নারীর জন্য একটি পক্ষ

খুশি কবির
Published : 8 Dec 2012, 05:52 PM
Updated : 8 Dec 2012, 05:52 PM

গোটা বিশ্বে ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুরো একটি পক্ষ নারীনির্যাতন বন্ধে সচেতনতা তৈরির জন্য পালন করা হয়। এর ধারাবাহিকতায় এবারও পক্ষটি আমাদের দেশে পালন করা হচ্ছে। নানা আয়োজনের মাধ্যমে নারীনির্যাতন বন্ধে সমাজকে সচেতন করাই এর উদ্দেশ্য। এ প্রেক্ষিতে আমাদের দেশের নারীদের অবস্থা ও অগ্রগতির সূচকগুলো নিয়ে বলতে চাই। পাশাপাশি, তাদের পিছিয়ে পড়ার কারণগুলোও বিশ্লেষণ করব।

মানব উন্নয়ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে। কন্যাভ্রুণহত্যা এ অঞ্চলের অনেক দেশেই আছে। ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম, এমনকী চীনে পর্যন্ত এটা খুব জোরেশোরে চলছে। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা পিতৃতান্ত্রিক হওয়া সত্ত্বেও এখানে তা নেই। কন্যাশিশুর মৃত্যুহারও কমছে। দক্ষিণ এশিয়ার জন্য জাতিসংঘের রিপোর্টে বাংলাদেশে কন্যাশিশুমৃত্যুর হার কমার বিষয়টা দেখা গেছে। আগে অপুষ্টি আর চিকিৎসার অভাবে মেয়েশিশুদের মৃত্যুহার বেশি ছিল। আর এটা হত কন্যাসন্তানের প্রতি মা-বাবার অবহেলা থেকে। এখন মেয়েকে অবহেলা করার বিষয়টা কমে গেছে, যদিও পুত্রসন্তানকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রবণতা আগের মতোই আছে।

আরেকটি সুখবর, বাংলাদেশের নারীর গড় আয়ু বেড়েছে। স্বাধীনতার পর প্রথম দশ বছরে আমাদের দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর আয়ু কম ছিল, যদিও বিশ্বে সাধারণভাবে পুরুষের চেয়ে নারীর গড় আয়ু বেশি। এখন বাংলাদেশেও পুরুষ–নারীর গড় আয়ু প্রায় সমান-সমান। আরো কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন আছে। যেমন, কন্যাশিশু জন্ম দিলে একসময় মাকে নিপীড়ন করা হত। অনেক সময় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা কন্যাশিশুর মাকে আর গ্রহণ করত না। এ প্রবণতাটা এখন অনেক কমেছে। আর পাশাপাশি বেড়েছে কন্যাশিশুকে শিক্ষা দেওয়ার হার।

তারপরও আমাদের নারীর জন্য নেতিবাচক দিকের অভাব নেই। এখনো এদেশে একক নারী নিজের মতো করে জীবনযাপন করতে পারে না। সমাজ তার প্রতি অনুদার। নারীর দৈনন্দিন চলাফেরায় নিরাপত্তা নেই। পাশাপাশি, সমাজে যৌন হয়রানি অনেক বেড়ে গেছে। সেটা পথে-প্রান্তরে হোক কী কর্মক্ষেত্রে। বিশেষ করে কর্মক্ষেত্রে হয়রানি এখন প্রচণ্ডভাবে চলছে। আমরা দেখেছি, এনজিও সেক্টর এবং মিডিয়াতে পর্যন্ত মেয়েরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের প্রধান যদি নারী হন তাহলে নারীর জন্য কিছুটা সুবিধা হতে পারে। তবে সে নারী প্রধানকে হতে হবে নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন। তা না হলে কোনো লাভ নেই।

ফতোয়াবাজি বন্ধ হয়ে গেছে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই। গত বছর কোর্ট থেকে অর্ডার এসেছিল যে ফতোয়ার মাধ্যমে প্রদত্ত রায়ের কোনো প্রয়োগ করা যাবে না। এটা সরাসরি ফতোয়াকে অবৈধ ঘোষণা না করলেও, 'ফতোয়াবাজি' মানে ফতোয়া দিয়ে কোনো নারীকে ইচ্ছেমতো শাস্তি দেওয়ার প্রবণতা কমাবে। তবে কোর্টের এ রায়ের কোনো বাস্তবায়ন দেখা যাচ্ছে না।

