ইতিহাসের পাতায় নারী নেত্রী রোকেয়া

বেবী মওদুদ
Published : 16 Nov 2015, 03:56 PM
Updated : 9 Dec 2012, 09:21 AM

বাঙালি নারীমুক্তি আন্দোলনের নেত্রী রোকেয়া তাঁর মহৎ কর্মের জন্য চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন। নারীকে তিনি অন্ধকার থেকে আলোয় এনেছেন, অবরোধ থেকে উন্মুক্ততায় দাঁড় করিয়েছেন, নিরক্ষরতা থেকে স্বাক্ষর ও মেধাসম্পন্ন করেছেন- নারীকে তিনি অসহায় অবস্থা থেকে অর্থ-সম্পদে স্বাবলম্বী করেছেন, ব্যক্তিত্বে-দূরদর্শীতায় ও দক্ষতায় উপযুক্ত করেছেন। আজকের দিনে একেই আমরা বলি নারীর ক্ষমতায়ন। আর এ কারণেই ইতিহাসের পাতায় রোকেয়া মহিয়সী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

একশ বছর আগে রোকেয়া নারীর ক্ষমতায়ন সম্পর্কে চিরন্তন সত্যটি উচ্চারণ করেছিলেন, "পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয়, তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জ্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী ব্যারিস্টার, লেডী জজ- সবই হইব! পঞ্চাশ বৎসর পরে লেডী Viceroy হইয়া এদেশের সমস্ত নারীকে 'রাণী' করিয়া ফেলিব!! উপার্জ্জন করিব না কেন? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই? কি নাই? যে পরিশ্রম আমরা "স্বামী"র গৃহকার্য্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পরিব না?" (স্ত্রী জাতির অবনতি)।

১৯০৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় রোকেয়ার প্রথম গ্রন্থ 'মতিচুর (প্রথম খণ্ড)'। রোকেয়া ১৯০২ সাল থেকে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি করে সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র বাইশ। প্রবন্ধটি তাঁর দ্বিতীয় লেখা। রোকেয়ার চিন্তা-ভাবনা এখানে আমাদের গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন নারীর হাতেই সম্ভব নারীর প্রতিষ্ঠা, নারীর ক্ষমতায়ন। তিনি নারীকে অবরোধ থেকে টেনে খোলা আকাশের নিচে দাঁড় করিয়ে দেখাতে চেয়েছেন পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য নারীকে কী কী করতে হবে। গৃহকর্মে নারী যে পরিশ্রম করে, সে পরিশ্রমেরও তিনি মূল্যায়ন করেছেন। বলেছেন যে সে শ্রম নারী স্বাধীন ব্যবসায়ে নিয়োজিত করতে পারেন। গৃহকর্মে নারীর শ্রম দেওয়াকে পুরুষ নারীর দায়িত্ব বলেই মনে করে। কিন্তু সে শ্রম যে অর্থপূর্ণ সেটা কেউ বুঝতে চায় না। নারীর জন্মই যেন গৃহকর্ম সাধন করতে। গৃহকর্ম যে অর্থোপার্জনের উপায়ও হতে পারে সেটা কেউ ভাবতে চায় না।

রোকেয়া আরও একটি অমূল্য সত্য উচ্চারণ করেছেন, "তোমাদের কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জন করুক।" (স্ত্রী জাতির অবণতি) নারীর ক্ষমতায়নে সেটা যে কত বড় সত্য তা আজ একশ বছর পরেও চারপাশে তাকালে আমরা স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পরি।

পদ্মরাগ উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ১৯২৪ সালে। প্রকাশক ছিলেন রোকেয়া নিজেই। উপন্যাসটির পরিচ্ছদ-সংখ্যা আটাশ। এটি পড়লেই বোঝা যায় রোকেয়া অনেক চিন্তাভাবনা করে লেখাটি তৈরি করেছেন। এসময় তিনি নিজের প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত স্কুলের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। স্কুলের নানা সমস্যা ছাড়াও, নিয়মিত লেখালেখি ও নারীঅধিকার প্রতিষ্ঠার কাজে সম্পৃক্ত থেকেও তিনি উপন্যাসটি শেষ করেন। উপন্যাসটি তাঁর মননের একটি সমৃদ্ধ ফসল।

রোকেয়ার মানবিক দিকটি এখানে প্রচণ্ডভাবে প্রকাশিত। বিশেষ করে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী এবং শুদ্ধ বাঙালির চারিত্রিক দৃঢ়তায় তিনি যে কতখানি শক্তিশালী ছিলেন- উপন্যাসটি পড়লে আমরা সেটা বুঝতে পারি। ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হলেও ভূমিকায় রোকেয়া বলেছেন, "প্রায় ২২ বৎসর পূর্বের এই উপন্যাসখানি লিখিত হইয়াছিল।" অর্থাৎ ১৯০২ সালে এটি রচিত হয়, এরপর তিনি এটি পুনর্লিখন করেন দীর্ঘ সময় ধরে: "অনেক স্থল পরিবর্ত্তিত, পরিবর্দ্ধিত ও পরিবর্জ্জিত হইয়াছে।"

