোধের দায় হিসেবে লেখা এই প্রবন্ধগুলোর যে ব্যাপারটি অবাক করে তা হল লেখাগুলো পড়ার সময় এক মুহুর্তের জন্যও মনে হয় না এগুলো ফরমায়েসি। আচমকা বা আব্দারি লেখার মধ্যে সাধারণত এক ধরনের আড়ষ্টাতা বা কষ্টকল্পনার ব্যাপার থাকে। তাঁর এ লেখাগুলোয় এ ধরনের মননের বন্ধ্যাত্ব্য বা ক্লিষ্টতা নেই। বরং পড়তে গেলে মনে হয় লেখাগুলোর প্রতিটি কথা যেন তাঁর মাথার ভেতর বহুদিন ধরে চিন্তিত, অনুভূত ও পরিস্রুত হয়ে লিখিত হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করেছিল যে প্রতীক্ষার কোনো এক মুহুর্তে তিনি ফরমায়েশটি পেয়েছিলেন। তাই তাঁর ফরমায়েসি লেখাও এমন স্বতঃস্ফুর্ত, আর অন্তর্ভেদী। তাঁর মস্তিষ্ক প্রখর ও জাগ্রত, অন্তর্জগত ও বহির্জগতের অজস্র ব্যাপার নিয়ে অনুক্ষণ অতন্দ্র। তাই লিখুন বা না লিখুন, সারা জীবন তাঁর মস্তিষ্ক এমনি বহু বিষয় নিয়ে চিন্তা প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করে লেখার জন্যে উদগ্রীব হয়ে থেকেছে, কিন্তু ফরমায়েশ দিয়ে বা জোরাজুরি করে কেউ তাঁর কাছ থেকে সেগুলো আদায় করে নেয়নি বলে আর সেসব লেখা হয়নি। এমনি অনেক অলিখিত লেখা মস্তিষ্কের খাঁজে বয়ে, প্রকাশের ব্যাথা নিয়ে তিনি অস্বস্ত জীবন কাটিয়েছেন। না-লেখার স্থবিরতা থেকে নিষ্কৃতির উপায় খুঁজেছেন, কিন্তু পথ বের করতে পারেনি। হয়তো সেই লেখাগুলোই কেবল তিনি লিখতে পেরেছেন যেগুলো গুণগ্রাহীরা তাঁর কাছ থেকে নাছোড়বান্দার মতো নিষ্কাসন করে নিতে পেরেছিলেন। ড. মুরশিদের ভেতর একজন শক্তিমান লেখকের ক্ষমতা ও যোগ্যতা ছিল, কিন্তু প্রকাশের ক্ষমাহীন আকুলতা ছিল না, যা লেখকমাত্রেরই থাকে।

আগেই বলেছি বাংলায় লেখা তাঁর একমাত্র বই 'কালের কথা'। বইটি পড়লেই বোঝা যায় তাঁর লিখিত রচনা তাঁর মুখের ভাষার মতোই স্বতঃস্ফুর্ত। তবে মুখের ভাষার মতো হলেও এর মধ্যে কিছু বাড়তি সম্পন্নতা আছে যা এই লেখাগুলোকে বিশিষ্ট করেছে। তাঁর লেখা সংহত, গভীর ও মননের বিভায় জ্বলজ্বলে। তাঁর লেখায় হৃদয়াবেগ জোরালো, কিন্তু কখনোই তাঁর নির্মম রুচি ও পরিশীলনকে অতিক্রম করে না। ফলে তা এক সংযত বৈদগ্ধ্যের গাঢ়তা নিয়ে ফলে ওঠে। একটা ছোট বাক্য তুলে দিয়ে তাঁর লেখার এই গুণটি পাঠককে বোঝানোর চেষ্টা করি। তাঁর 'স্বাধীনতা: কিছু স্মৃতি কিছু কথা' প্রবন্ধের প্রথম বাক্য এরকম: একাত্তর একটি বিশ্বাস, একটি ভয়ংকর ও মহৎ অভিজ্ঞতা, একটা দুর্গম স্মৃতি, চেতনার এক ঝলসানো বিভাজন রেখা।' পাঠক লক্ষ্য করুন বাক্যটির মধ্যে তাঁর লেখার বৈশিষ্ট্যের প্রায় সবগুলোই এক সঙ্গে উপস্থিত। এ একই সঙ্গে কবিতা, মনন, গভীরতা, পাণ্ডিত্য, বৈদগ্ধ্য, বুদ্ধির ক্ষিপ্রতা ও স্বতঃস্ফুর্ততা। এই হলেন খান সারওয়ার মুরশিদ। এই বৈশিষ্টগুলোকে 'কালের কথা'য় সমন্বিত করে তিনি এমন এক গদ্যভাষা আমাদের উপহার দিয়েছেন যা আলাদা কেবল নয়, অনবদ্য।