সম্পত্তিতে নারী এখনো পুরুষের সমানাধিকার পায়নি। হিন্দু বিয়ে রেজিস্ট্রেশন আইন হয়েছে কিন্তু একটি ফাঁক রয়ে গেছে। মজার বিষয় হল, বলা হয়েছে এটা কবে থেকে কার্যকর হবে তা পরে জানানো হবে। এর অর্থ কী? আইন পাশ করলাম কিন্তু আইন কার্যকর করার সুযোগ রাখলাম না! এটা এক ধরনের প্রতারণা। হিন্দু বিয়ে রেজিস্ট্রেশনের আইন করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে নারী সংগঠনগুলোর একটা চাপ ছিল। জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালার একটি অংশ এটি। কিন্তু কথা দিয়েও কথা রাখা হল না কেন? হতে পারে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক বা আমলাতান্ত্রিক কোনো চাপ কাজ করেছে। আবার হতে পারে আমাদের পিতৃতান্ত্রিক সমাজের নানা ভয়ভীতি থেকে আইনটির বাস্তবায়ন পিছিয়ে রাখা হচ্ছে। বিয়ে রেজিস্ট্রেশন আইন হিন্দু নারীর জীবনে অনেক পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারত। যদিও পদক্ষেপটা খুব ছোট, এটির প্রয়োগ হলে হিন্দু নারী অন্যান্য অধিকারও ধীরে ধীরে পেয়ে যেতেন। একেবারে শুরুর কাজ এটাই।

দেশে নারীনির্যাতন, ধর্ষণ, অপহরণ, এসিড নিক্ষেপ তো আছেই- হয়রানি বা নিপীড়নের ফলে আত্মহত্যার হারও কমেনি। এর মানে হল, সমাজ নারীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাষ্ট্রও এই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারছে না। এর কারণ প্রধানত আইনের ফাঁকফোকর। পাশাপাশি রয়েছে আইন বাস্তবায়নের দুর্বলতা। কোর্টে পুলিশ নির্যাতিত নারীকে হয়রানি করে। নিপীড়নের শিকার নারীকে তার পরিবারও গ্রহণ করতে চায় না। ফলে নিপীড়িত নারীটি হযে পড়েন আরো অসহায়।

কর্মক্ষেত্রে নারীর ওপর যৌন হয়রানি বন্ধ করার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন সেল গঠন করার জন্য হাইকোর্টের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এখনো পর্যন্ত খুব কম প্রতিষ্ঠানই এ নির্দেশনা মেনে সেল গঠন করেছে। এর ফলে নিপীড়নকারী পুরুষরা নানাভাবে সহকর্মী নারীদের হয়রানি করতে পিছপা হচ্ছে না। এরা সাধারনত যেসব উপায়ে নারীদের হেনস্থা করে তার মধ্যে রয়েছে- বিল ভাউচার সূক্ষভাবে দেখা, ট্রান্সফার করে এমন জায়গায় দেওয়া যেখানে ওই কর্মী কাজ করতে পারবেন না ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি মেয়েদের নিজেদের কিছু সমস্যার কথাও বলব। তাদের নিজেদের সংকোচবোধটা ভাঙতে হবে। 'ভালো মেয়ে' হওয়ার জন্য আমাদের মেয়েদের ছোটবেলা থেকে শিক্ষা দেওয়া হয়। ফলে মেয়েদের মধ্যে ভালো মেয়ে হওয়ার নিরন্তর চেষ্টা থাকে। লোকে আমাকে খারাপ মেয়ে বলবে এ ভয়ে নিজের অধিকারটুকু বুঝে নিতে পিছিয়ে যান মেয়েরা।

আমার কাছে এটাও বেশ দুঃখের বিষয় যে, এখন দেশে পর্দা বেড়েছে। মেয়েদের মস্তিষ্কে এটা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে পর্দা করলে তারা পথেঘাটে যৌন হয়রানির শিকার হবে না। এটি খুব ভুল একটি ধারণা। নিজের ঘরেই ধর্ষণ বা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারে যেকোনো নারী। তাছাড়া নারীনিপীড়ক একজন নারীকেই নিপীড়ন করে- নিপীড়িত নারীর পোশাক যাই হোক। নিপীড়কের সাইকোলজিটাই এমন।

মনে আছে সত্তরের দশকের শুরুতে আমি নিজে যখন গ্রামে-গঞ্জে কাজ করতে যাই, আমার পোশাক ছিল তখনকার মেয়েদের চেয়ে আলাদা। ওই সময়কার রক্ষণশীল সমাজের বিপরীত স্রোতে গিয়ে আমি পোশাক নিয়ে কম্প্রোমাইজ করিনি। এর ফলে যে আমি কাজ করতে পারিনি তা তো নয়। দীর্ঘ তিন দশকে মাঠে-ময়দানে সক্রিয়ভাবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, গ্রামের সাধারণ মেয়েদের বোঝালে নিজেদের অধিকারের ব্যাপারটা বোঝেন। অনেক মেয়ে বলতেন, পর্দা তো মনের ব্যাপার। গ্রামের সাধারণ নারীদের এ সচেতনতার বিষয়টি মুগ্ধ করার মতো।

বর্তমানের এই পর্দা সম্পর্কে আমার আপত্তির আরেকটি কারণ হল, এটি একটি পশ্চিমা পোশাক। মেয়েদের শার্ট-প্যান্ট পরাকে যারা পশ্চিমা পোশাক মনে করে, তারা আরেকটি পশ্চিমা পোশাক 'হিজাব' বা 'বোরখা'কে কীভাবে গ্রহণ করে? হ্যাঁ, এটা অবশ্যই মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য- আমাদের নয়। আমাদের এ অঞ্চলের মেয়েদের পোশাক হচ্ছে শাড়ি বা সালোয়ার-কামিজ। সেসব বাদ দিয়ে কেন মেয়েরা ভিনদেশি পোশাক পরবে, নিরাপত্তার অজুহাতে? আমরা দেখেছি যৌন নির্যাতনের শিকার নারীরা অনেকেই তথাকথিত পর্দা করে। তাই বোরখা বা হিজাব নারীকে নিরাপত্তা দিচ্ছে এটা ভুল ধারণা। এ থেকে নারীকে বের হয়ে আসতে হবে।

একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নারী কখনও-ই পর্দা করতে পারেন না। কারণ এতে তাকে ব্যক্তি হিসেবে অপমান করা হয়। তার যোগ্যতা বা ব্যক্তিত্বের চেয়ে তার শরীরকে বড় করে তোলা হয়। আমি তো মনে করি, নারীর পর্দা পুরুষের জন্যও অপমানজনক। নারীকে পর্দা করতে বলার মানে এটা বোঝানো যে, তিনি নারীকে মানুষ নয়, বস্তু হিসেবে দেখেন বলে যেকোনো সময় যেকোনো নারীকে নিপীড়ন করতে পারেন, তিনি ভালো-মন্দের ব্যবধান ভুলে যান। আমি পুরুষদের এ কথাগুলো সবসময় বলি। আমার ধারণা আমি নিজে পুরুষ হলে এ অপমান কিছুতেই মেনে নিতে পারতাম না।

যাহোক, মূল জায়গাটা হল- নারীর অধিকারের ব্যাপারে, তার অবস্থানের উন্নয়নের জায়গা থেকে আমাদের দেশ অনেকদূর এগিয়ে গেছে। তবু আমাদের আরো অনেক কাজ করতে হবে। নারীকে যেন নিরাপত্তার অভাব বোধ করতে না হয়। নারীকে এখনো প্রতিমুহূর্তে ভাবতে হয় তিনি তার ঘরে থাকতে পারবেন কিনা, যৌতুকের বলি হবেন না তো, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে তার জীবন বিপর্যস্ত করবে কিনা। গ্রামীণ নারীর ওপর নিপীড়নের বোঝা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে ক্ষুদ্রঋণ। দেখা গেছে স্বামী স্ত্রীর নামে ঋণটি নিচ্ছেন। পরে ঋণ শোধ করতে না পারলে নারীটিই গ্রামছাড়া হচ্ছেন। এভাবে নানা ভয়ভীতি নারীর জীবনকে বিপর্যস্ত করে যাচ্ছে।

উত্তরাধিকার আইন পরিবর্তন প্রসঙ্গে বলব, তথাকথিত গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে এখনো ধর্মকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়। এটা কিন্তু শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বেই রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ধর্মের বিরাট প্রভাব রয়েছে। বারাক ওবামাকে প্রথমবার নির্বাচনের সময় প্রমাণ করতে হয়েছে যে তিনি ক্যাথলিক ধর্মের অনুসারী, মুসলিম নন।

সত্যিকারের গণতন্ত্র এটা নয়। আমাদের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বদলাতে হবে। গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনে যারা জয়ী হয়ে আসেন, তাদের সমাজের প্রতি, জনগণের প্রতি কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই অভ্যাসটা যদি বদলে যায়, তাহলে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ হবে। রাজনীতিবিদরা তখন সত্যিকারের জনকল্যাণমুখী পদক্ষেপ নেবেন। গণতন্ত্র ও সুশাসন নিশ্চিত করা গেলে নারীর ভাগ্যের উন্নয়নও সহজ হবে।

অনেকেই আরেকটি বিষয় ভুলভাবে উপস্থাপন করে থাকেন। রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে পুরুষাধিপত্য দূর করার মানে কিন্তু নারীর আধিপত্য প্রতিষ্ঠা নয়, বরং নারী ও পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠা। আমাদের যাবতীয় কাজ এই লক্ষ্যেই পরিচালিত হচ্ছে। একটি বৈষম্যমূলক সমাজ থেকে আমরা আরেকটি বৈষম্যমূরক সমাজে অবশ্যই যাব না। পিতৃতন্ত্রের অন্য পিঠ মাতৃতন্ত্র নয়- সমানাধিকার এবং প্রকৃত গণতন্ত্র। এ প্রসঙ্গে একটি অসাধারণ শ্লোগানের কথা উল্লেখ করছি। 'ম্যান অব কোয়ালিটি নেভার অ্যাফ্রেইড অব ইকোয়ালিটি।' তার মানে, যে পুরুষ গুণবান তিনি সাম্যের ভয়ে ভীত হন না বরং সেটাই তার কাছে কাঙ্ক্ষিত।

আর এটাই হল শতবর্ষের পুরনো নারীআন্দোলনের মূল তাৎপর্য। সমাজের সব মানুষের সমান অধিকার আর বিকাশের সমান সুযোগ তৈরি করা। নারীর জন্য বিশেষ-বিশেষ দিবসগুলো পালনের উদ্দেশ্যও এটাই।

খুশি কবীর : মানবাধিকার কর্মী ও 'নিজেরা করি' সংগঠনের সমন্বয়কারী।