গ্রন্থের নায়িকা সিদ্দিকাকে 'রোকেয়ার মানসকন্যা' বলে মনে করা হয়। কারণ এ চরিত্রের মধ্য দিয়ে রোকেয়া তাঁর আদর্শ কন্যাকে অঙ্কিত করেছেন, সিদ্দিকার চিন্তা-ভাবনা ও কথাবার্তায় রোকেয়ার মানস-চেতনা প্রকাশ পেয়েছে। সিদ্দিকা যখন উচ্চারণ করে, "আমি সমাজকে দেখাইতে চাই, একমাত্র বিবাহিত জীবনই নারী-জন্মের চরম লক্ষ্য নহে; সংসার ধর্মই জীবনের সারধর্ম নহে। পক্ষান্তরে আমার এই আত্মত্যাগ ভবিষ্যতে নারীজাতির কল্যাণের কারণ হইবে বলিয়া আশা করি।" বাস্তবিকই রোকেয়ার আত্মত্যাগ ও আদর্শ আজকের নারীর কল্যাণের কারণ। এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই। পদ্মরাগের নায়িকা সিদ্দিকার ভাগ্য নিয়ে রোকেয়া লিখছেন, "…প্রত্যুত্তরে বরের পিতৃব্য স্পষ্ট জানাইলেন যে, সম্পত্তি না পাইলে তাহারা আমাকে গ্রহণ করিবেন না এবং তিনি ভ্রাতুষ্পুত্রের বিবাহ অন্যত্র দিতে বাধ্য হইলেন। ….. ভাইজান আমাকে বলিলেন, …."তুই জীবন-সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হ! মুষ্টিমেয় অন্নের জন্য যাহাতে তোকে কোন দুরাচার পুরুষের গলগ্রহ না হইতে হয় আমি তোকে সেইরূপ শিক্ষা-দীক্ষা দিয়া প্রস্তুত করিব। তোকে বাল্য-বিধবা কিংবা চিরকুমারীর ন্যায় জীবন যাপন করিতে হইবে; তুই সেজন্য আপন পায়ে দুঢ়ভাবে দাঁড়া!" (পদ্মরাগ)

এই যে 'আপন পায়ে দৃঢ়ভাবে দাঁড়া' এটাই আজকের নারীর কাছে অনেক বড় শিক্ষা, অতুলনীয় শক্তি ও আদর্শ। যুগে-যুগে শুধুমাত্র বাঙালি নারী নয়, পুরুষের কাছেও রোকেয়ার উচ্চারিত বাণী গ্রহণযোগ্য। তিনি মুসলমান সমাজের সংকীর্ণতা, ধর্মান্ধতা ঝেড়ে ফেলে তাকেও যুগোপযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি সমগ্র বাঙালি সমাজকে জাগাতে চেয়েছিলেন, তাঁর লেখনীর বেত্রাঘাতে।

রোকেয়ার সময়ে ভারতের কিছু-কিছু জায়গায় নারীদের শিক্ষাগ্রহণে এগিয়ে আসতে দেখি। একই সময়ে এশিয়ার কিছু দেশেও নারীরা শিক্ষিত হতে থাকেন। কিন্তু এ মহাদেশে নারীর সমানাধিকারের দাবি রোকেয়াই প্রথম তুলেছিলেন। পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য নারীকে তার ন্যায্য অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার চিন্তাটা তাঁরই। তিনি জানতেন রাষ্ট্র, সমাজ ও পরিবার নারীর অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। তিনি সমাজকে সচেতন হতে বলেছেন এবং রাষ্ট্রকে নারীর নাগরিক অধিকার প্রদানের পাশাপাশি তার দায়িত্বপালনে বাধ্য থাকতে বলেছেন। রোকেয়ার লেখা সুলতানার স্বপ্ন পড়লে আমরা তাঁর রাষ্ট্র-পরিচালনায় দূরদর্শী চিন্তার পরিচয় পাই।

পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় নারীমুক্তি সম্ভব নয় বলেই তিনি নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে চেয়েছেন। রোকেয়ার নারীমুক্তির প্রধান শর্ত ছিল শিক্ষা ও কর্মসংস্থান। আজকের যে বিপুলসংখ্যক নারী সামান্য শিক্ষার্জন করেও কেরানি ও পিয়নের চাকরিসহ গার্মেন্টস ও অন্যান্য কারখানায় কাজ করছেন- কুটির-শিল্প গড়ে তোলা, দোকান চালানো ও ক্ষুদ্র ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন যে-নারীরা সেটা তো অনেক বড় প্রাপ্তি। রোকেয়া এই অসহায় ও দরিদ্র মেয়েদের নিজের পায়ে দৃঢ় হয়ে দাঁড়াতে বলেছেন যাতে নির্যাতন, বঞ্চনা, বৈষম্য, অবিচার, অন্যায় জয় করে তারা আপন ভাগ্য গড়ে তুলতে পারেন।

বেবী মওদুদ:লেখক ও সাংবাদিক।