'কালের কথা'র বিষয়ও নানারকম, লেখক সেগুলোকে আলাদা আলাদা শিরোনামে গুচ্ছবদ্ধও করেছেন। শিরোনামগুলো দেখলেও তাঁর আগ্রহ ও উৎসাহের বহুমুখিতার পরিচয় মেলে। তাঁর লেখাগুলো মূলত প্রবাহিত হয়েছে পাঁচটি ধারায়– মুক্তিযুদ্ধ, রাজনীতি, শিক্ষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে। প্রতিটি বিষয়েই তাঁর চিন্তার স্বকীয়তা আর তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির ছাপ প্রখর। ড. মুরশিদের মূল অবদান মননের ক্ষেত্রে। এই মননের জগৎ চিরকালই পদপাতবিরল। তাঁর লেখা কোনোদিন গণমানুষের স্বতঃস্ফুর্ত উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু হবে, এমন আশা হয়ত করা যাবে না। কিন্তু তাঁর এই ছোট্ট ও সুসংহত বইখানি যে সম্পন্ন শানিত চিন্তার জন্য বোদ্ধা পাঠককে অনেকদিন প্রলুব্ধ করবে তা অনায়াসেই বলা যায়।

আমাদের অধিকাংশ লেখকের মতো সাহিত্য তাঁর কাছে কেবল ব্যক্তিগত উপভোগ বা একান্ত চর্চার ব্যাপার ছিল না। একে তিনি দেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে। তাই সাহিত্যবোদ্ধার বা লেখক সত্তার পাশাপাশি তাঁর ভেতর সহজেই দেখতে পাই একজন সাহিত্যকর্মী ও সাহিত্য সংগঠকের হৃদয়। নিজের উদ্যোগে পঞ্চাশ দশকে বাংলা সাহিত্যের ওপর সেমিনার-ক্রম আয়োজন বা রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর সাফল্যে তাঁর সেই যোগ্যতার প্রমাণ মেলে। এর শেষ প্রমাণ রয়েছে নব্বই-এর দশকে এশিয়াটিক সোসাইটিতে বাংলা সাহিত্যের মূল্যায়নের ওপর আর একবার তাঁর বড় ধরনের সেমিনার-ক্রম আয়োজনে। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি ও অর্থপূর্ণ অংশগ্রহণ বা সারা জীবন বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব যোগ্যতার সঙ্গে পালনেও এর পরিচয় আছে। তাঁর সাহিত্য-দায়িত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ তাঁর সম্পাদিত অভিজাত রুচির ইংরেজি পত্রিকা নিউ ভ্যালিউজ (১৯৪৯-১৯৬৫)। এই পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ইংরেজি লেখাগুলোও তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার প্রমাণ।

সুদর্শন, সুচারুভাষী ড. মুরশিদ আজীবন আমাদের সামনে ছিলেন অভিজাত মূল্যবোধ, উদারতা, পরিশীলন, মার্জিত রুচি ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতীক। তাঁর সসম্ভ্রম ব্যক্তিত্ব, মর্যাদাবোধ ও সাহিত্যপ্রেম সব সময় আমাদের ভেতরে শ্রেয়ের স্বপ্ন জাগিয়ে রাখতে সাহায্য করেছে; আশার প্রতীক হয়ে শক্তি বাড়িয়েছে। উনবিংশ শতকের বাঙালি জীবনে যে রেনেসাঁ জেগেছিল তা ইয়োরোপের মতো প্রাচীন গ্রিসের প্রেরণায় বিকশিত হয়নি। বাঙালির হাতে এ এসেছিল রেনেসাঁ-জাগ্রত ইংল্যান্ডের হাত ধরে। ইংল্যান্ড আর আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ভেতর দিয়ে সেকালে এদেশের জন্ম নিয়েছিলেন এমন কিছু মানুষ যাঁরা উদারতায় মহিমায়, মনুষ্যত্বে, ব্যক্তিত্বের বহুচ্ছরণে ছিলেন ইয়োরোপিয় 'রেসেসাঁ মানব'দের সমকক্ষ। উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাঙালিদের ভেতর জন্ম নিয়েছেন এমনি বহু সম্পন্ন মানুষ যাঁরা তাদের অন্তর্লোকের আলোয় সমাজ এবং পরিপার্শ্বকে কমবেশি দীপিত করছেন। রেনেসাঁ-মানবের ঐ গুণাবলী নিয়ে আমাদের সমাজে জন্ম নেওয়া শেষ গুটিকয় মানুষের মধ্যে ড. মুরশিদ একজন।

প্রতিভার অবিস্মরণীয় উদ্ভাসে চারপাশকে তিনি বিচ্ছুরিত করেছেন– তাঁর সম্বন্ধে এমন কথা অত জোর দিয়ে বলব না কিন্তু তাঁর সুষম সুমার্জিত ব্যক্তিত্ব, শ্রেয়োবোধ, পরিশীলিত ও উচ্চায়ত বৈদগ্ধ দিয়ে আমাদের সামনে উন্নত জীবনের যে মানদণ্ড তিনি আজীবন উঁচু করে রেখেছিলেন তার মূল্য অস্বীকার করলে কৃতঘ্নতা হবে।

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: প্রয়াত খান সারওয়ার মুরশিদের ছাত্র এবং বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা।